গত সেপ্টেম্বর থেকে জেলার অন্তত ৩০০টি গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের সমস্যার কথা জেনেছেন জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন। রাতে গ্রামবাসীদের মুখোমুখি বসে একাধিক বৈঠকও করেছেন। কোথাও আবার কড়া নেড়ে বাড়ির কর্তার ঘুম ভাঙিয়ে জানতে চেয়েছেন তাঁদের কী সমস্যা, কোন প্রকল্পের টাকা তাঁরা পাচ্ছেন না বা আবেদনের পরেও শংসাপত্র না পাওয়ার ঘটনা ঘটছে কি না। শনিবার বর্ধমানের নাদনঘাট থানার যে গ্রামে রাতে গিয়ে তিনি এলাকার মানুষের সঙ্গে বৈঠকে বসেন, তার নাম দামোদরপাড়া।
ওই গ্রাম তো বটেই তার আশপাশের বহু গ্রামের মানুষও আগে কোনও দিন জেলাশাসকের দেখা পাননি বা সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলার সুযোগ পাননি। ফলে এ দিন নানা সরকারি প্রকল্পের পরিষেবা না পাওয়া নিয়ে তাঁরা ক্ষোভ উগড়ে দেন। আদিবাসী অধ্যুষিত ওই গ্রামের বাসিন্দা শিবু হাঁসদা বলেন, “এতদিন ধরে আমরা লোকের জমি চাষ করে আসছি। কিন্তু আজও সরকার আমাদের পাট্টা দিতে পারল না।” উত্তরে স্থানীয় বিএলএলআরও বলেন, “এই এলাকায় ২৬ জনকে আজ পর্যন্ত পাট্টা দেওয়া হয়েছে। আমরা পাট্টা দিতে প্রস্তুত কিন্তু খাস জমি না থাকায় দিতে পারছি না।” জেলাশাসক অবিলম্বে জমি কিনতে নির্দশে দেন দফতরকে।
এক ছাত্রী ফুলদেবী মান্ডি বলেন, “আমি কলেজে পড়ি। গত বছর যখন উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছিলাম, তখন পর্যন্ত ছাত্রবৃত্তির টাকা, বই কেনার টাকা পাইনি।” জেলাশাসক ওই ছাত্রী কেন টাকা পাননি অবিলম্বে তার খোঁজ নিতে বলেন কালনার মহকুমাশাসককে। দামোদরপাড়ার বাসিন্দা শ্যামল ঘোষ বলেন, “এলাকায় রাস্তা তৈরির জন্য জমি দিয়েছিলাম। কিন্তু ওখানে বিল যে ভাবে সব কিছু গ্রাস করছে, তা না রুখলে আমাদের ঘরবাড়ি চলে যাবে।” জেলাশাসক তখনই ওই পুকুরের পাড়ে একটি ২০০ মিটারের গার্ডওয়াল তৈরি করার নির্দেশ দেন। সভায় আশপাশের গ্রামের মানুষেরা অভিযোগ করেন, ন’পাড়ায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। আরও অনের গ্রামেও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভবন তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে। কিন্তু চিকিৎসা পেতে এলাকাবাসীকে সেই চাঁদপুরে বা কালনায় যেতে হয়। সমস্যা স্বীকার করে সিএমওএইচ প্রণব রায় বলেন, “আমাদের হাতে ডাক্তার নার্সের প্রচণ্ড অভাব। তাঁরা এলেই সর্বত্র ডাক্তার ও নার্স দেব।” বহু রাস্তার সংস্কার, সেই রাস্তায় বাস অটো ইত্যাদি চালানোরও দাবি ওঠে সভায়।
রাইপুরের বাসিন্দা দেবাশিস ঘোষ বলেন, “রাইপুরে একটি সমবায় সমিতি রয়েছে। সেটি এখন তার ঝাঁপ বন্ধ। তারা এতদিন ধরে আমাদের কাছ থেকে যে আমানত সংগ্রহ করেছে, তা ফেরত দিচ্ছে না।” জেলাশাসক বলেন, “আপনারা ওই সমিতির ম্যানেজারের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিন। আমি ওকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেব।”
সভায় ছিলেন মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। তিনি বলেন, “আমি এখানে মন্ত্রী নই, গ্রামের মানুষ হিসেবে যোগ দিয়েছি। আমার অভিযোগ রয়েছে জেলা জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের জলপ্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ যাঁরা করেন তাঁদের বিরুদ্ধে।” তাঁর অভিযোগ, “কোথাও প্রকল্পের যন্ত্রপাতি কিছু খারাপ হলে তাঁদের দেখা মেলেনা। বারবার আসতে বললে তারা বলে দেন নির্দিষ্ট যে যন্ত্রটি পাল্টাতে হবে তা হাতে মজুত নেই।”
এরপরে জাতিগত শংসাপত্র, পাট্টা, রেশন কার্ড নিয়ে বারেবারে নানা অভিযোগ তুলতে থাকেন গ্রামবাসী। জেলাশাসক বিএলএলআরও, বিডিও ও খাদ্যদফতরকে নির্দশে দেন আগামী ২ জুলাই গ্রামে শিবির করে এই অভিযোগগুলির শুনানি-সহ উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। বৈঠকে জেলাশাসক ছাড়াও অতিরিক্ত জেলাশাসক অমিত দত্ত, প্রণব বিশ্বাস ও হৃষিকেশ মুদি, কালনার মহকুমাশাসক সব্যসাচী ঘোষ, পূর্বস্থলী ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিলীপ মল্লিক, বিডিও তপন মল্লিকও হাজির ছিলেন।