রেফার শুনলেই চমকে ওঠেন প্রসূতিরা

ঘটনা ১: বুধবার প্রসব যন্ত্রণা নিয়ে করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন থানারপাড়ার ধোড়াদহের সুপ্রীতি পাল। বৃহস্পতিবার সকালে সুপ্রীতিদেবীর পরিবারের লোকজনকে শুনতে হয়, “এ তো সিজার কেস। এই হাসপাতালে তো হবে না।” এরপরে তাঁকে রেফার করে দেওয়া হয়। বহরমপুরের হাসপাতালে পৌঁছনোর অনেক আগে গাড়ির মধ্যেই স্বাভাবিক প্রসব করেন সুপ্রীতিদেবী।

Advertisement

কল্লোল প্রামাণিক

করিমপুর শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৪ ০২:১৯
Share:

ঘটনা ১: বুধবার প্রসব যন্ত্রণা নিয়ে করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন থানারপাড়ার ধোড়াদহের সুপ্রীতি পাল। বৃহস্পতিবার সকালে সুপ্রীতিদেবীর পরিবারের লোকজনকে শুনতে হয়, “এ তো সিজার কেস। এই হাসপাতালে তো হবে না।” এরপরে তাঁকে রেফার করে দেওয়া হয়। বহরমপুরের হাসপাতালে পৌঁছনোর অনেক আগে গাড়ির মধ্যেই স্বাভাবিক প্রসব করেন সুপ্রীতিদেবী।

Advertisement

ঘটনা ২: মাসকয়েক আগে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে বাড়ি থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে করিমপুর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল চরমেঘনার কবিতা মণ্ডলকে। একই কারণে তাঁকেও রেফার করে দেন চিকিৎসকরা। করিমপুর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উজিয়ে ডোমকলের একটি নার্সিংহোমে ওই মহিলার সিজার হয়।

ঘটনা ৩: বাড়ি থেকে করিমপুর হাসপাতালের দূরত্ব বড়জোর তিন কিলোমিটার। কিন্তু বছর দু’য়েক আগে সন্তান প্রসবের জন্য করিমপুর এলাকার এক প্রসূতিকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার ঘুরতে হয়েছিল। রিমা মণ্ডল নামে ওই প্রসূতি প্রথমে করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে তাঁকে বলা হয় সিজার করতে হবে। সিজারের ব্যবস্থা করিমপুর হাসপাতালে না থাকায় তাঁকে কৃষ্ণনগর সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা প্রশ্ন করেন, স্বাভাবিক প্রসবের জন্য করিমপুর ছেড়ে এখানে কেন? সেখান থেকে ফের করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতাল। অবশেষে সেখানেই স্বাভাবিক প্রসব করেন রিমাদেবী।

Advertisement

করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে সিজারের ব্যবস্থা না থাকায় এমন ভোগান্তি প্রায় রোজনামচা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সীমান্তের এই গ্রামীণ হাসপাতালের উপর প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ নির্ভরশীল। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, দৈনিক গড়ে প্রায় আট জন প্রসূতি ভর্তি হলেও পরিকাঠামোর অভাব ও সিজারের ব্যবস্থা না থাকার কারণে তিন জন প্রসূতিকে অন্যত্র রেফার করতে হয়। এই হাসপাতালে মাত্রাতিরিক্ত রোগীর চাপ থাকলেও বর্তমানে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন মাত্র একজন। চিকিৎসকরা জানান, প্রসূতির অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট হলে কিংবা খিঁচুনি শুরু হলে তাঁরা আর ঝুঁকি না নিয়ে রেফার করে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে সিজারের ব্যবস্থা যে কোনওকালেই ছিল না এমন নয়। স্বাধীনতার বছর দশেক পরেই তৈরি হওয়া এই হাসপাতালে অনেক টালবাহানার পর ২০০৭ সালে সিজার চালু হয়েছিল। তারপর ২০০৮ সালে সিজার করার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন হোগলবেড়িয়ার এক মহিলা। তাঁকে রেফার করা হয় কৃষ্ণনগরে। কিন্তু রাস্তাতেই মারা যান তিনি। ওই মহিলার পরিবারের অভিযোগ, চিকিৎসকের গাফিলতিতেই মারা যান ওই প্রসূতি। মৃতের পরিবার কর্তব্যরত চিকিৎসক, অ্যানাসথেটিস্ট ও নার্সের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেই মামলা আদালতে এখনও বিচারাধীন। ওই ঘটনার পর থেকে করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে সিজার বন্ধ হয়ে রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সবসময় পরিকাঠামোর অভাব দেখিয়ে দায় এড়িয়ে যান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এক প্রসূতির মৃত্যুর পর হাসপাতালে সিজার বন্ধ হয়ে যাওয়া কোনও কাজের কথা নয়। হাসপাতাল কতৃপক্ষ উদ্যোগী হয়ে বিষয়টি জেলা স্বাস্থ্য দফতর কিংবা স্বাস্থ্য ভবনে জানালে এতদিন এই সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। রোগী ও তাঁদের পরিবারের অভিযোগও নেহাত কম নয়। তাঁদের অভিযোগ, কারণে-অকারণে রেফার করাটা এই হাসপাতালের যেন একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুপ্রীতি পালের ভাসুর সুব্রত পাল যেমন বলছেন, “এই হাসপাতালে সিজারের ব্যবস্থা নেই সেটা না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা তাহলে কী ডায়াগনসিস করলেন? তাঁরা বুঝতেও পারলেন না যে স্বাভাবিক প্রসব হবে নাকি সিজার। সিজার হবে বলে রেফার করে দিলেন। অথচ রাস্তাতেই স্বাভাবিক প্রসব হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমরা ডোমকল মহকুমা হাসাপাতালে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম তাই রক্ষে। কোনও একটা অঘটন ঘটে গেলে সে দায় কে নিত?”

হাসপাতালের সুপার রাজীব ঘোষ বলেন, “সমস্যার কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।” আর নদিয়ার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অধীপ ঘোষের দায়সারা জবাব, “রাজ্যের বহু হাসপাতালেই এমন সমস্যা রয়েছে। রয়েছে কর্মীর ঘাটতিও। সেই কারণেই ওখানে সিজার চালু করা যাচ্ছে না।” কিন্তু কবে নাগাদ এই সমস্যা মিটবে? উত্তর মেলেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন