ফাঁকা পড়ে পটাশপুর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বেড। নিজস্ব চিত্র।
এলাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু, রোগীদের পথ্য-পরামর্শ দিয়ে আরোগ্যের পথ দেখান যাঁরা, সেই চিকিৎসকই নেই! পূর্ব মেদিনীপুরের অন্তত দশটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এখন এই চিত্র। ব্যতিক্রম নয় পশ্চিম মেদিনীপুরও। সেখানেও জেলার গ্রামীণ হাসপাতালগুলির ৫০ শতাংশেরও বেশি পদ শূন্য।
সম্প্রতি জলে ডুবে অচৈতন্য হওয়া দেড় বছরের সানিয়া খাতুনকে বাড়ির কাছে পটাশপুর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু, চিকিৎসক না থাকায় সে চিকিৎসার কোনও সুযোগই পায়নি। এগরা মহকুমা হাসপাতালের পথে ওই শিশুর মৃত্যু হয়। শুধুমাত্র চিকিৎসকের অভাবে জেলার অনেকগুলি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ হওয়ার মুখে। শুধু পটাশপুর নয়, বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামীণ এলাকাগুলিতে থাকা ৫১টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ১০টি এখন চিকিৎসক শূন্য!
চিকিৎসার এমন অবস্থার কথা মানছেন জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য দফতরের কর্মাধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম দাস। পেশায় চিকিৎসক পার্থপ্রতিমবাবু বলেন, “এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রুখতে আমরা চেষ্টা করব।”
স্বাস্থ্য দফতর ও জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গিয়েছে, তমলুক শহরে পূর্ব মেদিনীপুর সদর জেলা হাসপাতাল ছাড়াও জেলায় বর্তমানে ২৫টি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৫১টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৭০৬টি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৩টি গ্রামীণ (বাসুলিয়া, ভগবানপুর, রেয়াপাড়া) হাসপাতাল, একটি (দিঘায়) স্টেট জেনারেল হাসপাতাল, তিনটি মহকুমা (কাঁথি, হলদিয়া, এগরা) হাসপাতাল রয়েছে। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের হিসেবে, গ্রামীণ এলাকায় থাকা প্রাথমিক ও ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে ২৪৭ জন চিকিৎসকের থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে রয়েছে মাত্র ৯০ জন।
এর ফলে জেলার ১০টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এখন কোনও চিকিৎসক নেই। একই ভাবে ৪টি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাত্র দু’জন করে চিকিৎসক রয়েছেন। ফলে ওই সব স্বাস্থ্যকেন্দ্র লাগোয়া এলাকার বাসিন্দারা এখন রীতিমতো আতঙ্কে রয়েছেন। পটাশপুর ২ ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু এই উদ্বেগ বাড়িয়েছে। পটাশপুর ২ ব্লকেরই আড়গোয়াল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনও চিকিৎসক নেই। আড়গোয়াল এলাকার বাসিন্দা তথা পটাশপুর ২ পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ কল্যাণ মাইতি উদ্বেগের সুরে বলেন, “বাড়ির কাছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকা সত্ত্বেও কোনও চিকিৎসক না থাকায় খুব চিন্তা হয়। রাত-বিরেতে এলাকার কেউ অসুস্থ হলে প্রাথমিক চিকিৎসার সুযোগ পর্যন্ত নেই। এখান থেকে এগরা মহকুমা হাসপাতালের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। সেখানে নিয়ে যাওয়ার পথেই তো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে!”
পটাশপুর ২ ব্লকের মতোই এগরা ২ ব্লকের শ্যামপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এখন চিকিৎসক শূন্য। শ্যামপুরের বাসিন্দা মামনি মান্না ক্ষোভের সুরে বলেন, “তিন বছর হল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক নেই। জানি না, এমনটা কত দিন চলবে।”
পূর্ব মেদিনীপুরের বেশ কয়েক’টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক না থাকা ও ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক কম থাকায় মহকুমা ও জেলা হাসপাতালগুলিতে রোগীর ভিড় বাড়ছে। এমনই অভিজ্ঞতা জেলা হাসপাতালের সুপার গোপাল দাসের। তিনি বলেন, “এখানে এমন অনেক রোগী আসছেন, যাঁদের চিকিৎসা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে করা যায়।”
গোপালবাবুর সঙ্গে সহমত জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম দাস। তিনি বলেন, “প্রায় দেড় বছর ধরে জেলার কিছু ব্লক ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে চিকিৎসকের অভাব চলছে। এই সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক নিয়োগের জন্য জেলায় অন্ততপক্ষে ১০০ চিকিৎসক চেয়ে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের কাছে আর্জি জানিয়েছি।” জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্বাস, চিকিৎসকের ঘাটতি মেটাতে চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, “দ্রুত জেলায় চিকিৎসক নিয়োগ হবে।”
অন্য দিকে, জেলা স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট, পশ্চিম মেদিনীপুরের গ্রামীণ হাসপাতালগুলির ৫০ শতাংশেরও বেশি চিকিৎসকের পদ শূন্য। ফলে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র হোক বা গ্রামীণ হাসপাতাল সব ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত দুর্ভোগে পড়তে হয় রোগীদের। যে সব প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ১০টি করে শয্যা রয়েছে অর্থাৎ যেখানে রোগীদের ভর্তিও রাখার কথা, তেমন স্বাস্থ্য কেন্দ্রেও চিকিৎসকের দেখা মেলে না। বড় জোর সপ্তাহে দু’একদিন সেই সব জায়গায় চিকিৎসকেরা যান। বাকি ক্ষেত্রে ভরসা ফার্মাসিস্টরাই। ফলে সামান্য রোগের ক্ষেত্রেও ‘রেফার’ করে দেওয়া হয়। তাতেও কী, সমস্যা থেকে যায় সেই তিমিরেই!
কারণ, প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা গ্রামীণ হাসপাতালে ‘রেফার’ করতে হয়। সেখানেও অবস্থাটা একই রকম। যেখানে ১০-১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা সেখানে বড় জোর তিন-চার জন রয়েছেন। জেলায় এই সব গ্রামীণ হাসপাতালগুলিতে অনুমোদিত চিকিৎসকের সংখ্যা ২০২ জন। কিন্তু বর্তমানে রয়েছেন মাত্র ১০০ জন। অর্থাৎ ১০২টি পদ শূন্য!
প্রসূতি বিশেষজ্ঞ, শিশু বিশেষজ্ঞের মতো গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসকের পদও শূন্য। শুন্য একাধিক অ্যানাথেটিস্টের পদও। ফলে অস্ত্রপোচারের পরিকাঠামো থাকলেও করা যায় না। ফলে ফের ‘রেফার’ করায় দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় মানুষের হাতের কাছে চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য কেন্দ্রেও শয্যা চালু করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু চিকিৎসকের অভাবে সেই উদ্দেশ্যই এখন ব্যর্থ। এতে দুর্ভোগ বাড়ছে গ্রামীণ এলাকার রোগীদের। হয় তাঁদের মহকুমা হাসপাতালে যেতে হচ্ছে নতুবা মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে।
দুই মেদিনীপুরে চিকিৎসা পরিষেবায় এমন সঙ্কট কবে বদলায় সেটাই দেখার!