মৃতদেহ পড়ে রয়েছে ডাঁই হয়ে। দাহ করার জায়গা নেই। নিয়ম, মর্গ-এর একটি ড্রয়ারে দু’জন প্রাপ্তবয়স্কের মৃতদেহ থাকবে। অথচ, দাহ করতে না পারায় একটি ড্রয়ারে কার্যত ঠেসে-চেপে রাখা হয়েছে ১৭০টি শিশুর দেহ। চার মাস ধরে হাসপাতাল মর্গ-এ পচছে সেই বেওয়ারিশ দেহ। কার্যত দেহ নয়, পচাগলা তাল পাকানো একটা কিছু।
গ্রামগঞ্জের কোনও হাসপাতাল নয়। এ চিত্র কলকাতা লাগোয়া বারাসত জেলা হাসপাতালের। যে হাসপাতাল অত্যাধুনিক করা হচ্ছে বলে ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সমস্যা এড়াতে জেলা প্রশাসন, পুলিশ আধিকারিকদের নিয়ে সম্প্রতি বৈঠকও করেন হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। কিন্তু সুরাহা হয়নি। মর্গ কর্মীদের কথায়, অবস্থা এমন হয়েছে যে দেহের চাপে ড্রয়ারটি ঠিক মতো বন্ধ করা যাচ্ছে না। তবে জ্যোতিপ্রিয়বাবু অবশ্য সোমবার বলেন, “জেলাশাসক, পুলিশ সুপারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিছু দেহ পোঁতা, কিছু দাহ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবেই এই হাল বলে অভিযোগ হাসপাতালের কর্মীদের। নিয়ম অনুযায়ী, কোনও দেহ যদি ১৫ দিনের মধ্যে শনাক্ত না হয় তবে তা বেওয়ারিশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল-মর্গে রাখা হবে। দেখভাল করবেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পুলিশ তা দাহ করা বা পুঁতে ফেলার ব্যবস্থা করবে। গোটা ঘটনা হবে জেলা প্রশাসনের নজরদারিতে। কিন্তু এই দায় কার, তা নিয়ে একে অন্যের দিকে আঙুল তুলেছে তিন দফতরই। হাসপাতাল সুপার অমিতাভ সাহা বলেন, “সমস্যা দ্রুত মেটানোর চেষ্টা চলছে। প্রথমে সব দেহ দাহ করে মর্গ ফাঁকা করে তার পরে নির্দিষ্ট উপায়ে নিয়মিত দাহের ব্যবস্থা হবে।”
কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি? এত দিন বারাসত জেলা হাসপাতালে যে দেহ জমত, তা পুঁতে ফেলা হত পার্শ্ববর্তী টেলিফোন একচেঞ্জের উল্টো দিকে ‘গাদাঘর’-এর মাটিতে। কিন্তু বছর দুই আগে ওই জমি ঘিরে আইনি জটিলতা তৈরি হয়। ওয়াকফ বোর্ড দাবি করে গাদাঘরের ওই জমি খাস নয়, জমিটি তাদের। মামলা দায়ের হয়। এর পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ওই জমিতে ১৪৪ ধারা জারি হয়। ফলে বছরখানেক ধরে সেখানে দেহ পুঁতে ফেলার কাজ বন্ধ হয়ে রয়েছে।
এর পরে মধ্যমগ্রাম সাজিরহাট শ্মশানের কাছে বেওয়ারিশ দেহ দাহ করার সিদ্ধান্ত নেয় জেলা প্রশাসন। কিন্তু চার মাস পরে সেখানেও দাহ বন্ধ হয়ে যায়। একসঙ্গে এত পচাগলা মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া এবং দাহের জন্য এলাকাবাসীরা পরিবেশ দূষণের অভিযোগ তুলে বাধা দেন। জনবসতির মধ্যে গণদাহ হলে পরিবেশের ক্ষতি হবে বলে সরকারও পিছিয়ে আসে। সাজিরহাটে শেষ দাহ হয় জুন মাসে। তার পর থেকে বেওয়ারিশ দেহ দাহ করার আর জায়গা মেলেনি। দেহ জমতে থাকে বারাসত হাসপাতাল মর্গ-এ।
বারাসত জেলা হাসপাতালের মর্গ-এ রয়েছে ৬টি ড্রয়ার। একেকটির আয়তন ৪৪ ঘন ফুট। আইনত এমন একটি ড্রয়ারে দু’টি মৃতদেহ রাখার কথা। আরও নিয়ম, ৩ বছর পর্যন্ত শিশুদের দেহ আলাদা রাখার। কিন্তু মর্গের কর্মীরাই জানালেন, বর্তমানে ৫টি ড্রয়ারে ২৮টি প্রাপ্তবয়স্ক দেহ রয়েছে। বাধ্য হয়েই একমাত্র বাকি ড্রয়ারটিতে ১৭০টি শিশুর দেহ রাখতে রয়েছে।
এ নিয়ে অবশ্য হেলদোল নেই মর্গ কর্মীদেরও। হাসপাতাল সূত্রে খবর, আগে এমন দেহ মর্গ-এর কর্মীরাই দাহ করতেন। বিনিময়ে প্রাপ্তবয়স্ক দেহ পিছু ৫০ টাকা এবং শিশুদের দেহ প্রতি ২০ টাকা পেতেন। কিন্তু কর্মীরা জানিয়েছেন, নতুন সরকার এসে তা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে মৃতদেহের স্তূপ বেড়েই চলেছে হাসপাতালের মর্গে।