মশারা দিব্যি উড়ে বেড়াচ্ছে। শুয়োরেরা ফিরেছে যথাস্থানে। শিলিগুড়ির স্বাস্থ্যচিত্রও তাই যথাপূর্বং পরপর ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের প্রকোপে জেরবার হচ্ছেন বাসিন্দারা। শহরের ৪-৯, ৩১ এবং ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে ডেঙ্গির দাপট চলছে। অক্টোবর মাসে আক্রান্ত হ’ন ৪৬ জন। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রক্তের নমুনা পরীক্ষায় গত চারদিনে আরও চার জনের রক্তে ডেঙ্গির জীবাণু মিলেছে। এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের গঙ্গানগরের এক কিশোর উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা সঙ্কটজনক।
কী করছে শিলিগুড়ি পুরসভা?
পুরসভা খুঁজছে মশা তাড়ানোর লোক। গত মার্চ মাস থেকে শিলিগুড়ি পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের আধিকারিক পদ শূন্য। স্বাস্থ্য সহায়কের দুটি পদ - দুটিই শূন্য। ফলে স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজে নজরদারি করার কেউ নেই। মশা মারতে লার্ভানাশক তেল স্প্রে করা, ধোঁয়া ছড়ানো, বাসিন্দাদের মধ্যে প্রচার, বসতি এলাকা থেকে শুয়োর ধরা, শিবির করে জ্বরে আক্রান্তদের রক্ত সংগ্রহ, কিছুই নিয়মিত হচ্ছে না। পুর কমিশনার সোনম ওয়াংদি ভুটিয়ার দাবি, “গত মে-সেপ্টেম্বর পুরসভার স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সমীক্ষা করেছেন। লিফলেট বিলি করেছেন।”
পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগে ডেঙ্গি, ম্যলেরিয়া বা এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ দেখা দিলে আক্রান্তদের রক্ত পরীক্ষার কোনও বন্দোবস্ত-ই নেই। তাই অক্টোবর পড়তেই ফের শুরু হয়েছে ডেঙ্গির দাপট। গত বছর ডেঙ্গিতে অন্তত ১১ জনের মৃত্যু হয়েছিল শিলিগুড়ি শহরে। এ বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর উত্তরবঙ্গ জুড়ে এনসেফ্যালাইটিস ছড়ায়। মৃতের সংখ্যা একশো ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
খালপাড়া, সেবক রোডের দুই মাইল এলাকা, বর্ধমান রোডের ধারে নার্সিংহোমগুলিতে এখনও ডেঙ্গির উপসর্গ নিয়ে অনেকে ভর্তি রয়েছেন। পরিস্থিতি আঁচ করে শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের স্বাস্থ্য বিভাগের নোডাল অফিসার সঞ্জীব মজুমদারকে পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয় মাসখানেক আগে। তাতে অবস্থা বদলায়নি। স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকরা জানান, তাঁদের পর্যাপ্ত কর্মী নেই। কী করতে হবে পুর কর্তৃপক্ষকে সে বিষয়ে তারা পরামর্শ দেন। পুরসভারই দায়িত্ব সেই কাজ ঠিক মতো করা। পুরসভায় প্রায় দেড় হাজার সাফাই কর্মী রয়েছেন। নিকাশি সাফাই থেকে ওয়ার্ড পরিষ্কার, মশা মারার তেল স্প্রে করা, এদেরই করতে হয়। অত কাজের জন্য ওই কর্মী পর্যাপ্ত নয়, পুর কর্তৃপক্ষই জানিয়েছেন।
৭ নম্বর ওয়ার্ডে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন পবন অগ্রবালের পরিবারের সদস্যরা। বিজেপি নেতা পবনবাবু বলেন, “বাড়ির পাশে জমে থাকা আবর্জনা বছরের পর বছর পরিষ্কার হয়নি। হইচই হওয়ায় সম্প্রতি তা সাফ করা হয়। স্বাস্থ্য কর্মীরা বাড়িতেই ঢোকেন না।” শিলিগুড়ি পুরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ডেঙ্গির সংক্রমণ সব চেয়ে বেশি। গঙ্গানগরের বাসিন্দা গঙ্গানগরের সুশীল মন্ডল, টিচারপাড়ার সুপ্রিয়া দাস ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের এলাকায় গত এক বছরে স্প্রে করা হয়নি। নর্দমাগুলিতে জল দাঁড়িয়ে রয়েছে। সাফাই হয় না। স্বাস্থ্যকর্মীরাও আগাম ব্যবস্থা নিতে প্রচার করেননি।” পুরসভারই একটি সূত্র জানিয়েছে, পুরসভায় প্রশাসক বসার পর কয়েক মাস ধরে কাউন্সিলররা না থাকায় সংকট আরও তীব্র হয়েছে।
স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিক না থাকায় বিভিন্ন এলাকায় জ্বরে আক্রান্তদের রক্ত সংগ্রহ করে নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। এনসেফেলাইটিসের সংক্রমণের পর শহরে শুয়োর ধরতে অভিযানে নামে পুরসভা। কিন্তু শুয়োর ধরে কোথায় রাখা হবে তা নিয়ে সমস্যার জেরে সেই কাজও কিছুদিন চলার পর বন্ধ হয়ে যায়। শহরের বিভিন্ন এলাকায় ফের শুয়োর ঘুরতে শুরু করেছে।
উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান দিলীপ কুমরা দাস বলেন, “বছরভর রোগবাহী এডিস মশার জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।” এনসেফ্যালাইটিস রোগের জীবাণু কিউলেক্স বিশনই মশার শরীরে আসে শুয়োর এবং পাখি থেকে। ডোবার জলে ওই মশা জন্মায়। বসতি এলাকায় শুয়োর প্রতিপালন তাই বন্ধ রাখা জরুরি বলে তিনি মনে করেন।