ঠাকুরদার সঙ্গে মৃণাল। নিজস্ব চিত্র।
শরীরে ব্লাড ক্যানসার বাসা বেঁধেছে শোনার পরেই ৯ বছর বয়সী মৃণাল রায় এবং তার ঠাকুরদা নজিনবাবুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল। কী ভাবে মা হারা এই বালকের চিকিৎসা করাবেন, তা ভেবেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল দিনমজুর নজিনবাবু। তার উপরে স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে দ্বিতীয়বার বিয়ে করে মৃণালের বাবা এখন আলাদা থাকেন। ছেলে অথবা এই পরিবারের খোঁজ রাখেন না। তাই মৃণালের ভরসা নজিনবাবুই।
এই পরিস্থিতিতে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের একাংশের সহযোগিতায় ক্রমশই সুস্থ হয়ে উঠেছে ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত প্রত্যন্ত ময়নাগুড়ির কুমারপাড়ার বাসিন্দা ওই বালক। গত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয় মৃণালকে। ৬ মাস টানা চিকিৎসার পরে মৃণাল সুস্থ হয়ে উঠেছে বলে দাবি উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের শিশু বিভাগের প্রধান মৃদুলা চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি জানান, মৃণালের রক্তে এখন আর ক্যান্সারের কোষ নেই। কালীপুজোর আগের দিন মৃণালকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। তবে মাঝেমধ্যে এসে চিকিৎসককে দেখানো, প্রয়োজনীয় ওষুধ নেওয়া এবং নজরদারিতে থাকতে হবে বলে জানানো হয়েছে। সেই মতো গত মঙ্গলবার নজিনবাবুর সঙ্গে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে এসে রক্ত পরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে যায় মৃণাল। হাসপাতালে তার থাকার প্রয়োজন নেই বলেই চিকিৎসক জানিয়েছেন।
সরকারি হাসপাতালগুলিতে বেহাল চিকিৎসা পরিষেবা, অসহযোগিতা নিয়ে প্রায়ই নানা ধরনের অভিযোগ ওঠে। তার ব্যতিক্রম নয় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালও। সম্প্রতি এনসেফ্যালাইটিস পরিস্থিতি নিয়ে রোগীদের নানা ভাবে অসহযোগিতা, হেনস্থা হওয়ার অভিযোগ উঠছিল। সম্প্রতি পায়ে ঘা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে বলে অসুস্থ এক বৃদ্ধাকে ওয়ার্ডের বাইরে বের করে সিঁড়ির করিডরে ফেলে রাখার অভিযোগও উঠেছিল। তবে মৃণালের ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং চিকিৎসকদের এই সহযোগিতা যেন ব্যাতিক্রম। চিকিৎসক এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়ে কৃতজ্ঞ দরিদ্র পরিবারের ওই বালক এবং তার ঠাকুরদা।
শরীরে রক্তাল্পতা, জ্বর, গলার ‘গ্ল্যান্ড’ ফুলে যাওয়ায় প্রথমে মৃণালকে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতাল, পরে রেফার করা হয় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে। সেখানে পরীক্ষার পরে চিকিৎসকেরা নিশ্চিত হন মৃণালের ‘ব্লাড ক্যানসার’ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে। তৃতীয় শ্রেণিতে উঠলেও অসুস্থতার জেরে বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। নজিনবাবু বলেন, “চিকিৎসার খরচ কোথা থেকে জোগাড় করব তা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। তবে শিশু বিভাগের চিকিৎসক এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সাহায্য করায় নাতিকে বাঁচাতে পেরেছি। সকলের কাছেই আমরা কৃতজ্ঞ।”
চিকিৎসা করাতে লক্ষাধিক টাকা লাগবে জেনে প্রথমে অথৈ জলে পড়েছিলেন নজিনবাবু। গরু-ছাগল বিক্রি করে চিকিৎসা করাতে মনস্থির করেন। প্রথম দিকে জলপাইগুড়ি হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল কলেজে কিছু ওষুধপথ্য কিনে দিতে তার অন্তত ৩০ হাজার টাকা খরচও হয়েছে। এর পরে হাতে আর টাকা না থাকায় বিপাকে পড়েন। এই সময় তাঁদের পাশে দাঁড়ান উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের চিকিৎসকেরা। নজিনবাবুদের বিপিএল কার্ড না থাকলেও চিকিৎসার খরচের অধিকাংশ এর পরে হাসপাতালের তরফেই বহন করা হয়। কখনও ওষুধ না-মিললে চিকিৎসকেরাই ইন্টারনেট ঘেঁটে হদিস করেছেন। ভিন্ রাজ্য থেকে ওষুধ আনানো হয়। সরকারি ভাবে ওষুধ কেনার অর্থ পেতে কয়েক দিন দেরি হলে চিকিৎসকেরাই দিয়ে দিয়েছেন। মৃণালের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে গিয়েছে ওই বিভাগের চিকিৎসক মরিয়াম আইরিন, সঞ্জিত তিওয়ারি, মেঘা সারদা, অশোক মণ্ডলদের। নজিনবাবুর কাছে একটি মোবাইল থাকত। সমস্যা হলে তা থেকে মৃণাল সরাসরি ফোন করতেন চিকিৎসকদের। মৃণালের সঙ্গে নজিনবাবুর খাবারের ব্যবস্থাও করে দেন কর্তৃপক্ষ। সুপার সব্যসাচী দাস বলেন, “ওষুধ-পথ্য হাসপাতাল থেকেই দেওয়া হচ্ছে। রোগীর পরিবার যে টাকা খরচ করেছে তা-ও ফিরিয়ে দেওয়া হবে।”