শিশুর অসুস্থতা ও মৃত্যুর হার কমাতে রাজ্য সরকার মহকুমা স্তরের হাসপাতালেও এখন তৈরি হয়েছে নবজাতক ইউনিট। সদ্যোজাতদের চিকিত্সা করার আধুনিক প্রযুক্তি ব্যয়সাধ্য হওয়া সত্ত্বেও, জেলার প্রতিটি প্রধান হাসপাতালে তার ব্যবস্থা করার এক মস্ত কর্মকাণ্ড চলছে গোটা রাজ্য জুড়ে। নতুন নতুন যন্ত্র, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিত্সক ও নার্স জোগানো হচ্ছে।
কিন্তু নবজাতক ইউনিটের বাইরে যে শিশুরা জন্মাচ্ছে, তাদের নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজনটাও তো কম নয়। তারা সংকটাপন্ন অবস্থায় না জন্মালেও, নবজাতকদের সুস্থ রাখার গোড়ার কিছু নিয়ম না মানলে তাদেরও সংকট দেখা দিতে পারে। বিশেষত শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়া (হাইপোথার্মিয়া), তা থেকে নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্ট হয়ে জীবনসংকট আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায়। এই অবস্থা থেকে শিশুকে বাঁচানোর সহজ, ব্যয়হীন পদ্ধতি হল, শিশু জন্মানোর পরেই স্তন্যপান শুরু করিয়ে দেওয়া।
মায়ের গায়ের সঙ্গে লেগে থাকলে শিশুর শরীর গরম থাকে, ঠান্ডা লাগে না। স্তন্যপানের ফলে পুষ্টি পাওয়ায় শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে যায়। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে স্তন্যপান শুরু, এবং ছ’মাস অবধি কেবল স্তন্যপানের পরামর্শই দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-সহ বহু আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংগঠন। এ দেশের স্বাস্থ্যনীতিও তাই বলে।
কিন্তু সব হাসপাতালে কি সব সময়ে যথাসম্ভব শীঘ্র স্তন্যপান শুরু করানোর নীতি মানা করা হচ্ছে? সে বিষয়ে খটকা থেকেই যাচ্ছে। এ দেশে এখন অধিকাংশ শিশু জন্মাচ্ছে হাসপাতালে, কিন্তু জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে স্তন্যপান শুরুর হার ২৫ শতাংশও নয়। তাই প্রশ্ন উঠছে, ডাক্তার-নার্সরাই কি তবে সর্বত্র স্বাস্থ্যনীতি মানছেন না?
আসলে বিভিন্ন হাসপাতালে নানা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, কিছু সাবেকি অভ্যাস রয়েই যাচ্ছে। যেমন লেবার রুমে প্রসবের পর শিশুকে পরিষ্কার করে অন্যত্র ছোট একটি খাটে রেখে দেওয়া। প্রসবের পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো যতক্ষণ না শেষ করে লেবার রুম থেকে ওয়ার্ডে ফিরে যাচ্ছেন মা, ততক্ষণ শিশু তার কাছে আসছে না। ফলে মায়ের কাছে আসার আগে এক ঘন্টারও বেশি কেটে যাচ্ছে। অথচ এখন চিকিত্সকদের মত হল, নাড়ি কাটার আগেই মায়ের বুকে শিশুকে দিয়ে দেওয়া, এবং অন্তত দু’ঘন্টা সেখানেই রাখা দরকার।
বহু বেসরকারি নার্সিং হোম, এমনকী কিছু কিছু হাসপাতালেও শিশুকে গোড়াতেই বোতলে দুধ খাইয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে স্তন্যপানের যে জন্মগত প্রবৃত্তি শিশুর থাকে, তা নষ্ট হয়ে যায়। পরে স্তন্যপান করাতে চাইলেও শিশু তা চায় না। এ ক্ষেত্রে বিপরীত ফল হচ্ছে।
হাসপাতালে প্রচলিত বিধিগুলোকে তাই বদলাতে হবে। যে শিশুদের জন্মের সময়ে শ্বাসকষ্ট নেই, তাদের লেবার রুমেই যাতে মায়ের কাছে দিয়ে দেওয়া যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আশার কথা, আগের চাইতে এখন এর প্রচলন অনেক বেড়েছে। কিন্তু সব হাসপাতালে এটাকে নিয়ম করে তুলতে এখনও অনেক পরিশ্রম করতে হবে। তার প্রয়োজন আরও এই কারণে যে, শিশু জন্মের পরেই স্তন্যপান শুরু করলে তা চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ছ’মাস কেবল স্তন্যপানের বিধি মানা হবে কি না, তার অনেকটাই নির্ভর করে জন্মের পর প্রথম ঘন্টার উপর।
স্তন্যপান যে কেবল শিশুপুষ্টির বিষয় নয়, শিশুসুরক্ষারও বিষয়, তা এতদিনে প্রমাণিত। বছর পাঁচেক আগে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশুবিভাগে একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, কতটা গুঁড়ো দুধে কতটা জল দিতে হয়, তা মাত্র চার শতাংশ মা ঠিকঠাক জানেন। চুয়াল্লিশ শতাংশ মা বলেছিলেন, তাঁদের কোনও ধারণাই নেই। সেই সঙ্গে, বোতল ঠিক মতো জীবাণুমুক্ত করা কঠিন, খরচসাপেক্ষও বটে। ফলে হাসপাতালেই শিশুর মুখে বোতল দিলে শিশুকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেওয়া হয়।
• প্রসবের পরে, নাড়ি কাটার আগেই শিশুকে মায়ের বুকে দেওয়া।
• শিশুর জন্মের পরেই স্তন্যপান শুরু করানো।
• ছ’মাস অবধি কেবল স্তন্যপান।
• জন্মের পর শিশুকে আলাদা বিছানায় রাখা।
• জন্মের পর শিশুকে মধু, তালমিছরি, জল, বোতলে দুধ।
• স্তন্যপানের সঙ্গে কৌটোর দুধ।
লেখক সরকারি হাসপাতালে নবজাতক বিশেষজ্ঞ