অনেকেই গ্যাসের ব্যথার সঙ্গে বুকের ব্যথা গুলিয়ে ফেলেন

আচমকা বুকে ব্যথা কি গ্যাস থেকে না হার্ট অ্যাটাকের লক্ষ্মণ? কী করণীয়? কখন অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি প্রয়োজন, কখনই বা বাইপাস সার্জারি? কার্ডিয়াক সার্জন সত্যজিৎ বসুর মুখোমুখি রুমি গঙ্গোপাধ্যায়।আচমকা বুকে ব্যথা কি গ্যাস থেকে না হার্ট অ্যাটাকের লক্ষ্মণ? কী করণীয়? কখন অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি প্রয়োজন, কখনই বা বাইপাস সার্জারি? কার্ডিয়াক সার্জন সত্যজিৎ বসুর মুখোমুখি রুমি গঙ্গোপাধ্যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৪ ১৬:১৮
Share:

প্রশ্ন: বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ হার্টের সমস্যা। এমনটা আজকাল প্রায়ই দেখা যায়। কী করব?

Advertisement

উত্তর: ব্যাপারটা যেহেতু হার্টের, তাই আগে থেকে সতর্ক হতে হবে। বুকে ব্যথা হলে সঙ্গে সঙ্গেই কার্ডিয়োলজিস্টের পরামর্শ নিতে হবে।

Advertisement

প্রশ্ন: অম্বল-গ্যাসের জন্যও তো বুকে ব্যথা হয়। হার্টের সমস্যার জন্যই যে ব্যথা হচ্ছে, বুঝব কী করে?

উত্তর: ব্যথার ধরনটা বুঝতে হবে। হার্টের সমস্যা হলে একদম বুকের মাঝখানে চাপ ধরা ব্যথা হবে। মনে হবে বুকের মধ্যে কিছু চেপে বসে আছে। ব্যথাটা চোয়াল, ঘাড় বা পিঠের দিকে যেতে পারে। একে বলে অ্যানজাইনাল পেন। এই ব্যথা অন্তত মিনিট কুড়ি থাকবে। তার সঙ্গে প্রচন্ড ঘাম হবে। শ্বাসকষ্ট হতে পারে। মুখটা ফ্যাকাশে বা কালচে হয়ে যেতে পারে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসবে। এই রকম উপসর্গ হলে বুঝতে হবে ব্যাপারটা হার্ট অ্যাটাকের দিকে গড়াচ্ছে।

প্রশ্ন: সেই অবস্থায় কী করব?

উত্তর: সেই মুহূর্তে চারটে ডিসপ্রিন ট্যাবলেট জলে গুলে বা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে হবে। এতে হার্ট অ্যাটাক থেকে মৃত্যুর আশঙ্কা ৪০-৫০% কমে যাবে। জিভের তলায় একটা সরবিট্রেট দিয়ে কাছাকাছি এমন কোনও হাসপাতালে নিয়ে যান রোগীকে, যেখানে ২৪ ঘণ্টা ক্যাথল্যাব খোলা থাকে ও কনসালট্যান্ট ডাক্তার অন কল থাকেন। এমন যেন না হয়, ক্যাথল্যাব আছে, অথচ ডাক্তার নেই। বাড়িতে ডাক্তার ডেকে বা অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য সময় নষ্ট করবেন না। ট্যাক্সি, গাড়ি যা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে করেই হাসপাতালে পৌঁছনোর চেষ্টা করুন।

প্রশ্ন: সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ?

উত্তর: হ্যা। হার্ট অ্যাটাক হলে ২-৩ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে ঢুকতে পারলে, তখন তখন ব্লকটা খুলে দেওয়া হয়। রোগী ভাল হয়ে যান।

প্রশ্ন: শুনেছি ডায়াবেটিস থাকলে নাকি এ ধরনের বুকে ব্যথা টের পাওয়া যায় না?

উত্তর: হ্যা। ডায়াবেটিকরা অ্যানজাইনাল পেন বুঝতে পারেন না। যে নার্ভটা মস্তিষ্ক থেকে এই ধরনের ব্যথার অনুভূতি বহন করে, ডায়াবেটিকদের ক্ষেত্রে সেই নার্ভটা কাজ করে না। তবে আজকাল নন ডায়াবেটিকরাও অনেক সময় অ্যানজাইনাল পেন টের পান না। ব্যথাটাকে গ্যাসের ব্যথার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। এমনকী, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছাড়া অন্য ডাক্তারও অনেক সময় ব্যাপারটা ধরতে পারেন না।

প্রশ্ন: ডাক্তারাও ধরতে পারেন না?

উত্তর: আসলে ওপর পেটে ব্যথা হয়। রোগীদের মনে হয়, পেটের মধ্যে গ্যাস জমে আছে। অস্বস্তি, হাঁসফাঁস অবস্থা। বিশেষ করে ভারী খাবার খাওয়ার পর অস্বস্তি বাড়ে। সমস্যাটা হার্টের কি না তা একমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই ধরতে পারবেন। অনেক সময় স্থানীয় ডাক্তাররাও একে গ্যাসের ব্যথা ভেবে নিয়ে সেই ধরনের ওষুধ দিয়ে দেন। তাতে সাময়িক স্বস্তি হয়তো মেলে। কিন্তু হার্টের সমস্যা হলে পরে তা বড় আকারের বিপদ ডেকে আনে। আসলে ৮০% ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যা হার্টের জন্য না হলেও ২০% ক্ষেত্রে সেটা হার্টের।

প্রশ্ন: কার্ডিয়োলজিস্ট যে সব সময় মিলবে, তা তো নয়।

উত্তর: সে ক্ষেত্রে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চলে যাবেন। যে করেই হোক কার্ডিয়োলজিস্ট দেখাতেই হবে। মাঝরাত হলেও।

প্রশ্ন: এর লক্ষণ কি শুধু পেটব্যথা আর অস্বস্তি?

উত্তর: হ্যাঁ। তবে তার সঙ্গে হয়তো দেখা গেল পাল্সটা খুব দ্রুত চলছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। গ্যাসের ওষুধ খেয়েও উপশম হচ্ছে না, একটু স্বস্তি দিয়ে আবার ফিরে আসছে। ৪০-এর ঊর্ধ্ব বয়স, এ রকম কারও এ ধরনের উপসর্গ হলে ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। আসলে রক্তনালীর মধ্যে কোলেস্টেরল জমতে জমতে সেটা ঢিবির মতো হতে শুরু করে। সমস্যাটা ধরা পড়লে আগেভাগেই ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

প্রশ্ন: হার্টের সমস্যা কি না ধরা পড়বে কী করে?

উত্তর: ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম ও ট্রপটি-টি পরীক্ষা করলেই হার্টের সমস্যা কি না ধরা পড়ে যাবে।

প্রশ্ন: কিন্তু কোন হাসপাতালে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার পাব, সেটাও তো মাঝে মাঝে চিন্তায় ফেলে দেয়।

উত্তর: সমস্যা থাকুক আর না থাকুক, খোঁজ নিয়ে জেনে নিন, আপনার বাড়ির আশপাশে কোন হাসপাতালে গেলে সঙ্গে সঙ্গে পরিষেবার ব্যবস্থা আছে। আগে থেকেই জানা থাকলে দরকারের সময় হাতড়াতে হবে না।

প্রশ্ন: হার্ট অ্যাটাক হলে তার চিকিৎসা কী?

উত্তর: দুম করে রক্তনালীর ভেতরের কোনও জায়গায় ব্লক তৈরি হয়ে যদি রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় তবে সেটা হার্ট অ্যাটাক। সে ক্ষেত্রে প্রাইমারি অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি (বেলুন) করে ব্লক খুলে স্টেন্ট বসিয়ে দেওয়া হয়।

প্রশ্ন: অনেক সময় শুনি দরকার না থাকলেও স্টেন্ট বসিয়ে দেওয়া হয়? সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।

উত্তর: ব্যাপারটা একটু খুলে বলি। হার্টের তিনটে প্রধান ধমনী থাকে। এগুলিতে সমস্যা হলে তাকে বলে থ্রি ভেসেলস ডিজিস। এগুলির মধ্যে এলএডি আর্টারিটি (বাম দিকের) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হার্টের ৬০-৭০% রক্ত এটিই সরবরাহ করে। যদি দেখা যায় কারও এই আর্টারিগুলোতে ব্লক হয়ে হার্টে রক্ত চলাচল আটকে গিয়েছে, সেই মুহূর্তে অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি করলে রোগী ভাল হয়ে যান। একে বলে প্রাইমারি অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি।

প্রশ্ন: তার মানে শুধুমাত্র আচমকা হার্ট অ্যাটাক হলে অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি করতে হয়?

উত্তর: হ্যা। তবে কখনও কখনও নন-আর্জেন্ট অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টিরও দরকার হয়। এলএডি আর্টারি যেখান থেকে শুরু হচ্ছে, সেই জায়গায় বা ডান দিকের করোনারি আর্টারিতে ব্লক তৈরি হতে থাকলে অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি করে দেওয়া হয়। আসলে এই ধরনের ব্লক হলে, স্বাভাবিক জীবনযাপনে সমস্যা হয়। তাঁরা একটুতেই হাঁপিয়ে পড়েন। যেগুলি বললাম, সেগুলো ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি কতখানি কাজ করে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

প্রশ্ন: আর বাইপাস সার্জারি কখন?

উত্তর: যদি ট্রিপল ভেসলস ডিজিস হয় অর্থাৎ তিনটি আর্টারিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পাশাপাশি, হার্টের ইজাকশন ফ্রাকশন অর্থাৎ পাম্প করার ক্ষমতা যদি কমে যায়, তখন বাইপাস করতে হবে। কম বয়সে হার্টের সমস্যা হলেও কখনও কখনও বাইপাস করতে বলা হয়। ধরুন, রোগীর চলতে ফিরতে সমস্যা হচ্ছে, কাজ করতে পারছেন না, কেউ হয়তো এক ঘর থেকে অন্য ঘরে গেলেই হাঁপিয়ে উঠছেন বা সিঁড়ি ভাঙতে পারছেন না, সব মিলিয়ে রোজকার জীবনে সমস্যা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে যদি দেখা যায় সমস্যাটা ট্রিপল ভেসেলস ডিজিসের জন্য, তবে বাইপাস দরকার হয়। আর ডায়াবেটিকদের হার্টের সমস্যা থাকলে আগেভাগে বাইপাস করে নেওয়া দরকার। কারণ তাঁরা অ্যানজাইনাল পেন অনুভব করেন না।

প্রশ্ন: কম বয়সে বাইপাস করলে তো বছর পনেরো পরে আবার করতে হবে? যেমন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে করতে হল?

উত্তর: সেটা যাতে না করতে হয়, তার জন্য কমবয়সীদের ক্ষেত্রে লিমা রিমা ওয়াই নামের এক ধরনের বাইপাস করা হয়। এতে মোটামুটি ভাবে তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর পর্যন্ত আর কিছু করার দরকার হয় না। মানে ধরুন পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে কারও লিমা রিমা করা হল। সে ক্ষেত্রে তিনি আশি বছর পর্যন্ত ভাল থাকবেন। মানে এক বার করেই একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যাবে।

প্রশ্ন: অপারেশন না করে ওষুধ দিয়ে কাজ হয় না?

উত্তর: যে সব সমস্যার কথা বললাম, সেগুলির জন্য অপারেশন দরকার হয়। কিন্তু যদি দেখা যায় ট্রিপল ভেসেলস ডিজিস আছে, কিন্তু রোগীর হার্ট ভাল মতো পাম্প করতে পারছে, তবে ওষুধ আর জীবনযাপন পদ্ধতিতে খানিক বদল এনেই রোগী অনেক দিন সুস্থ থাকতে পারেন। অপারেশন দরকার হবে না।

প্রশ্ন: জীবনধারায় কেমন পরিবর্তন?

উত্তর: রোজ জোরে জোরে হাঁটতে হবে অন্তত চার কিমি, যাতে হার্টরেট বাড়ে। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসার থাকলে সেটা নিয়ন্ত্রণে রাখলেই রোগী অনেক দিন সুস্থ ভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন। ভাত, রুটি, আলুর মতো কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। রোজকার খাবারে তেলের পরিমাণ ১৫ থেকে ২০ মিলিলিটার হতে হবে। মাসে ৩-৪ দিন নিয়মের ব্যতিক্রম হলে অসুবিধে নেই। কিন্তু বাকি দিনগুলো এই ভাবেই চলতে হবে। আর ধূমপান একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে।

প্রশ্ন: আপনি তো মফস্সল আর কলকাতা, দুই জায়গাতেই কাজ করেন। হার্ট নিয়ে দুই জায়গায় সচেতনতা কেমন?

উত্তর: মানুষ এখন অনেক সচেতন ঠিকই, কিন্তু ধূমপান কমেছে না। দুর্গাপুরের মানুষও প্রচুর সিগারেট খান। তা ছাড়া কলকারখানার ধোঁয়া থেকেও ক্ষতি হয়। সিগারেট হার্টের সাঙ্ঘাতিক ক্ষতি করে। বিশেষ করে মেয়েদের। মেয়েদের চেহারা ছোট বলে আর্টারিও সরু হয়। খুব তাড়াতাড়ি সেগুলো ব্লক হয়ে যায়।

প্রশ্ন: কত দিন অন্তর হার্টের ডাক্তার দেখাতে হবে?

উ: সেটা রোগীর ওপর নির্ভর করে। সমস্যা না থাকলে বছরে এক বার। আর যদি দেখেন সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে কষ্ট হচ্ছে, একটুতেই হাঁপিয়ে পড়ছেন, তবে প্রয়োজন বুঝে নিয়মিত ডাক্তার দেখাতে হবে।

প্রশ্ন: হার্টের সমস্যা থাকলে হাতের কাছে কী কী রাখব?

উত্তর: চারটি ডিসপ্রিন, সরবিট্রেট।

প্রশ্ন: আর ব্লাড প্রেসার মাপার যন্ত্র?

উত্তর: হঠাৎ করে অ্যানজাইনাল পেন শুরু হলে প্রেসার মাপার যন্ত্র কাজ দেয় না। তখন মাথা কাজ করে না। তবে হাই প্রেসার থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত প্রেসার মাপা দরকার। আর পালস দেখা শিখে নেওয়া দরকার। স্বাভাবিক অবস্থায় পালস যে ভাবে চলে, হার্টের সমস্যা হলে সেটি দ্রুত চলতে থাকে।

প্রশ্ন: আর কিছু?

উত্তর: আমার মনে হয়, যে কোনও মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা যাই-ই হোক না কেন, দিনে দু’কাপ চা আর দুটো সিগারেট কম খেয়ে স্বাস্থ্যবীমা করিয়ে রাখা উচিত। ওটা দরকারের সময় খুব কাজ দেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন