গৌতম দেবের খবর নিতে সল্টলেকের হাসপাতালে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: শৌভিক দে।
সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সিপিএম নেতা গৌতম দেব। আশঙ্কাজনক অবস্থায় সল্টলেকের বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন তিনি। ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে তাঁকে। কয়েক দিন ধরেই জ্বর এবং সর্দি-কশিতে ভুগছেন গৌতমবাবু। মঙ্গলবার পরিস্থিতি জটিল হওয়ায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
হাসপাতাল সূত্রের খবর, গৌতমবাবুর শারীরিক অবস্থা সঙ্কটজনক হলেও স্থিতিশীল। চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর জ্বর এ দিন অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। বুকে জমে থাকা কফ কিছুতেই না বেরোনোয় শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ভেন্টিলেশনে রাখার পর ধীরে ধীরে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তাঁর চিকিৎসার জন্য একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। প্রতিদিন দুপুর ১২টায় ওই বোর্ড বসবে।
কিছু দিন আগে তিরুঅনন্তপুরমে স্নায়ুর জটিল অস্ত্রোপচার করিয়ে এসেছেন গৌতমবাবু। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পরেই তাঁর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তা-ও গত সপ্তাহে সিপিএমের পাঁচ দিন-ব্যাপী রাজ্য সম্মেলনে নিয়মিত উপস্থিত হয়েছেন গৌতমবাবু। বস্তুত, ওই সম্মেলন শেষ হওয়ার পরেই সর্দি-জ্বরে কাবু হয়ে পড়েন। তাঁর পরিবার সূত্রের খবর, প্রথমে তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন ঠান্ডা-গরমেই এই অসুস্থতা। কিন্তু ক্রমে পরিস্থিতি জটিল হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় তাঁকে। মঙ্গলবার রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় হাসপাতালে গিয়ে গৌতমবাবুর খবর নেন। হাসপাতালে যান বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু ও সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র।
রাজ্যে এ দিন আরও ১৭ জনের দেহে সোয়াইন ফ্লু-র জীবাণু মিলেছে। ফলে সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৩৪০। স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে জানিয়েছেন, সোমবার কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে এক মহিলার মৃত্যু হয়। মৃতের সংখ্যা মোট ২২। রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ৬৬ জন চিকিৎসাধীন।
এই পরিস্থিতি সত্ত্বেও সোয়াইন ফ্লু প্রতিরোধে প্রচার বা পরিকাঠামো গড়ে তোলার পথে হাঁটছে না রাজ্য সরকার। যেটুকু প্রচার চলছে, তা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের উদ্যোগে। অল্পবিস্তর প্রচার চালাচ্ছে কলকাতা পুরসভাও। কিন্তু রাজ্য সরকারের যুক্তি, সোয়াইন ফ্লু নিয়ে জোর প্রচারে নামলে ‘আতঙ্ক ছড়াবে’। রাজ্যের স্বাস্থ্য কর্তারা কী করছেন? তাঁরা তাকিয়ে রয়েছেন তাপমাত্রা কবে বাড়বে, সেই দিকে!
অন্যান্য বছর গরম বাড়লে ডায়েরিয়া-সহ আরও কিছু রোগের প্রকোপ বাড়ে। তাই জেলায় জেলায় ওআরএস সরবরাহ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে প্রচারে জোর দেওয়া হয়। কিন্তু এ বার মার্চের অর্ধেক পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তাপমাত্রা সে ভাবে বাড়েনি। সবেমাত্র গত ক’দিন ধরে একটু-আধটু গরম বোধ হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন রোগ-জীবাণুর সক্রিয়তা এখনও কমেনি। আর সেই সুযোগে সোয়াইন ফ্লু-র মতো রোগ বেড়ে চলেছে। স্বাস্থ্য দফতরের এক উচ্চপদস্থ কর্তার কথায়, “কোনও দিন আক্রান্তের সংখ্যা কম থাকছে। আবার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অনেক বেড়ে যাচ্ছে। ফলে তাপমাত্রা বাড়লে দক্ষিণবঙ্গে রোগের প্রকোপ কমবে, কারও মনে এমন আশা থাকলেও তা এখনই প্রকাশ করা সমীচীন নয়।”
রাজ্য সরকারের তরফে সচেতনতা প্রচার না হলেও পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, জনবহুল এলাকায় সোয়াইন ফ্লু-র জীবাণু দ্রুত ছড়ায়। বাতাসের সঙ্গে, কিংবা আক্রান্তের কফ-থুতুর সঙ্গে মিশে এই রোগের ভাইরাস অন্যের শরীরে ঢোকে। তাই সর্দি-কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট বা গলাব্যথার উপসর্গ থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বাজার বা স্কুল-কলেজের মতো জনবহুল জায়গায় না যাওয়াই উচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, খুব বেশি জ্বর না থাকলেও নিশ্চিন্ত হওয়ার কিছু নেই। বরং গা ম্যাজম্যাজে ভাব, সর্দি-কাশিতেও সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।
সোয়াইন ফ্লু-র বিভিন্ন উপসর্গ সম্পর্কে চিকিৎসকদের অবশ্য ওয়াকিবহাল থাকতে বলছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। কারণ, জ্বর, কাশি-শ্বাসকষ্ট, গা-হাত-পায়ে ব্যথার পাশাপাশি এই রোগের কিছু নতুন উপসর্গ ইদানীং দেখা দিয়েছে। যেমন গোটা শরীরে র্যাশ বেরোনো, নাক-মুখ থেকে রক্ত বেরোনো। হাসপাতালগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কোনও ব্যক্তির এই ধরনের উপসর্গ দেখলে তাঁকে যেন ফিরিয়ে না দিয়ে ভর্তি করে নেওয়া হয়। কারণ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, হাসপাতালে ভর্তি করে থুতুর নমুনা পরীক্ষার পর রোগীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ থুতুর নমুনা পরীক্ষা করে সোয়াইন ফ্লু-জীবাণু মিলেছে।
বস্তুত, তেমনই একটি ঘটনা ঘটেছে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। শিলিগুড়ির ভক্তিনগর এলাকার বছর চারেকের একটি শিশুকন্যাকে শনিবার সোয়াইন ফ্লু-র উপসর্গ-সহ ভর্তি করা হয়েছিল। থুতুর নমুনা সংগ্রহের পরেই শিশুটির পরিবার নিজেদের দায়িত্বে তাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যায়। এ দিকে, সোমবার রিপোর্ট আসার পরে জানা যায়, সে সোয়াইন ফ্লু আক্রান্ত। কেন শিশুটিকে আগেভাগে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হল, তা নিয়ে ক্ষোভ জানান স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী। তাঁর নির্দেশে মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের তরফে শিশুটির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পরিবারের লোকেরা এ দিন সকালে শিশুটিকে নিয়ে হাসপাতালে এলেও প্রথমে তাকে ভর্তি করাতে রাজি হননি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে শিশুটির বাবাকে দীর্ঘক্ষণ বোঝানো হয়। ওষুধের কোর্স চালু এবং তা সম্পূর্ণ করাতে অনুরোধ করা হয়। অবশেষে সন্ধ্যায় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালেই শিশুটিকে ফের ভর্তি করা হয়েছে।