পেটের রোগে ক’দিন ধরে ভুগছিল বেজপুকুর গ্রামের বছর পাঁচেক বয়সের বাবুসোনা দলুই। পরিবারের লোকজন তাঁকে নিয়ে গেলেন স্থানীয় রামচন্দ্রনগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। কিন্তু কাকদ্বীপ ব্লকের নেতাজি পঞ্চায়েতের ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রয়েছেন এক জন মাত্র স্থায়ী চিকিৎসক। তিনিও সপ্তাহে দু’তিন দিনের বেশি থাকতে পারেন না। সেদিনও ছিলেন না। ফলে চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মী ও এক নার্সই যতটুকু সম্ভব চিকিৎসা করলেন।
বছরের পর বছর ধরে এ ভাবেই চলছে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, স্থায়ী চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য-কর্মী বাড়ানোর জন্য একাধিকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানালেও এখনও পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র সূত্রে জানা গিয়েছে, এটির উপর নেতাজি এবং রবীন্দ্র পঞ্চায়েতের সোদপুকুর, পাকুড়তলা, মানিক ঠাকুরচক, কঁদো, বেজপুকুর, জুমাইলস্কর, ডোবারচক-সহ ১৫ থেকে ২০টি গ্রামের বাসিন্দারা নির্ভরশীল। প্রতি দিন ওই কেন্দ্রটিতে ১৫০ থেকে ২০০ জন রোগীর ভিড় থাকে। যে চিকিৎসক ওই কেন্দ্রটিতে রয়েছেন, তাঁকে অন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দায়িত্ব সামলাতে হয়। ফলে বেশিরভাগ সময়েই রোগী দেখা থেকে ওষুধ দেওয়ার কাজ সামলান দু’জন নার্স ও এক জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। আর রয়েছেন এক জন সাফাইকর্মী। আশঙ্কাজনক অবস্থায় কোনও রোগী এলে তাঁকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে কাকদ্বীপ মহকুমা হাসপাতাল বা ডায়মন্ড হারবার জেলা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু রাস্তার অর্ধেকের বেশি অংশ এতটাই বেহাল যে রোগী নিয়ে যেতে সময় লাগে অনেক বেশি। পথেই মারা যান অনেক রোগী। দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও থাকে।
ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক গৌরীশঙ্কর সামন্ত বলেন, “এই কেন্দ্রটি সামলানোর পাশাপাশি প্রত্যন্ত গ্রামের কিছু মোবাইল ক্যাম্প ছাড়াও অন্যান্য কাজ সামলাতে হয়। তাই দু’তিন দিনের বেশি এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সময় দিতে পারি না। অবিলম্বে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য-কর্মী নিয়োগ করা দরকার।”
বহু বছর আগে রামচন্দ্রনগর মোড়ের পাশে প্রায় ২০ বিঘা জমির উপর ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভবন এবং স্বাস্থ্য-কর্মীদের থাকার জন্য ৯টি আবাসন তৈরী হয়। সে সময়ে ঠিক হয়েছিল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি কিছুদিন চলার পর আরও কর্মী বাড়ানো হবে। ভর্তি নিয়ে চিকিৎসা করা হবে। এমনকি, ২০ থেকে ২২টি শয্যা এবং অপারেশন থিয়েটারের জন্য প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু প্রায় ত্রিশ বছর পরেও সেই পরিষেবাগুলি চালু হয়নি। বহু বছর ধরে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি এবং শয্যাগুলি। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী চিকিৎসক না থাকায় উপযুক্ত পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাঁরা। স্থানীয় বাসিন্দা মনিরুল মোল্লা, রহিমা বিবিদের আক্ষেপ, “স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য সরকার উদ্যোগী হলেও আমরা গ্রামের মানুষ সেই তিমিরেই পড়ে রইলাম। এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে তার ভাগ্য অনিশ্চিত। সব চেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা।”
শুধু চিকিৎসা পরিষেবা নয়। বেহাল দশা স্বাস্থ্যকর্মীদের আবাসনগুলিরও। এখন ৯টি আবাসনের মধ্যে ৫টি ব্যবহার হচ্ছে। বাকিগুলি পরিত্যক্ত বাড়ির চেহারা নিয়েছে। একটি মাত্র পানীয় জলের নলকূপ রয়েছে। তাও বছরের অর্ধেক দিনই অকেজো হয়ে পড়ে থাকে তা। স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরটিতেও এখনও কোনও প্রাচীর নেই। মাঝেমধ্যেই অসামাজিক কাজকর্ম চলে এখানে। নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।
গৌরীশঙ্কর সামন্তও বলেন, “প্রাচীর না থাকায় নার্সদের আবাসনে থাকা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। আবাসনগুলিও দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ছে। সব বিষয়ে বহুবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।” এ বিষয়ে কাকদ্বীপ ব্লক মেডিক্যাল অফিসার সায়ন দাস ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সমস্যার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, “চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী, সবই নিয়োগ করে স্বাস্থ্য দফতর। তাদের বিষয়টি জানানো হয়েছে।”