রোগের সঙ্গে যোগ নেই, শুয়োর ধরতে দৌড়

কাজ না-থাকলে ভেরেন্ডা ভাজার কথা শোনা যায়। কিন্তু সোয়াইন ফ্লু-র মোকাবিলা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকা সত্ত্বেও শুয়োর ধরার মতো ভেরেন্ডা কেন ভাজা হচ্ছে, বুঝে উঠতে পারছে না চিকিৎসক শিবির। তাদের বক্তব্য, শুয়োর ধরাটা এ ক্ষেত্রে অবিমিশ্র ভেরেন্ডা ভাজাই। কারণ, সোয়াইন ফ্লু-র সঙ্গে শুয়োরের কোনও যোগাযোগই যে নেই!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৭
Share:

কাজ না-থাকলে ভেরেন্ডা ভাজার কথা শোনা যায়। কিন্তু সোয়াইন ফ্লু-র মোকাবিলা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকা সত্ত্বেও শুয়োর ধরার মতো ভেরেন্ডা কেন ভাজা হচ্ছে, বুঝে উঠতে পারছে না চিকিৎসক শিবির। তাদের বক্তব্য, শুয়োর ধরাটা এ ক্ষেত্রে অবিমিশ্র ভেরেন্ডা ভাজাই। কারণ, সোয়াইন ফ্লু-র সঙ্গে শুয়োরের কোনও যোগাযোগই যে নেই!

Advertisement

এবং সেই ভেরেন্ডা ভাজার কাজটাও যে ঠিকঠাক হচ্ছে, তা নয়। পুরকর্তারা কোমর বেঁধে নেমেও সারা দিনে গোটা কলকাতায় একটি শুয়োরকেও খাঁচাবন্দি করতে পারেননি। মারণ রোগের দাপটের মুখে প্রশাসন যে ঠিক কী করতে চাইছে, শুয়োরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কেন, কেনই বা তাদের সঙ্গে লড়তে নেমে গাত্রে ব্যথা হল, তা নিয়ে বিস্ময় আর বিভ্রান্তি তুঙ্গে।

শুয়োর-বিভ্রান্তির মূলে আছে খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি নির্দেশ। দু’দিন আগেই স্বাস্থ্য, পুর ও পঞ্চায়েত কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে শুয়োর ধরার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। তখনই প্রশ্ন ওঠে, ইংরেজি সোয়াইন শব্দের অর্থ শুয়োর হলেও সোয়াইন ফ্লু-র সঙ্গে শূকরকুলের নাড়ির যোগ তো নেই। তা হলে শুয়োর বেচারাদের ব্যতিব্যস্ত করা কেন?

Advertisement

স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে তড়িঘড়ি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, সোয়াইন ফ্লু নয়, শুয়োর ধরা হবে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ঠেকানোর জন্য। অথচ বৃহস্পতিবার কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় জানালেন, তাঁরা শুয়োর ধরছেন সোয়াইন ফ্লু রুখতেই।

বিস্মিত চিকিৎসকদের প্রশ্ন, শুয়োরের সঙ্গে এখন সোয়াইন ফ্লু-র কোনও যোগ না-থাকা সত্ত্বেও কীসের ভিত্তিতে মেয়র এ কথা বলছেন? মেয়র স্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি।

কী বলছেন চিকিৎসকেরা?

রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর ও পুরসভার শুয়োর পাকড়াও অভিযানকে কেন্দ্র করে চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশই বিস্মিত। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অমিয়কুমার হাটি জানান, শুয়োরের সঙ্গে সোয়াইন ফ্লু-র কোনও যোগ নেই। এক সময় শুয়োরের শ্বাসযন্ত্রে রোগটার জন্ম হয়েছিল। পরে মানুষ, শুয়োর ও পাখির ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস একসঙ্গে মিশে নতুন ভাইরাসের জন্ম দেয়। সেটাই সোয়াইন ফ্লু-র কারণ। “এখন এটা আর শুয়োরের থেকে ছড়ায় না। মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। ফলে শুয়োর ধরে বা মেরে কোনও সুরাহা হবে না,” বলছেন অমিয়বাবু।

একই কথা বলেছেন চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় এবং সুব্রত মৈত্রও। সুব্রতবাবুর কথায়, “সোয়াইন ফ্লু-র বাহক হিসেবে শুয়োরের কথা অন্তত আমার জানা নেই।” আর সুকুমারবাবু বলেন, “এক সময় রোগটা হয়তো শুয়োর থেকে ছড়িয়েছিল। এখন আর শুয়োরের কোনও ভূমিকা নেই।” এই অবস্থায় সোয়াইন ফ্লু নিয়ে প্রচার এবং চিকিৎসা পরিকাঠামো বাড়ানোর দিকে নজর না-দিয়ে রাজ্য সরকার শুয়োর ধরার অভিযানে নামায় তাঁরা হতবাক।

কলকাতার মেয়র শোভনবাবুর দাবি, “সোয়াইন ফ্লু প্রতিরোধের জন্য পুরসভা যথেষ্ট সচেতন। যা করার আমরা করছি।” অথচ সোয়াইন ফ্লু প্রতিরোধ নিয়ে শহরে কোনও হোর্ডিং পড়েনি। কোনও অটোরিকশা বা গাড়িকে পাড়ায় পাড়ায় প্রচার করতেও দেখা যাচ্ছে না। তা হলে মেয়র কী ভাবে বলেন ‘যা করার করছি’?

“আমরা তো সোয়াইন ফ্লু ঠেকানোর জন্য শুয়োর ধরছি,” বলছেন মেয়র। স্বাস্থ্যসচিব, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেছেন, সোয়াইন ফ্লু-র সঙ্গে শুয়োরের যোগ নেই। তা হলে পুরসভা সোয়াইন ফ্লু ঠেকাতে শুয়োর ধরার অভিযানে নামল কেন?

মেয়রের কথা, “সোয়াইন ফ্লু ঠেকাতে কী করা দরকার, তা আমি আনন্দবাজারের কাছ থেকে শিখব না।” আর স্বাস্থ্যসচিব এ দিন এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মানতে এ দিন দলবল নিয়ে শহরে শুয়োর ধরতে নেমে পড়েন পুরকর্তারা। পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগ অবশ্য শুয়োর ধরার কারণ হিসেবে সোয়াইন ফ্লু-র উল্লেখ করেনি। ‘শুয়োর রাখা নিষিদ্ধ’, মাইকে এই ঘোষণাটুকু করেই বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছে পুরসভার দু’টি দল। প্রতিটি দলে ছিলেন ২০ জন সদস্য। তাঁরা স্বাস্থ্য ও জঞ্জাল অপসারণ বিভাগের সদস্য। বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ দু’টি পৃথক দল একবালপুর ও আলিপুর থানায় পৌঁছয়। তার পরে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হয় তাদের অভিযান।

ক’টা শুয়োর ধরা পড়ল?

একটিও নয়। শহরের নানা প্রান্তে শুয়োরেরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু পুর দলের একাংশের বক্তব্য, কোথাও শুয়োর দেখা যায়নি। অন্য অংশ জানায়, শুয়োর ধরার অভিযান চলেছে নাম-কা-ওয়াস্তেই। কারণ, ধরা হলে শুয়োর রাখা হবে কোথায়, সেই সিদ্ধান্ত হয়নি। আজ, শুক্রবার উত্তর কলকাতার দু’টি এলাকায় অভিযান চলবে। পুরকর্তাদের একটা বড় অংশই স্বীকার করেছেন, এই অভিযানের আদতে কোনও মূল্যই নেই। এর চেয়ে সোয়াইন ফ্লু-র উপসর্গ কী কী, উপসর্গ দেখা গেলে মানুষ কোথায় যাবেন, সেই প্রচার চালালে উপকার হত।

এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের সঙ্গে স্বাস্থ্য ভবনের একাংশও অবাক। ওই ভবনের এক অফিসার বলেন, “রাজ্যে রোজ নতুন নতুন এলাকায় সোয়াইন ফ্লু-র রোগী মিলছে। মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। সচেতনতার প্রচার কী ভাবে হবে, এখনই তার পরিকল্পনা তৈরি করা দরকার। অথচ পুরসভা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে শুয়োর ধরতে!”

টালিগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে এ দিন ওই রোগে পদ্মপলাশ দত্ত নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। এই নিয়ে রাজ্যে সোয়াইন ফ্লু-তে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ছয়। কিন্তু রোগ নির্ণয়ের পরিকাঠামোর অভাবে মানুষের যে-ভোগান্তি চলছে, তা নিরসনে স্বাস্থ্য দফতরের উদ্যোগ নেই। স্বাস্থ্যসচিব জানান, আরও ১১ জনের থুতু পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। তাঁদের মধ্যে এক জন উত্তর ২৪ পরগনার, এক জন হাওড়ার এবং ন’জন কলকাতার বাসিন্দা। সোয়াইন ফ্লু-র লক্ষণ নিয়ে আইডি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দাশেত্তারিনি নামে ইন্দোনেশিয়ার এক তরুণী। বুধবার রাতে তিনি শহরে আসেন। তাঁর জাকার্তা যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারতে ঢোকার ভিসা ছিল না। কলকাতায় নামার পরে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিন দিনের জন্য ভারতের ভিসার ব্যবস্থা করে তাঁকে আইডি-তে পাঠানো হয়। তাঁর দেহরস পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।

এর মধ্যে বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতালে এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে ম্যারাপ বাঁধা হলে হইচই পড়ে যায়। যে-হাসপাতালে রোজ সোয়াইন ফ্লু-র উপসর্গ নিয়ে অসংখ্য রোগী আসছে, আক্রান্ত একাধিক শিশু ভর্তি রয়েছে, সেখানে কী ভাবে বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল, সেই প্রশ্ন তোলেন অনেকেই। বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন রোগীদের আত্মীয়েরাও। শেষ পর্যন্ত পুলিশে খবর দেন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ। পুলিশ মণ্ডপ ভেঙে দেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন