চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতাল

সংক্রমণের ভয়, কাপড় ধুতে অনীহা

ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। কিন্তু সেই ভুল ধারণা কাটাতে যে সচেতনতা দরকার, তা এখনও তেমন ভাবে গড়ে ওঠেনি। যার নিট ফল, অনেকেই মনে করছেন, ক্যানসার রোগীদের কাপড়চোপড় এমনকী ক্যানসার হাসপাতালের চিকিৎসকদের অ্যাপ্রন-গাউন সাফ করলে তাঁরাও ওই রোগে আক্রান্ত হবেন। এরই সাম্প্রতিকতম নিদর্শন দেখা গিয়েছে কেন্দ্রীয় সাহায্যপ্রাপ্ত চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৫ ০২:৪৪
Share:

ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। কিন্তু সেই ভুল ধারণা কাটাতে যে সচেতনতা দরকার, তা এখনও তেমন ভাবে গড়ে ওঠেনি। যার নিট ফল, অনেকেই মনে করছেন, ক্যানসার রোগীদের কাপড়চোপড় এমনকী ক্যানসার হাসপাতালের চিকিৎসকদের অ্যাপ্রন-গাউন সাফ করলে তাঁরাও ওই রোগে আক্রান্ত হবেন। এরই সাম্প্রতিকতম নিদর্শন দেখা গিয়েছে কেন্দ্রীয় সাহায্যপ্রাপ্ত চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে।

Advertisement

অভিযোগ, ওই হাসপাতালে চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত চাদর, অ্যাপ্রন কাচলে রোগ সংক্রমিত হবে, এই যুক্তিতে কোনও লন্ড্রিই হাসপাতালের সঙ্গে কাপড় কাচার চুক্তি করতে রাজি নয়। রোগীদের পরিজনদের দিয়েই চিকিৎসকদের গাউন, নার্সদের অ্যাপ্রন থেকে শুরু করে রোগীর পোশাক, বিছানার চাদর, তোশক-বালিশের ঢাকা, অস্ত্রোপচারের জিনিসও কেনানো হচ্ছে বলে অভিযোগ। ওই হাসপাতালে আসা রোগীদের অধিকাংশই অত্যন্ত দরিদ্র। ওষুধ-ইঞ্জেকশনের উপরে প্রায় প্রতিদিন নতুন চাদর-অ্যাপ্রন কিনতে তাঁদের নাভিশ্বাস উঠছে।

হাসপাতালের অধিকর্তা জয়দীপ বিশ্বাসের কথায়, ‘‘২০১১ থেকে এই পরিস্থিতি চলছে। একটি করে লন্ড্রি ঠিক করা হয়। প্রথমে তারা রাজি হয়। কিন্তু কিছু দিন পরেই বলে, ক্যানসার হাসপাতালের কাপড়-চাদর বেশিরভাগ ধোপা ধুতে চাইছেন না। তাঁদের ধারণা, এতে তাঁদেরও ক্যানসার হবে। অনেক বুঝিয়েও এই ভুল ভাঙা যাচ্ছে না।’’ জয়দীপবাবুর আরও দাবি, গত তিন বছরে কাপড় ধোওয়ার জন্য তাঁরা চার বার দরপত্র ডেকেছেন। কোনও বারই কোনও সংস্থা আসেনি। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়, বিজ্ঞাপন দিয়ে সংস্থা নিয়োগ করা হবে। সে ভাবে তিন বার তিনটি সংস্থাকে পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এক-দু’বারের পরে তারাও কাজ ছেড়ে দিয়েছে।

Advertisement

অধিকর্তা আরও জানান, রাজ্য সরকারি হাসপাতালগুলি থেকে যে লন্ড্রি রোগীদের পোশাক, চিকিৎসকদের অ্যাপ্রন ইত্যাদি সংগ্রহ করে, তাদের সঙ্গেও তাঁরা যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু একই যুক্তি দেখিয়ে তারাও কাজ করতে রাজি হয়নি।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, ২০১১ পর্যন্ত যদি ওই হাসপাতালের কাপড় কাচার লন্ড্রি পাওয়া যায়, তার পরে হঠাৎ কেন তারা পিছিয়ে যাচ্ছে ? তা ছাড়া, কলকাতায় কয়েকটি বেসরকারি ক্যানসার হাসপাতালও রয়েছে। তারা কী ভাবে কাজ করাচ্ছে?

ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালের তরফে চিকিৎসক অর্ণব গুপ্ত বলেন, ‘‘আমাদের হাসপাতালের আয়ারাই কাপড়চোপড় প্রাথমিক ভাবে সাফ করে লন্ড্রিতে পাঠান। তা না হলে সেগুলি অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠতে পারে’’। অন্য দিকে, সুবোধ মিত্র ক্যানসার হাসপাতালের তরফে চিকিৎসক শারদ্বত মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘স্থানীয় ধোপারাই এসে রোগীদের কাপড় ও আমাদের অ্যাপ্রন-গাউন নিয়ে যান। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সেগুলি প্রাথমিক ভাবে সাফ করে লন্ড্রিতে পাঠানো হয়।’’

ঠাকুরপুকুরের একটি লন্ড্রির তরফে রাজেশ রজক বলেন, ‘‘২০১১ সালের আগে পর্যন্ত চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের কাপড়চোপড় হাসপাতালেই এক বার ধুয়ে পাঠানো হত। এখন সেখানকার ওটি গাউন, কাপড়, অ্যাপ্রন আসে রক্ত-মাংস-তুলোয় মাখামাখি হয়ে। ওই সব কাপড়ের অবস্থা দেখেই ধোপারা সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা করেন। তাই আমরা চিত্তরঞ্জনের কাজ ছেড়েছি।’’

রিচি রোডের আর এক লন্ড্রি সংস্থার তরফে সাধন চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘এমন অবস্থায় চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের কাপড় আসে যে ধোপারা বলে দেন, তাঁরা কাচতে পারবেন না। ভয় পান, তাঁরাও রোগাক্রান্ত হয়ে যাবেন।’’

লন্ড্রিগুলির যুক্তি মেনে নিয়েছেন জয়দীপবাবু। তিনি বলেন, ‘‘হাসপাতালে কর্মীসঙ্কট। প্রাথমিক ভাবে কাপড় ধুয়ে দেওয়ার লোকও পাওয়া যাচ্ছে না।’’ হাসপাতালের এমপ্লয়িজ অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায় (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই) বলেন, ‘‘এই সমস্যা সম্পর্কে জানি। চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী—সবার সঙ্গে আলোচনা করে আপাতত চুক্তির ভিত্তিতে কিছু কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে, যাঁরা প্রাথমিক ভাবে কাপড় সাফ করে লন্ড্রিতে পাঠাবেন। পাশাপাশি, এই নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে লন্ড্রির কর্মীদের নিয়ে কর্মশালাও করা হবে।’’

কিন্তু চার বছর ধরে এই সমস্যা চলা সত্ত্বেও বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়নি কেন? ওই হাসপাতালের কাপড় সাফাইয়ের তত্ত্বাবধানে থাকা চিকিৎসক ইন্দ্রনীল ঘোষের যুক্তি, মাসখানেক আগে কর্তৃপক্ষই ওয়াশিং মেশিন এবং ড্রায়ার কিনে কিছু-কিছু জিনিস কাচা শুরু করেছেন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সেটা অনেক কম। কর্তৃপক্ষ এখন স্বীকার করছেন, সরকারি নিয়মের জেরে এবং কিছুটা সিদ্ধান্তহীনতায় ওই কাজ করতেই চার বছর কেটে গিয়েছে। আর তার ফল ভুগতে হচ্ছে সাধারণ গরিব মানুষকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন