Lifestyle News

কাটোয়া খাই খাই লোকাল

মাংস ম্যারিনেট করেন অনেকে। তা বলে ‘পান্তুয়া’ বানাতে গেলে যে ছানাকেও ম্যারিনেট করতে হয় তা বোধহয় অনেকে মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক জানেন না। দু’ঘণ্টা ধরে ম্যারিনেট করা ছানার তৈরি অনন্য স্বাদের ওই মিষ্টির নাম ‘খাস পান্তুয়া’।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৬ ১০:০৮
Share:

মাংস ম্যারিনেট করেন অনেকে। তা বলে ‘পান্তুয়া’ বানাতে গেলে যে ছানাকেও ম্যারিনেট করতে হয় তা বোধহয় অনেকে মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক জানেন না। দু’ঘণ্টা ধরে ম্যারিনেট করা ছানার তৈরি অনন্য স্বাদের ওই মিষ্টির নাম ‘খাস পান্তুয়া’। পূর্ব-রেলের ব্যান্ডেল-কাটোয়া শাখার লোকাল ট্রেনের ‘ট্রেডমার্ক’ মিষ্টি। পাঁচ টাকায় প্রমাণ আকারের অমন সুস্বাদু, রসে ভরা, মোলায়েম, টাটকা পান্তুয়া আর কোথাও মিলবে না।

Advertisement

শালপাতায় সযত্নে মোড়া কাঁচাগোল্লা, কালাকাঁদ, ক্ষীরমোহন— ব্যান্ডেল-কাটোয়া শাখার রেলপথে থরে-থরে আরও নানা মিষ্টি। চা-কফি-কেক, ঝালমুড়ি কিংবা ডিম সেদ্ধ, কলা কমবেশি সব ট্রেনে ওঠে। কিন্তু এত ধরনের মিষ্টি আর নোনতা, ঝাল মুখোরোচকে তার যোগ্য সঙ্গত, আর কোনও রেলপথে নেই।

পূর্ব রেলের হাওড়া ডিভিশনের গুরুত্বপূর্ণ শাখা ব্যান্ডেল-কাটোয়া রেলপথ। কলকাতা থেকে সবচেয়ে কম সময়ে উত্তরবঙ্গ এবং অসম যাওয়া যায় এই পথে। হাওড়া থেকে মেনলাইন ধরে ব্যান্ডেল হয়ে কাটোয়া পৌঁছতে হয়। দূরত্ব ১৪৪ কিমি প্রায়। ব্যান্ডেলে মেন লাইন থেকে একটি লুপ লাইন বের হয়েছে যেটি ব্যান্ডেল-কাটোয়া শাখা নামে পরিচিত। কাটোয়া থেকে ব্যান্ডেলের দূরত্ব ১০৪ কিমি। রয়েছে ২৮টি স্টেশন। সারা দিনে আঠেরো জোড়া লোকাল ট্রেন এবং ডজন খানেক দূরপাল্লার ট্রেন চলাচল করে। কাটোয়া, দাঁইহাট, অগ্রদ্বীপ, নবদ্বীপ, সমুদ্রগড়, কালনা, গুপ্তিপাড়া, জিরাট, ত্রিবেণীর মতো গুরুত্বপূর্ণ জনবসতির মানুষের কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান পথ এটি। সকাল-সন্ধ্যায় ভিড়ে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে হাজার হাজার নিত্যযাত্রী এই পথে অফিস-কাছারি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং চিকিৎসার প্রয়োজনে যাতায়াত করেন। তাছাড়া চৈতন্য জন্মস্থান নবদ্বীপ, মায়াপুরের ইস্কন মন্দির, বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী, সবুজদ্বীপ, গুপ্তিপাড়ার রথ, অম্বিকাকালনা বা অগ্রদ্বীপের গোপীনাথের মেলায় যাওয়ার প্রধান রাস্তা এই রেলপথ।

Advertisement

নিত্যযাত্রীরা মজা করে বলেন, এই রুটের লোকাল ট্রেনে চাইলে বিয়েও সেরে ফেলা যায়। কেবল বেনারসী আর টোপরটাই যা মিলবে না। তাঁতের শাড়ি থেকে চাদর, গামছা, বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম —রকমারি জিনিসপত্র বিক্রি হয়। তার মধ্যে খাবার-দাবারেই কাটোয়া লাইনের নাম বেশি। চা থেকে চপ-মুড়ি, হাতে গড়া রুটি থেকে রসমালাই, আমপানার সরবত থেকে পরোটা, ছোলা সিদ্ধ থেকে চিঁড়ে ভাজা, গজা থেকে মালাপোয়া —কী পাওয়া যায় না এই রুটের লোকাল ট্রেনে।

সওয়ার হলেই মালুম হবে বিলক্ষণ।

যেমন এই সেদিন সকাল ৮টা ২০-র ভিড়ে ঠাসা হাওড়াগামী কাটোয়া লোকাল নবদ্বীপ ধাম স্টেশনে থামতেই ঠেলেঠুলে ট্রেনে উঠলেন বছর ষাটেকের মানুষটি। মাথায় চাপানো প্রকাণ্ড এক অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি। বাঁ দিকের কাঁধ থেকে ঝুলছে বিরাট এক জলের পাত্র। তিনি কামরাতে ঢুকতে না ঢুকতেই নানা দিক থেকে হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল—‘সুবলদা দশটা খাস’, ‘পাঁচটা কলা’। এরই মধ্যে জনাদু’য়েক স্টিলের টিফিন কৌটো দাদার হাতে ধরিয়ে চারটে করে পুরি অর্ডার দিয়ে গেলেন। বোঝা গেল ক্রেতারা নিত্যযাত্রী।

ট্রেন চলতে শুরু করতেই সুবলদা, মানে সুবল মণ্ডল ধীরেসুস্থে কামরার মেঝেতে ডেকচি নামিয়ে তার ঢাকনা খুলে দিলেন। কামরা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল জিভে জল আনা সুগন্ধ। দেখা গেল ডেকচির একেবারে উপরে রয়েছে এক ঝুড়ি সোনা রঙের ডালপুরি। হিং দেওয়া আলু-মটরের তরকারি থেকে তখনও ধোঁয়া উঠছে। সেই গন্ধেই কামরা ম ম। ভোর সাড়ে পাঁচটা-ছ’টায় বাড়ি থেকে ট্রেন ধরতে বেরিয়ে পড়া যাত্রীদের ভিড়ে মুহূর্তে ঘেরাও হয়ে গেলেন সুবলদা। গাড়ি পরের স্টেশন সমুদ্রগড় ছাড়ার আগেই ডাউন কাটোয়া লোকালের চার নম্বর কম্পার্টমেন্ট জুড়ে হাতে-হাতে শুধু ডালপুরির ঠোঙা।

ডালপুরির নীচে সুবলদার ওই প্রকাণ্ড ডেকচিতে রয়েছে রসগোল্লা, কালাকাঁদ, সন্দেশ আর পান্তুয়া। আকারে বেশ বড় মাপের সেই সব মিষ্টি স্বাদে-গন্ধে যে কোনও নামী দোকানকে গুণে গুণে গোল দেবে।

সুবলদার মতো মিষ্টি বিক্রি করেন আরও অনেকে। এই ট্রেনপথের কাঁচাগোল্লা আর ক্ষীরমোহনের যুগলবন্দির খ্যাতি গত পঞ্চাশ বছরে ছড়িয়ে পড়েছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা থেকে সুদূর অসম পর্যন্ত। খ্যাতি এতটাই যে, এই পথ দিয়ে অসমগামী কামরূপ এক্সপ্রেস কিংবা তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেস বা উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন দূরপাল্লার গাড়িতে রীতিমতো অর্ডার দেওয়া মিষ্টি যায় নিয়মিত। নবদ্বীপ, গুপ্তিপাড়া, সোমড়াবাজার এলাকায় এই ট্রেনপথের বিখ্যাত মিষ্টি তৈরির কারিগরেরা থাকেন। প্রায় ৪৫ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত নবদ্বীপের সুবল মণ্ডল এখন এই রুটের প্রবীণ মিষ্টির হকার। এছাড়াও কান পাতলেই শোনা যায়, সোমড়াবাজারের দুই ভাই ভোলা এবং খোকন সরকার, গুপ্তিপাড়ার চিত্ত ঘোষ, অমর ঘোষ, ব্যাঙা ঘোষ, কালী ঘোষ, খামারগাছির সুবল বিশ্বাস, নবদ্বীপের সন্তোষ অধিকারী, সুভাষ মণ্ডল প্রমুখদের নাম-ডাক। এঁদের অনেকেই এখন জীবিত নেই বা আর কাজ করতে পারেন না। তবুও তাঁদের তৈরি সিঙাড়া, নিমকি, কচুরি, ক্ষীরমোহন, রসগোল্লা, কাঁচাগোল্লার স্বাদ যাত্রীদের স্মৃতিতে বেঁচে রয়েছে।

এই রুটের পাঁচটি হকার ইউনিয়নের মিলিত সদস্য সংখ্যা আড়াই হাজারের উপর। তার মধ্যে মিষ্টি বিক্রেতার সংখ্যা একশোর উপর। প্রবীণ সুবলবাবু নিজে এখনও প্রতি দিন তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ কেজি মিষ্টি বিক্রি করেন। গড়ে হাজার তিনেক টাকার কেনাবেচা। তারপরেও তাঁর আক্ষেপ, ‘‘মিষ্টির বিক্রি কমছে। লোকের ঝোঁক বাড়ছে নোনতা খাবারের দিকে। টপাটপ পান্তুয়া মুখে চালান করার মতো দিলদরিয়া মেজাজ আজকের দিনে কম।’’

সুবলদা’র পান্তুয়ার রেসিপি দেখতে ক্লিক করুন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন