স্টেরয়েড-দুশমন

মুখ পুড়ছে ফর্সা হতে, স্টেরয়েড-শত্রু ঘরে ঘরে

মেয়েটির চাকরি ও ‘বয়ফ্রেন্ড-ভাগ্য’ খুলছে না কিছুতেই। বিজ্ঞাপনী-প্রচারে আঙুল তোলা হল তার ত্বকের কালো রঙের দিকে। চটজলদি দাওয়াই হিসেবে অতএব ভরসা রং ফর্সা করার ক্রিম। বহুল প্রচারিত এই সব ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপন আদতে ‘বর্ণবৈষম্যমূলক’ বলে ছি-ছিক্কার উঠেছিল দেশের নানা মহলে। খাস সংসদ পর্যন্ত তোলপাড় হয়েছিল।

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৫ ০২:৫৮
Share:

মেয়েটির চাকরি ও ‘বয়ফ্রেন্ড-ভাগ্য’ খুলছে না কিছুতেই। বিজ্ঞাপনী-প্রচারে আঙুল তোলা হল তার ত্বকের কালো রঙের দিকে। চটজলদি দাওয়াই হিসেবে অতএব ভরসা রং ফর্সা করার ক্রিম। বহুল প্রচারিত এই সব ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপন আদতে ‘বর্ণবৈষম্যমূলক’ বলে ছি-ছিক্কার উঠেছিল দেশের নানা মহলে। খাস সংসদ পর্যন্ত তোলপাড় হয়েছিল।

এ বার স্বাস্থ্যগত কারণেও ফর্সা হওয়ার বেশ কয়েকটি ক্রিমকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। গোটা দেশের ত্বক বিশেষজ্ঞেরা একমত, বিনা প্রেসক্রিপশনে স্টেরয়েড মেশানো বিপজ্জনক ক্রিম মুখে মেখেই ত্বকের জটিল, দুরারোগ্য অসুখ ডেকে আনছেন বিভিন্ন বয়সের রোগীরা।

কী ধরনের অসুখ? মুখ দগদগে পোড়া দাগে ভরে যাচ্ছে। কিংবা হরমোনের গোলমালে আচমকা দাড়ি-গোঁফ উঠছে মেয়েদের। স্টেরয়েড-নির্ভর রোগী রোদে বেরোলেই মুখের চামড়া ফেটে অসহ্য জ্বালায় জেরবার হচ্ছেন। মুখের এমন দশায় ঘোর অবসাদও অনিবার্য। স্টেরয়েডের লাগামছাড়া প্রয়োগে সার্বিক প্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে। সেই সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যও ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে মানছেন ডাক্তাররাই। যা পরিস্থিতি টাস্ক ফোর্স গড়ে কার্যত সামাজিক আন্দোলনের ডাক দিচ্ছেন দেশের ত্বক বিশেষজ্ঞেরা।

এর আগে ফর্সা হওয়ার কৌলীন্য নিয়ে চিরকেলে সংস্কারে ঘা মারতে ‘স্টে আনফেয়ার স্টে বিউটিফুল’ নামে একটি প্রচার চালানো হয়েছিল। তাতে সামিল হন অভিনেত্রী-সমাজকর্মী নন্দিতা দাস। তবে তা ছিল ব্যতিক্রম। ফর্সা হওয়ার বিভিন্ন ক্রিমের বিপণনে বরাবর বলিউডি তারকাদের মুখের জয়জয়কার। ফর্সা হওয়ার লোভে ত্বকে স্টেরয়েড ক্রিম প্রয়োগের প্রবণতা ঠেকাতে নামজাদা তারকাদেরই সঙ্গে রাখছেন ত্বক বিশেষজ্ঞেরা। কেন?

“ইদানীং বিভিন্ন বিউটি ক্লিনিকের পরামর্শেও ফর্সা হতে অনেকে মুখে স্টেরয়েড ক্রিম মাখছেন। বাচ্চা ছেলেকে এমন ক্রিম মাখাতে গিয়েও মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে” বলছিলেন টাস্ক ফোর্সের সভাপতি তথা ত্বক বিশেষজ্ঞ কৌশিক লাহিড়ী। তাঁর মতে, “ফর্সা হওয়ার বাতিক দূর করতে গ্ল্যামার জগতের ভিতর থেকে বার্তা আসাটাও জরুরি।”

ত্বক বিশেষজ্ঞদের প্রচারের ‘মুখ’ দিয়া মির্জা নিজেও স্বীকার করছেন, “কম বয়সে ফর্সা হওয়ার কিছু পণ্যের প্রচার করে ভুল করেছি।” ফর্সা হওয়ার চেষ্টায় তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এক স্পটবয়কেও ত্বকের জটিল অসুখ ও মানসিক অবসাদে ভুগতে দেখেছেন তিনি। দিয়াকে সামনে রেখে ত্বক বিশেষজ্ঞদের প্রচারের ক্যাচ-লাইন ‘ট্রিট ইওর স্কিন রাইট’!

ডাক্তারদের দাবি, দেশ জুড়ে নিজের ত্বকের প্রতি সঠিক ব্যবহারের খামতি মালুম হচ্ছে পদে পদেই। মহিলা, পুরুষ কেউই কম যান না। গালে ব্রণ, দাদ, মেচেতার কালচে ছোপ, খুসকির মতো খোসা ওঠার সমস্যায় অনেকেই ডাক্তার দেখানোর তোয়াক্কা না-করে লোকমুখে শুনেই স্টেরয়েড মেশানো ক্রিমের শরণাপন্ন হচ্ছেন। হাতুড়ে ডাক্তার, আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথির চিকিৎসক বা বিউটিশিয়ানদের কথাতেও অনেকে স্টেরয়েড মাখছেন। তাতে কিছু ক্ষেত্রে আপাত সুফল মেলে। কিন্তু ত্বক স্টেরয়েডের নেশার কবলে পড়ে। ক্রিম ব্যবহার বন্ধ করলে সমস্যা আরও ব্যাপক ভাবে ফিরে আসে। ত্বক বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় ঘোষের কথায়, “শ্বেতি, এগজিমায় স্টেরয়েড মেশানো ক্রিম কিন্তু কাজে আসে। তবে তা মুখে মাখা ঠিক নয়। সবিস্তার না-বুঝিয়ে রোগীকে এ সব মাখতে বললে মারাত্মক বিপদ হবে।”

সমস্যাটা শুধু কলকাতার নয়। মুম্বইয়ের দীপক পারিখ, দিল্লির রশ্মি সরকার, বেঙ্গালুরুর মাইসোর বেঙ্কটরামদের মতো অনেকেরই অভিজ্ঞতা, রোজ চেম্বারে গড়ে দশ জনের মধ্যে জনা চারেক তরুণ রোগীই মুখে কোনও না কোনও স্টেরয়েড মাখার খেসারত দিচ্ছেন। কয়েক বছর আগে ত্বকবিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সর্বভারতীয় সংস্থা (আইএডিভিএল)-র সমীক্ষাতেই সমস্যাটা স্পষ্ট। কলকাতা, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, পুণে, বডোদরা-সহ ১২টি বড়-মেজ শহরে বাছাই-করা সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের বহির্বিভাগে সমীক্ষা চালানো হয়। মুখে ত্বকের নানা সমস্যায় ভুগছেন, এমন রোগীদের ১৫ শতাংশই ইচ্ছে মতো স্টেরয়েড মেশানো ক্রিম মাখছিলেন। এই ভুক্তভোগীদের ৩৬ শতাংশই আবার ২১-৩০ বছরের তরুণ-তরুণী।

আইএডিভিএল-এর তরফে গত এক বছরে একাধিক বার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তা ও ওষুধ-সংক্রান্ত নিয়ামক সংস্থা ড্রাগ কন্ট্রোল-এর অধিকর্তার কাছে দরবার করা হয়েছে। তাতে আশ্বাস মিললেও কাজের কাজ হয়নি। ত্বকে মাখার স্টেরয়েড মেশানো ক্রিম এমনিতে শিডিউল এইচ-তালিকাভুক্ত। অর্থাৎ, বিনা প্রেসক্রিপশনে তা ক্রেতার হাতে যাওয়ার কথা নয়। সে-নিয়ম নেহাত কাগজে-কলমে। কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্রোলের এক শীর্ষকর্তার অভিমত, “ওষুধ বিক্রি-সংক্রান্ত আইন রূপায়ণ রাজ্যকেই করতে হবে।” আর রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোল অধিকর্তা চিন্তামণি সরকারের কথায়, “বিষয়টা খোঁজ নিয়ে দেখব।” তবে সংশ্লিষ্ট দফতরের এক কর্তার দাবি, “আইন থাকলেও তা প্রয়োগ করার মতো লোক কই? রাজ্যে ড্রাগ কন্ট্রোলের ইনস্পেক্টর স্তরের ১৪০টা পদের অর্ধেকের বেশিই ফাঁকা।”

অতএব অবাধে বাড়ছে স্টেরয়েড ক্রিমের পসার। সরাসরি ফর্সা হওয়ার ক্রিম না-বলেও যাদের ব্র্যান্ডনেমেই স্পষ্ট ‘ফর্সা’ করার টোপ। ওষুধের দোকানে সুলভ কোনও কোনও ক্রিম আবার ‘হবু কনে’ বা তরুণীদের টার্গেট করছে। ত্বকে স্টেরয়েড সংক্রমণ নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার শরিক তথা ডাক্তারদের টাস্কফোর্সের সদস্য অরিজিৎ কুণ্ডুর কথায়, “সিগারেটের প্যাকেটের মতো স্টেরয়েড মেশানো ক্রিমের গায়েও সতর্র্কীকরণ লেখা উচিত।” বিউটি ক্লিনিক, হাতুড়ে ডাক্তার, ওষুধ বিক্রেতা-সহ সর্বস্তরে প্রচার চালিয়ে স্টেরয়েড ক্রিমের অপব্যবহার নিয়ে চোখ খুলতে চাইছেন ডাক্তারেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন