নকল দাওয়াই পাকড়ানোর নতুন ‘দাওয়াই’ বাতলেছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। জাল ওষুধের কারবার রুখতে তারা এ বার দিতে চলেছে পুরস্কারের টোপ।
ঠিক হয়েছে, দেশের যে কোনও প্রান্তে জাল ওষুধ তৈরি, মজুত বা বিক্রির খবর সরকারকে জানালেই সংবাদদাতাকে ইনাম দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রকল্পটির একটি আলঙ্কারিক নামও দেওয়া হয়েছে হুইসল্ব্লোয়ার্স রিওয়ার্ড স্কিম। কয়েকটা ফোন নম্বর দিয়ে দেওয়া হবে। সেখানে ফোন করে কেউ জাল ওষুধ-সংক্রান্ত তথ্য দিলে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা তা যাচাই করে দেখবে। অভিযোগ সত্যি প্রমাণিত হলে ২৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত পুরস্কার মিলবে। খবরদাতা সরকারি চাকুরে হলে অবশ্য ইনামের অঙ্ক বাঁধা থাকবে পাঁচ লাখের মধ্যে।
প্রসঙ্গত, কর ফাঁকি ধরতে এখন আয়কর দফতরে এমন পুরস্কারের ব্যবস্থা চালু আছে। পশ্চিমবঙ্গের এক প্রাক্তন সাংসদ তা পেয়েওছেন। ওষুধে ভেজাল ধরার জন্য একই রাস্তায় হাঁটার কারণ কী?
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য-কর্তাদের ব্যাখ্যা: দেশীয় ওষুধের বাজারের অন্তত ৪% ইতিমধ্যে জালিয়াতদের দখলে। ফলে আমজনতার স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা পড়েছে বড় প্রশ্নের মুখে। উপরন্তু সিঁদুরে মেঘ ঘনাচ্ছে বৈদেশিক বাণিজ্যের আকাশে। ভারত ফি বছর অন্তত ৩৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধ ও ইঞ্জেকশন রফতানি করে। রফতানি করা ভারতীয় ওষুধের মধ্যে কোনও ভাবে ভেজাল ধরা পড়লে বিশ্ববাজারে ভারতের মুখ তো পুড়বেই, পাশাপাশি কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা হারানোরও সমূহ আশঙ্কা। কিন্তু এই বিপদের মোকাবিলা করতে হলে যে ধরনের শক্তপোক্ত পরিকাঠামো দরকার, এই মুহূর্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হাতে তা নেই।
কাজেই ইনামের টোপ। কিন্তু পুরস্কারের কথায় উৎসাহিত হয়ে কেউ যদি কোনও খবর দেনও, চটজলদি সেখানে অভিযান চালানোর ক্ষমতা ড্রাগ কন্ট্রোলের আছে কি?
প্রশ্নটা যে আদৌ উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, সরকারি কর্তারাও তা মানছেন। পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরা যাক। রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের এক অফিসার জানিয়েছেন, ভেজাল ওষুধ ধরার অভিযান চালান যাঁরা, পশ্চিমবঙ্গে সেই ড্রাগ ইন্সপেক্টরের ১৪০টি পদ। যার ৫৯টিতে আপাতত লোক নেই। ক’দিনের মধ্যে আরও কুড়ি জনের পদোন্নতি হবে, তখন ইন্সপেক্টরের আরও কুড়িটি পদ খালি হবে। এবং সে জায়গায় নতুন লোক কবে নিয়োগ হবে, কেউ জানে না। লোকাভাব সম্পর্কে কেন্দ্রের বক্তব্য কী?
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন অবশ্য মনে করেন, সংখ্যা নয়, কাজের ইচ্ছেটাই আসল। “বিজেপি সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে। সেই লড়াইয়ে আম নাগরিককে সামিল করা গেলে লাভ বই ক্ষতি নেই।” বলছেন তিনি। কিন্তু ড্রাগ কন্ট্রোলের নিজস্ব পরিকাঠামো না-বাড়িয়ে সরকার সাধারণ মানুষের খবরের উপরে নির্ভর করতে চাইছে কেন?
মন্ত্রীর জবাব “পরিকাঠামো যতই বাড়ানো হোক, এত বড় দেশের পক্ষে কখনই তা যথেষ্ট হবে না। দেশের কোন প্রান্তে ভেজাল ওষুধের কারবারিরা কী ভাবে ব্যবসা চালাচ্ছে, সাধারণের সাহায্য ছাড়া তার সব খুঁজে বার করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।”
জাল ওষুধ তৈরি হয় কী ভাবে?
ড্রাগ কন্ট্রোলের খবর: নামী সংস্থার বহুল প্রচারিত কোনও ওষুধের একটি বা দু’টি ব্যাচ নম্বর ভেজাল কারবারিরা জেনে নেয়। সেই নম্বর ধরে তারা কয়েক লক্ষ ওষুধ তৈরি করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে যার উপকরণ বলতে চকের গুঁড়ো, স্টার্চ বা রঙিন চিনির জল। সেগুলি বিপণনের জন্য অঞ্চলভিত্তিক লোক থাকে। তারা বাজার ঘুরে খবর নেয়, কোন সংস্থার কোন ওষুধ কোন কোন স্টকিস্ট রাখছেন, আর তাঁদের থেকে কোন কোন হোলসেলার তা কিনছেন। ড্রাগ কন্ট্রোল সূত্রের দাবি: জালিয়াতদের এজেন্টরা সেই সব স্টকিস্ট ও হোলসেলারকে টোপ দেয় একই ওষুধ অনেক বেশি ছাড়ে বিক্রির। মফস্সল ও গ্রাম-গঞ্জের স্টকিস্ট, হোলসেলার ও হাতুড়েদের একাংশ টোপ গেলেন। আর তাঁদের মারফত রোগীদের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় ভেজাল ওষুধ।
কেন্দ্রীয় সরকার মনে করছে, সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলা ছাড়া এই ‘অসুখ’ নির্মূল করা সম্ভব নয়। হর্ষ বর্ধন জানিয়েছেন, কোথায় কোথায় জাল ওষুধ বেশি বিকোচ্ছে, তার আঁচ পেতে ১২ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গড়া হয়েছে। তাতে পশ্চিমবঙ্গ-সহ চার রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোলারেরা রয়েছেন। কমিটির তত্ত্বাবধানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ওষুধের লক্ষাধিক নমুনা সংগ্রহ করা হবে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যালস এবং আইআইটি হায়দরাবাদ সেগুলো পরীক্ষা করবে। যে তল্লাটে দেখা যাবে জাল ওষুধের রমরমা বেশি, সেখানে নজরদারি ও ধরপাকড় বাড়ানো হবে।
নকল ওষুধের বিপদ সম্পর্কে আমজনতাকে হুঁশিয়ার করতে রাজ্যে রাজ্যে শীঘ্র সচেতনতা শিবিরও চালু করতে চলেছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক।