মারণ রোগের মোকাবিলায় প্রথম দিকে ঢিলেমি করে এখন একেবারে তেড়েফুঁড়ে ধরতে চাইছে রাজ্য সরকার।
সোয়াইন ফ্লু-র রোগীদের যথাযথ পরিষেবা না-দেওয়ার অভিযোগে চারটি বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। রোগীদের অবহেলা করলে সরকারি হাসপাতালকেও ছেড়ে কথা বলা হবে না বলে এ বার জানিয়ে দিল স্বাস্থ্য দফতর। ব্যাপারটা শুধু জানানোতেই শেষ হচ্ছে না। এক অন্তঃসত্ত্বাকে হয়রান করার অভিযোগে শাস্তির মুখে পড়তে চলেছে কলকাতা মেডিক্যাল-সহ তিনটি সরকারি হাসপাতাল।
রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে সোমবার জানিয়ে দিয়েছেন, রোগী ফেরানো তো দূরের কথা, থুতুর নমুনা পাঠাতেও বিন্দুমাত্র বিলম্ব বরদাস্ত করা হবে না। শুধু বেসরকারি হাসপাতাল নয়, সোয়াইন ফ্লু-র চিকিৎসায় কোনও সরকারি হাসপাতালও যদি ন্যূনতম গাফিলতি দেখায়, তা হলে তাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করা হবে।
নেহা ঢালি নামে বেহালা চৌরাস্তা এলাকার এক বাসিন্দা সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত এক মহিলাকে তিন-তিনটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি না-করে ঘোরানোর অভিযোগ উঠেছে। ওই মহিলা আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। অভিযোগ পেয়ে শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্য দফতরই রবিবার এম আর বাঙুর হাসপাতালে তাঁর ভর্তির ব্যবস্থা করে। “রোগিণীর পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁদের অভিযোগ একাধিক সরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে। আমরা তদন্ত চালিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব,” আশ্বাস দিয়েছেন স্বাস্থ্যসচিব।
রোগী ফেরানো যাবে না, এই মর্মে স্থায়ী নির্দেশ আছে। তার উপরে সোয়াইন ফ্লু-র রোগিণী এবং তিনি অন্তঃসত্ত্বা। কোন কোন হাসপাতাল ওই রোগিণীকে ঘুরিয়েছে? তাঁকে ভর্তি না-নেওয়ারই বা কারণ কী?
নেহার স্বামী রিপন ঢালি জানান, প্রথমে জোকা ইএসআই হাসপাতাল, তার পরে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতাল এবং শেষে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একাধিক বিভাগ ঘুরিয়ে তাঁদের ফেরত পাঠানো হয়। অথচ স্বাস্থ্য দফতরই ঘোষণা করেছিল, উপসর্গ দেখে যাঁদের সোয়াইন ফ্লু-র সম্ভাব্য রোগী বলে মনে হবে, তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করে নেওয়া হবে। তার পরে থুতু পরীক্ষায় ওই রোগের ভাইরাস মিললে শুরু হবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা। কিন্তু নেহার ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয়নি।
রিপনের কথায়, ৬ মার্চ আইডি হাসপাতাল ফোনে জানায়, তাঁর স্ত্রীর সোয়াইন ফ্লু রিপোর্ট পজিটিভ। কিন্তু তার আগে টানা কয়েক দিন স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে গিয়ে নাজেহাল হয়েছেন তাঁরা। “ওই দিন বিকেলে স্বাস্থ্য দফতর থেকে এক জন ফোন করার পরে সে-কথা জানাই। তার পরেই বাঙুরে নেহার ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়,” বললেন রিপন।
কয়েক দিন ধরেই বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে সোয়াইন ফ্লু-র উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠছে। কারণ হিসেবে বিভিন্ন হাসপাতালের কর্তারা জানান, তাঁদের শয্যার অভাব। স্বাস্থ্যসচিবের বক্তব্য, ‘এটা বাজে অজুহাত’। তিনি বলেন, “সব হাসপাতালেই একটা খালি ঘর, নিদেনপক্ষে বারান্দা এবং কয়েকটা ফোল্ডিং খাট পাওয়া যায়। সেখানে অনায়াসে কিছু বাড়তি রোগীর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যাঁরা ও-সব কথা বলছেন, তাঁদের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। কোনও পরিস্থিতিতেই আমরা সেটা বরদাস্ত করব না।”
স্বাস্থ্য ভবনের এ দিনের অনমনীয় মনোভাবই প্রমাণ করে দিচ্ছে, সোয়াইন ফ্লু নিয়ে এই মুহূর্তে কতটা বেকায়দায় রাজ্য। কোনও দিক থেকেই যাতে সমালোচনার অবকাশ না-থাকে, তা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যকর্তারা এখন মরিয়া। এ দিনও রাজ্যে একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে এই রোগে। বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতালে শিশুটি কয়েক দিন ধরেই ভেন্টিলেশনে ছিল। রাজ্যে এই রোগে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, থুতুর নমুনা পরীক্ষায় এ দিন আরও ১৩ জনের সোয়াইন ফ্লু ধরা পড়েছে। ফলে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ২২৬। তাঁদের মধ্যে ৬৮ জন হাসপাতালে ভর্তি। ২৬ জন সরকারি হাসপাতালে, ৪২ জন বেসরকারি হাসপাতালে।
স্বাস্থ্যকর্তারা জানান, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ আসছে তাঁদের কাছে। চারটি বেসরকারি হাসপাতালকে শো-কজ করা হয়েছে। তাদের শো-কজের জবাব সরকারের মনঃপূত হয়নি। তাই তদন্ত শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল আঙুল তুলছে সরকারি পরিষেবার দিকে। তারা জানিয়েছে, রোগী ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগে তাদের যদি শো-কজ করা হয়, তা হলে সরকারি হাসপাতালগুলি কেন ছাড় পাবে? কেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? এ ক্ষেত্রে তাই কঠোর পদক্ষেপ না-করে উপায় ছিল না।”
স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা বড় অংশই মানছেন, সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী প্রত্যাখ্যানের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এর আগেও অহরহ রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই সরকারি তরফে সেই অভিযোগ নিয়ে তেমন মাথা ঘামানো হয়নি। এখন সোয়াইন ফ্লু-র ক্ষেত্রে সরকার নিজেরাই বেকায়দায় রয়েছে বলে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে।
অসমে সোয়াইন ফ্লুয়ে প্রথম মৃত্যু
অসমে সোয়াইন ফ্লুয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটল যোরহাটে। যোরহাট ট্রেজারি দফতরের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার বিমল দত্ত সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। রবিবার তাঁকে গুয়াহাটি পাঠানো হচ্ছিল। কিন্তু পথেই তাঁর মৃত্যু হয়। প্রশাসনিক সূত্রে খবর, রাজ্যে সোয়াইন ফ্লু আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা এখন চার। পড়শি নাগাল্যান্ডে চার জন, মণিপুরে তিন ও মিজোরামে এক জনের দেশে এইচ১এন১ ভাইরাস ধরা পড়েছে। অসম ছাড়া অন্য রাজ্যে এই রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার পরিকাঠামো না থাকায় আতঙ্ক বেড়েছে। মণিপুরে দুই সন্দেহভাজন ফ্লু আক্রান্তের নমুনা মুম্বইয়ে পাঠানো হয়েছে।