চক্ষুদানের প্রচারে রাজ্যের আদর্শ রিষড়ার দাঁ দম্পতি

উপন্যাসকে ছাপিয়ে যাওয়ার মতো ছিল তাঁদের মৃত্যু! সেইরকমই নাটকীয় মৃত্যুর পরে দু’জনের চোখদানের ব্যাপারে তাঁদের কিশোরী কন্যার সিদ্ধান্ত। রিষড়ার সেই দাঁ দম্পতিকেই চক্ষুদানের প্রচারাভিযানে রাজ্যের রোল মডেল হিসাবে গ্রহণ করছে স্বাস্থ্য দফতর। একই দিনে, একই সরকারি হাসপাতালে মাত্র দশ মিনিটের ব্যবধানে শিখা দাঁ, প্রতাপ দাঁ-র মৃত্যু হয়। দু’জনের কেউই আগে থেকে চক্ষুদানের অঙ্গীকার করেননি। কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর পর সেই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি দম্পতির ১৯ বছরের কন্যা ঋতুপর্ণা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৪ ০১:৪৩
Share:

প্রতাপ দাঁ ও শিখা দাঁ দম্পতি। —নিজস্ব চিত্র।

উপন্যাসকে ছাপিয়ে যাওয়ার মতো ছিল তাঁদের মৃত্যু! সেইরকমই নাটকীয় মৃত্যুর পরে দু’জনের চোখদানের ব্যাপারে তাঁদের কিশোরী কন্যার সিদ্ধান্ত। রিষড়ার সেই দাঁ দম্পতিকেই চক্ষুদানের প্রচারাভিযানে রাজ্যের রোল মডেল হিসাবে গ্রহণ করছে স্বাস্থ্য দফতর।

Advertisement

একই দিনে, একই সরকারি হাসপাতালে মাত্র দশ মিনিটের ব্যবধানে শিখা দাঁ, প্রতাপ দাঁ-র মৃত্যু হয়। দু’জনের কেউই আগে থেকে চক্ষুদানের অঙ্গীকার করেননি। কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর পর সেই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি দম্পতির ১৯ বছরের কন্যা ঋতুপর্ণা। বাবা মায়ের মোট চারটি চোখই দান করেন তিনি। তা দিয়ে দৃষ্টি পেয়েছেন মোট চার জন দৃষ্টিহীন মানুষ। এই ঘটনাকেই এ বার চক্ষুদানের প্রচারের হাতিয়ার করছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। চক্ষুদানে মহারাষ্ট্র, গুজরাত, তামিলনাড়ু বা কর্নাটকের মতো রাজ্য থেকে অনেক পিছিয়ে থাকা পশ্চিমবঙ্গে যদি মানুষকে সচেতন ও উৎসাহিত করা যায় সেই চেষ্টায় দাঁ দম্পতির কাহিনির শরণাপন্ন হয়েছে তারা।

মৃত্যুর পর একই মানুষের একাধিক অঙ্গ দান বা বাবার মৃত্যুর পর তাঁর চিকিৎসক ছেলে নিজের হাতে বাবার কর্নিয়া তুলে দৃষ্টিহীনের চোখে প্রতিস্থাপন করার উদাহরণ দক্ষিণ ভারতে ঘটেছে। অতিরিক্ত স্বাস্থ্য অধিকর্তা (চক্ষু) সিদ্ধার্থ নিয়োগীর কথায়, “দাঁ দম্পতির মৃত্যু ব্যতিক্রমী, তেমনই দৃষ্টান্তমূলক তাঁদের মরণোত্তর চক্ষুদানের ব্যাপারে তাঁদের কিশোরী কন্যার সিদ্ধান্ত। মানুষের মনে এই ঘটনা সহজে নাড়া দেবে বলেই আমরা একে নিয়ে প্রচারে যাচ্ছি। তাঁদের ছবি দিয়ে পোস্টার তৈরির পরিকল্পনাও হয়েছে।” সিদ্ধার্থবাবুর আরও বক্তব্য, “চক্ষুদানে পশ্চিমবঙ্গ এখনও অনেকটা পিছিয়ে। তামিলনাড়ু বা গুজরাতের মতো রাজ্যে যেখানে বছরে ৬ হাজারের বেশি চোখ সংগ্রহ হয় সেখানে পশ্চিমবঙ্গে হয় সাড়ে তিন হাজারের মতো। কিন্তু চোখের প্রয়োজন অনেক বেশি। শিখা দাঁ-প্রতাপ দাঁ-র কথা জানিয়ে আমরা মানুষকে চক্ষুদানে উৎসাহী করতে চাইছি।” আর মৃত দাঁ দম্পতির একমাত্র সন্তান ঋতুপর্ণার কথায়, “আমার যা ক্ষতি হয়েছে তা তো আর পূরণ হবে না, বরং কোনও দৃষ্টিহীন মানুষ যদি বাবা-মায়ের চোখ দিয়ে দেখতে পান তবে আমার মনে হবে তাঁরা বেঁচে আছেন। তাই মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়েও আমি চক্ষুদানের সিদ্ধান্ত নিতে দু’বার ভাবিনি।”

Advertisement

কী ভাবে মারা গিয়েছিলেন দাঁ দম্পতি। ঋতুপর্ণা জানান, বেশ কয়েক বছর যাবৎ ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছিলেন শিখা দেবী। বারবার হাসপাতালে দীর্ঘসময়ের জন্য ভর্তি থাকতে হত। গত বছর ডিসেম্বর থেকে আবার কিডনির সমস্যা যোগ হয়। চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ডাক্তার জবাব দিয়ে দেন। স্ত্রী-র এই অবস্থা দেখে ভেঙে পড়েন প্রতাপবাবু। তাঁর স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়তে থাকে। প্রতাপবাবুর ভাই অশোক দাঁয়ের কথায়, “২৬ ফেব্রুয়ারি বৌদিকে শ্রীরামপুর ওয়ালস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর পর দাদাও খুব অসুস্থ হয়ে ২ মার্চ একই হাসপাতালে ভর্তি হন। ৪ মার্চ বৌদি মারা যান বেলা ১টা ৫০ মিনিটে আর দাদার মৃত্যু হয় ঠিক দশ মিনিট পর বেলা ২টোর সময়।”

হাসপাতাল সূত্রের খবর, দম্পতির মৃত্যুর খবর পেয়ে স্থানীয় একটি বেসরকারি আইব্যাঙ্কের কমীর্রা দাঁ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাড়ির লোক সেই মুহূর্তে আগ্রহ দেখাননি, কিন্তু বিষয়টি কানে আসতে ‘হ্যাঁ’ বলতে একসেকেন্ডও সময় নেননি ঋতুপর্ণা। বাবা-মাকে একসঙ্গে হারিয়ে গভীর শোকের সময়েও পিছিয়ে আসেননি চক্ষুদান থেকে। শ্রীরামপুর কলেজের ইতিহাসে অনার্সের এই ছাত্রীর জন্যই তাঁর বাবা-মায়ের মোট চারটি চোখ সংগ্রহ করে চার জন দৃষ্টিহীনের চোখে প্রতিস্থাপন করা গিয়েছে। স্বাস্থ্যকর্তারা জানান, ভারতে দৃষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৬ লক্ষ। প্রতি বছর নতুন করে ৩৫ হাজার দৃষ্টিহীন তাতে যোগ হয়। এঁদের দৃষ্টি দিতে বছরে অন্তত আড়াই লাখ চোখ দরকার, সেখানে সংগৃহীত হয় মাত্র ৪৫ হাজারের মতো। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে ঋতুপর্ণার মতো কিছু মানুষের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক পরিবর্তন এনে দিতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন