এই দুই নার্সিংহোমেই অভিযান চালান জেলাশাসক এবং সিএমওইএচ। একটি বন্ধ করে দেন, অন্যটির নথিপত্র চেয়েছেন তাঁরা।—নিজস্ব চিত্র।
শহরের নানা নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে বারবার বেনিয়মের অভিযোগ পাচ্ছিল জেলা স্বাস্থ্য দফতর। আচমকা পরিদর্শনে গিয়ে পরিস্থিতি দেখেশুনে একটি নার্সিংহোম বন্ধের নির্দেশ দিলেন জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন ও মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক (সিএমওএইচ) প্রণবকুমার রায়। আর একটি নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষকে বৈধ নথিপত্র নিয়ে দেখা করার নির্দেশ দিলেন সিএমওএইচ। সেটির দু’টি বিভাগ ‘সিল’ করে দিয়েছেন তাঁরা।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, নার্সিংহোমগুলির বিরুদ্ধে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড এস্টাবলিশমেন্ট’ আইন মানা তো দূর, ন্যূনতম পরিষেবাটুকুও না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বারবার। কিন্তু প্রশাসনের কর্তাদের এ ভাবে আচমকা অভিযান চালাতে আগে দেখা যায়নি। সিএমওএইচ প্রণববাবু বলেন, “জেলার নানা নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে বেশ কিছু বেআইনি কার্যকলাপ চালানোর অভিযোগ মিলছিল। জেলাশাসকের সঙ্গে বৈঠক করে আমরা ঠিক করি, এ দিন অন্তত দু’টি নার্সিংহোম পরিদর্শন করা হবে আচমকা।” এ দিন তাঁরা বর্ধমান শহরের অনিতা সিনেমা লেনের একটি এবং আর বি ঘোষ রোডের মুখে আর একটি নার্সিংহোমে যান।
সিএমওএইচ বলেন, “আমরা গিয়ে দেখেছি, দু’টি নার্সিংহোমেরই বিশৃঙ্খল অবস্থা। সেখানে নেই কোনও চিকিৎসক বা নার্স। এমনকী আগুন নেভানোর পরিকাঠামো নেই। অন্ধকার ও অস্বাস্থ্যকর অপারেশন থিয়েটার, সরু সিঁড়ি। সব মিলিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থা। দু’টি নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষই কোনও নথিপত্র দেখাতে পারেননি। তাই প্রথম নার্সিংহোম থেকে রোগীদের আমরা সরিয়ে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। আর বি ঘোষ রোডে দ্বিতীয় নার্সিংহোমটিতে গিয়ে জানতে পারি, তাদের মাত্র ১৫টি শয্যার অনুমোদন রয়েছে। অথচ, মোট ৪৪ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। বেশির ভাগই আসন্নপ্রসবা। নার্সিংহোমের মালিককে দেখতে পাইনি। শেষে সেখানকার অপারেশন থিয়েটার এবং নীচে অবৈধ ভাবে চলতে থাকা প্যাথলজিক্যাল সেন্টারটি বন্ধ করে দিয়েছি।”
সিএমওএইচ জানান, অনিতা সিনেমা গলির নার্সিংহোম থেকে এক দালালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বর্ধমান থানায় ওই নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে বেআইনি ভাবে চিকিৎসার ব্যবসা চালানোর অভিযোগ দায়ের করেছেন সিএমওএইচ। দু’টি নার্সিংহোমের মালিককে অবশ্য ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি। সেখানে উপস্থিত কর্মীরা এ বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি।
সিএমওএইচ জানান, তাঁদের কাছে যে নথিপত্র রয়েছে, সেই অনুযায়ী বর্ধমান শহরে স্বাস্থ্য দফতর অনুমোদিত প্রায় ১০০টি নার্সিংহোম রয়েছে। তবে শহরে বেআইনি বা স্বাস্থ্য দফতরের অনুমোদন ছাড়া কত নার্সিংহোম চলছে, তা তিনি বলতে পারেননি। গোটা বর্ধমান জেলায় অনুমোদিত নার্সিংহোমের সংখ্যা ৬৫০টি। প্রায় ২০০০ প্যাথলজিক্যাল সেন্টার রয়েছে। আলট্রা-সোনোগ্রাফি হয় এমন কেন্দ্রের সংখ্যা ১৬৫টি। এর মধ্যে কোনগুলি বৈধ কোনগুলি নয়, তা নির্ণয় করতে লাগাতার অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা স্বাস্থ্য দফতর। সিএমওএইচ বলেন, “আমাদের অনুমান বর্ধমান জেলার দেড়শোরও বেশি অবৈধ বা স্বাস্থ্য দফতরের অনুমোদনহীন নার্সিংহোম রয়েছে। এই অবৈধ নার্সিংহোমগুলির তালিকা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
জেলা ক্রেতা সুরক্ষা ও কল্যাণ কেন্দ্রের সম্পাদক কুদরাতুল আবেদিনের বক্তব্য, “গত ৮ জুন জেলাশাসকের সঙ্গে বৈঠকে আমরা দাবি করেছিলাম, বর্ধমান শহরে প্রায় সমস্ত নার্সিংহোম ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিক্যাল অ্যাক্ট’ না মেনে চলছে। ওই আইন অনুসারে প্রতি নার্সিংহোমে ২০ জন রোগী পিছু এক জন ২৪ ঘণ্টার আরএমও, ৫ জন রোগী পিছু এক জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স রাখতে হবে। নার্সিংহোমের বাইরের বোর্ডে ওখানে যুক্ত চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশন নম্বর, তাঁদের চিকিৎসা এবং অপারেশনের কত ফি, তা লিখে রাখতে হবে। এতটা যদি করা সম্ভব না হয়, তাহলে ওই আইনের ৬০ ভাগ অন্তত মেনে চলুক নার্সিংহোমগুলি। এমনই দাবি করি আমরা।” তাঁর দাবি, বর্ধমান শহরে বিপিএল তালিকাভুক্তদের অস্ত্রোপচার করাতে পারলেই নগদ ২৫ হাজার টাকা পায় নার্সিংহোমগুলি। সহজে এই টাকা রোজগারে ব্যাঙের ছাতার মতো নার্সিংহোম গজিয়ে উঠছে। তিনি বলেন, “জেলাশাসক যে আমাদের অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে অভিযান শুরু করেছেন, তাতে আমরা খুশি।”