দুই গর্ভবতী বালিকাকে নিয়ে বিভ্রান্ত শিশুকল্যাণ সমিতি

বারো ও চোদ্দো বছরের দুই অন্তঃসত্ত্বাকে নিয়ে ‘কলকাতা শিশুকল্যাণ সমিতি’ বা সিডব্লিউসি-র দ্বারস্থ খাস কলকাতা শহরের দুই উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবার! কাকতালীয় ভাবে দু’জনেই এসেছে একই দিনে গত সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৭:৪৯
Share:

বারো ও চোদ্দো বছরের দুই অন্তঃসত্ত্বাকে নিয়ে ‘কলকাতা শিশুকল্যাণ সমিতি’ বা সিডব্লিউসি-র দ্বারস্থ খাস কলকাতা শহরের দুই উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবার! কাকতালীয় ভাবে দু’জনেই এসেছে একই দিনে গত সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি। দু’টি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং তা নিয়েই দিশাহারা সিডব্লিউসি তথা সমাজকল্যাণ দফতর।

Advertisement

দুই পরিবারেরই অনুরোধ, বালিকাদের গর্ভাবস্থা সম্পর্কে তারা এতটাই পরে জানতে পেরেছে যে, এখন গর্ভপাত করাতে গেলে মেয়েদের প্রাণসংশয় হতে পারে। অথচ, পারিবারিক সম্মানের জন্য এই অবস্থায় বাড়িতে, সর্বসমক্ষে তারা মেয়েদের রাখতে সক্ষম নয়। অতএব, দুই পরিবারই চায় শিশুর জন্ম পর্যন্ত দুই বালিকা-মার দায়িত্ব নিক সিডব্লিউসি। বাচ্চা হওয়ার পর মেয়েদের তারা ফিরিয়ে নিতে রাজি, কিন্তু সদ্যোজাতদের তারা নিতে চায় না! তবে শুধু এই দু’টি পরিবার নয়। খোদ নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজাই মানছেন, এমন ঘটনার খবর মাঝেমধ্যেই আসছে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে।

প্রাথমিক ভাবে সিডব্লিউসি-র সামনে দু’টি পথ খোলা ছিল। এক, মেয়েদু’টিকে প্রত্যাখ্যান করা। এবং দুই, তাঁদের কিছু দিনের জন্য আশ্রয় দেওয়া। বালিকাদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে কর্তারা আপাতত দ্বিতীয় পথটি বাছলেও এর পর কী, তা নিয়ে সম্প ূর্ণ ধোঁয়াশায় তাঁরা। সন্তানসম্ভবা বালিকা ও তাদের ভাবী সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভ্রান্ত। কারণ এ রকম পরিস্থিতি নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও আইন তাদের হাতে নেই।

Advertisement

কলকাতা সিডব্লিউসি-র অন্যতম সদস্য অমিতা সেনের কথায়, “ইউনিসেফ সন্তানের উপর মায়ের অধিকারের কথা বলেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মা-ই শিশু, অবোধ। পরিবার সন্তানকে না-চাইলে সে জোর খাটাতে পারবে না। একমাত্র পথ সন্তানটিকে সমাজকল্যাণ দফতরের হোমে রাখা। মা সাবালিকা হয়ে বাচ্চা সম্পর্কে মতামত না দেওয়া পর্যন্ত বাচ্চাটিকে কাউকে দত্তকও দিতে পারব না।”

সমস্যা শুধু এখানেই নয়। কলকাতা সিডব্লিউসি-র আর এক সদস্য অমিত ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “এমন এক-দু’টি কেস-এ আমরা শিশুর দায়িত্ব নিয়ে নিলে ‘শিয়ালকে ভাঙা বেড়া দেখানো’র ব্যাপার হতে পারে। পরে এই দৃষ্টান্ত দেখিয়ে আরও অনেক পরিবার তাদের নাবালিকা ছেলেমেয়ের অনাকাঙ্খিত সন্তানকে আমাদের উপর চাপিয়ে কোনও মতে মুক্ত হতে চাইবে। আমরা এই প্রবণতা নিয়ে চিন্তিত।”

সিডব্লিউসি কর্তারা আরও বেশি উদ্বিগ্ন শহরে উচ্চমধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের নামী স্কুলে পড়া ছেলেমেয়েদের মধ্যে যৌনসংসর্গের প্রবণতা নিয়েও। একটা সময়ে ইউরোপ-আমেরিকায় এই একই প্রবণতা হাইস্কুল স্তরে এসেছিল। সমস্যা এখনও রয়েছে, কিন্তু সেখানে সেই পরিমাণ সচেতনতা প্রচারও প্রচলিত। যা আমাদের এখানে এখনও নেই বলে বিশেষজ্ঞদের মত। সমাজতাত্ত্বিক রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়ের আফশোস, “মেয়েরা অনেক তাড়াতাড়ি ঋ

তুমতী হচ্ছে। ইন্টারনেট এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের দৌলতে অনেকেরই যৌনতায় আড়ষ্টতা কমছে, অল্পবয়সেই যৌন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় সতর্কতা পরিবার বা স্কুলে শিখছে না। ফলে গর্ভধারণের ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। নিরাপদ যৌনতা, জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা কারও সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারছে না এবং বিপর্যয় ঘটছে।”

নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা বলেন, “সম্প্রতি জেলায় বিভিন্ন সিডব্লিউসি-তেও এই প্রবণতা দেখলাম। অল্পবয়সী স্কুলপড়ুয়ারা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ছে। সিডব্লিউসি-তে সন্তান দিয়ে মুক্ত হতে চাইছে। আমরা বুঝিয়ে তাদের সদ্যোজাত-সহ বাড়ি পাঠানোর পরেও তারা যে দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলার অন্য পথ নেবেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?”

কলকাতা সিডব্লিউসি-তে আসা দুই বালিকার বাবাই পদস্থ পেশাদার। এক জনের বাড়ি কাঁকুরগাছিতে। অন্য জনের মুদিয়ালিতে। পরিবারের লোক যখন মেয়েদের গর্ভবতী হওয়ার খবর জানতে পেরেছে তখন প্রথম জন আট মাসের, অন্য জন সাত মাসের গর্ভবতী। সিডব্লিউসি দু’জনকেই আপাতত হোমে রেখেছে। হোম থেকেই হাসপাতালে তাদের সন্তান জন্মের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু তার পরে নাবালিকা মা ও তাদের সন্তানদের কী হবে, কেউ জানে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন