বড়দের কেচ্ছা-চর্চা ঢুকে পড়ছে শিশুদের জগতেও

শোভন-বৈশাখী ‘কেচ্ছা’-ই শিশুদের স্কুলের খেলায়!

দেবাশিস ঘড়াই ‘ন্যাশনাল জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চ’-এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এই তথ্য উঠে এসেছে। আজকাল অবশ্য টেলিভিশনের পাশাপাশি ইউটিউব, ফেসবুক-সহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াও রয়েছে। কিন্তু সর্বত্রই যদি কেচ্ছা-কেন্দ্রিক আলোচনা বেড়ে যায়, তা হলে কি শিশুমনে তার প্রভাব পড়ে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৮ ০১:১০
Share:

শোভন-বৈশাখীর শাড়ি কেনার এই ভিডিয়ো এখন ভাইরাল।

ছোট থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত এক-এক জন ভারতীয় গড়ে ১৫ হাজার ঘণ্টা শুধু টেলিভিশন দেখেই খরচ করেন। ‘ন্যাশনাল জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চ’-এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এই তথ্য উঠে এসেছে। আজকাল অবশ্য টেলিভিশনের পাশাপাশি ইউটিউব, ফেসবুক-সহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াও রয়েছে। কিন্তু সর্বত্রই যদি কেচ্ছা-কেন্দ্রিক আলোচনা বেড়ে যায়, তা হলে কি শিশুমনে তার প্রভাব পড়ে?

Advertisement

বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ভাল রকমই প্রভাব পড়ে। কারণ, ‘প্রি-টিন’ (৬-৮ বছর বয়স) মূলত আশপাশে যা হচ্ছে, তা অনুসরণ করে। বিপদ আরও বাড়ে, যখন টেলিভিশনের আলোচনা, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মেসেজ বা ফেসবুকের কোনও মিম নিয়ে বাড়ির বড়রা সেই শিশুর সামনেই আলোচনা করেন। তখন বয়সের বেড়া ভেঙে ‘বড়দের’ সেই আলোচনা চলে আসে শিশুদের জগতেও। কিছু না বুঝে তারাও তখন সে বিষয়ে আলোচনা করতে থাকে। এমনকি, বড়দের সেই আলোচনাই খেলার বিষয় হয়ে যায় তাদের।

সম্প্রতি যেমনটা হয়েছে এই শহরেরই এক বেসরকারি স্কুলে। শিশুরা নিজেদের মধ্যে খেলার ছলে নাটক করতে তিনটি চরিত্র সেজেছিল। সেই তিন জন এই মুহূর্তে এ শহরে সব চেয়ে বেশি আলোচিত তিনটি নাম— প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, তাঁর স্ত্রী রত্না ও শোভনের ‘বন্ধু’ বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। স্কুলের এক শিক্ষিকার চোখে পড়ায় তিনি তখন কোনও ভাবে ওই শিশুদের আটকান। বোঝান। কিন্তু ওই শিশুদের সঙ্গে কথা বলে তিনি বুঝতে পারেন, বাড়ির বড়রাই তাদের সামনে ক্রমাগত বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাই তাদের খেলাতেও সেই আলোচনাই চরিত্র হয়ে ফুটে উঠেছে!

Advertisement

আরও পড়ুন: ক্ষমতা এবং কেচ্ছা, দারুণ দুই পদ যদি পড়ে এক প্লেটে

এটা একেবারেই অস্বাভাবিক কিছু নয়, জানাচ্ছেন মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম। তাঁর কথায়, ‘‘বড়রা যা আলোচনা করেন, যা টেলিভিশনে দেখানো হয়, শিশুরাও সেটা নিয়েই কথা বলতে চায়। বাড়িতে যদি সারা ক্ষণ কেচ্ছা নিয়ে আলোচনা হয়, তা হলে তার প্রভাব বাড়ির ছোটদের উপরে পড়বেই।’’
অস্বাভাবিক যে নয়, তা এক বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষাও দেখাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থার তরফে শিশুদের উপরে সেলিব্রিটিদের প্রভাব নিয়ে একটি সমীক্ষা করা হয়েছিল। ওই সমীক্ষায় সেলিব্রিটিদের প্রভাবে অল্পবয়সিদের মূল্যবোধের বদল, ভাব-ভঙ্গি ও শরীরী ভাষা নকল-সহ একাধিক বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে উত্তরদাতাদের ৩৭.৫ শতাংশ মনে করেছিল, খারাপ প্রভাবই বেশি। ৫০ শতাংশ উত্তরদাতা এ-ও মনে করেছিল, সেলিব্রিটিদের প্রভাবে ভাব-ভঙ্গির ক্ষেত্রে খারাপ প্রভাব পড়ে।
আর যদি তারা শিশু হয়, তা হলে সেই প্রবণতা আরও ক্ষতিকর হয়, সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান নীলাঞ্জনা সান্যাল মনে করেন, যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে কী হল, তা নিয়ে সার্বিক ভাবেই একটা কৌতূহল থাকে। তা নিয়ে সরাসরি শিশুদের যে খুব কৌতূহল থাকে, তা নয়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বাড়ির বড়রা যদি ক্রমাগত আলোচনা করতে থাকেন শিশুদের সামনে, তাতেই প্রভাবিত হয় তারা।

নীলাঞ্জনার কথায়, ‘‘বাবা-মায়ের প্রশ্রয়ে ও আশ্রয়ে অল্পবয়সিরা যে স্থিরতা খোঁজে, সেখান থেকে পড়ে যাওয়ার ভয়টাও তাদের মধ্যে কাজ করে। তাই এ ধরনের ঘটনায় আইডেন্টিফিকেশন প্রসেসটাও গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে সে কারণেও বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করে।’’
কারণ যা-ই হোক না কেন, এটা নিয়ে আলোচনা হবেই বলে মনে করেন শোভন-পুত্র সপ্তর্ষি চট্টোপাধ্যায়। বিষয়টি তাঁর কাছে যথেষ্ট অস্বস্তিকর ও যন্ত্রণাদায়ক হওয়া সত্ত্বেও সপ্তর্ষি বললেন, ‘‘আসলে শাখরুখ খানই হোন বা শোভন চট্টোপাধ্যায়, কারও জীবনে কোনও স্ক্যান্ডাল হলে তার তো খারাপ প্রভাব থাকবেই। বাবা আজ যা করছে, তা নিয়ে সকলে, এমনকি ছোটরাও যে আলোচনা করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কী ভাবে কেউ তা গ্রহণ করবেন, তা নির্ভর করে তাঁর শিক্ষার উপরে। বড় হয়ে ওঠার উপরে।’’

আরও পড়ুন: এলাকার হাঁড়ির খবর জানাতে গুগলের নয়া অ্যাপ

তবে সব অল্পবয়সি কিন্তু কেচ্ছাকে সমান ভাবে গ্রহণ করছে না। কারণ, এখনকার প্রজন্ম অনেক খোলামেলা। ফলে কৌতূহল দমনের চ্যালেঞ্জ তাদের নিতে হয় না, যা আগের প্রজন্মকে নিতে হত। এমনটাই মনে করেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ কুণ্ডু। তাঁর কথায়, ‘‘তাদের হাতের কাছে এখন জানার এত মাধ্যম রয়েছে যে, সব কিছুই সহজে জেনে ফেলা যায়। তবে অল্পবয়সিরা কিন্তু একটা বিতৃষ্ণা নিয়েই এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন