শোধরানোর সময় দিয়ে নবান্নে চিঠি ডাক্তারদের

সম্মেলনেই জেহাদ শেষ হল না। এ বার লিখিত ভাবে সরকারকে হুঁশিয়ারি দিলেন প্রতিবাদী ডাক্তারেরা। বদলি-সাসপেনশন নিয়ে সরকারের ‘তুঘলকি স্বেচ্ছাচারের’ বিরুদ্ধে বুধবার সরকারি চিকিৎসকদের বামপন্থী সংগঠনের সভায় আওয়াজ উঠেছিল। স্বাস্থ্যভবনের কর্তাব্যক্তিদের তো বটেই, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী (তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী)-কেও সমালোচনার তিরে বিদ্ধ করা হয়েছিল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৪ ০২:৫৯
Share:

সম্মেলনেই জেহাদ শেষ হল না। এ বার লিখিত ভাবে সরকারকে হুঁশিয়ারি দিলেন প্রতিবাদী ডাক্তারেরা।

Advertisement

বদলি-সাসপেনশন নিয়ে সরকারের ‘তুঘলকি স্বেচ্ছাচারের’ বিরুদ্ধে বুধবার সরকারি চিকিৎসকদের বামপন্থী সংগঠনের সভায় আওয়াজ উঠেছিল। স্বাস্থ্যভবনের কর্তাব্যক্তিদের তো বটেই, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী (তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী)-কেও সমালোচনার তিরে বিদ্ধ করা হয়েছিল। আর বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য-প্রতিমন্ত্রীকে চিঠি লিখে প্রতিবাদীরা জানিয়ে দিলেন, ভুল শোধরানোর জন্য সরকারকে তাঁরা কিছুটা সময় দিচ্ছেন। এর মধ্যে দাবি পূরণ না-হলে ওঁরা আন্দোলনের পথে যাবেন।

এ হেন ‘হুমকি’ অবশ্য স্বাস্থ্যভবনকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। তাঁদের পাল্টা হুঁশিয়ারি: সরকারি ডাক্তারেরা আন্দোলনে নামলে সরকারও কড়া ব্যবস্থা নেবে। বুধবারের কনভেনশনে চিকিৎসকদের হাজিরা সম্পর্কে কটাক্ষ করে এ দিন রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চিকিৎসকের সংখ্যা দশ হাজারের বেশি। ষাট-সত্তর জন কী বললেন, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়।” তবে অধিকর্তার এ-ও বক্তব্য, “ওই ক’জনও আন্দোলনের পথে গেলে সরকার লঘু ভাবে নেবে না। এই বার্তাটা স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার।”

Advertisement

অধিকর্তার কটাক্ষ শুনে প্রতিবাদীরা জানিয়েছেন, তাঁদের ক্ষমতাকে নিছক সংখ্যার নিরিখে বিচার করা ভুল হবে। ওঁদের দাবি, বহু চিকিৎসক কনভেনশনে আসতে না-পারলেও সংগঠনের দাবি-দাওয়ার প্রতি তাঁদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। প্রয়োজনে তাঁরাও আন্দোলনে ঝাঁপাতে দ্বিধা করবেন না। বামপন্থী সরকারি চিকিৎসকদের ওই সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব হেল্থ সার্ভিস ডক্টর্স (এএইচএসডি)-এর সভাপতি গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “সংখ্যাটা ফ্যাক্টর নয়।

মুখ্যমন্ত্রী যখন মুখ্যমন্ত্রী হননি, তখন তো তাঁর চারপাশে এত মানুষ ছিলেন না! অল্প কয়েক জনকে নিয়ে আন্দোলন চালিয়েই তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। আমাদেরও তাই পিছিয়ে আসার প্রশ্ন নেই।”

এএইচএসডি’র কনভেনশনে দাবি উঠেছিল, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের অধ্যক্ষ, সুপার ও দুই জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য-আধিকারিকের সাসপেনশন প্রত্যাহার করতে হবে। ওঁরা সাম্প্রতিক এনসেফ্যালাইটিস-পরিস্থিতি সংক্রান্ত তথ্য স্বাস্থ্যভবনের কাছে গোপন করেছিলেন বলে নবান্নের অভিযোগ, যা মানতে অ্যাসোসিয়েশন নারাজ। উল্টে তারা তথ্য গোপনের দায়ে স্বাস্থ্যভবনের কর্তাদেরই কাঠগড়ায় তুলেছে। ‘বেছে বেছে’ সিপিএম সমর্থক ডাক্তারদের বদলির অভিযোগ তুলে কনভেনশনে বলা হয়েছিল, ‘প্রতিহিংসা’র নীতি থেকে সরকারকে সরতে হবে, এবং দেখতে হবে, তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক সংগঠনের নেতারা যেন বদলি-পদোন্নতির নিয়ন্তা হয়ে না-ওঠেন। সরকারি ডাক্তারদের জন্য ফের স্বেচ্ছাবসর চালুরও দাবি ওঠে।

এ দিন এই সব দাবি-দাওয়া চিঠির আকারে নবান্নে পাঠানো হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাস্থ্য-প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের কাছে। এএইচএসডি-র সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ চক্রবর্তী বলেছেন, প্রতিবাদের মাসুল হিসেবে তাঁরা সরকারি শাস্তির মুখে পড়তে পারেন জেনেও এগিয়েছেন। “সরকারের উচ্চ পদে যাঁরা আছেন, আশা করি তাঁরা সংঘাতের পথে যাবেন না। আমরা ওঁদের সময় দিয়েছি। আশা করি, তার মধ্যে ওঁরা দাবি মেনে নেবেন।” মন্তব্য সত্যজিৎবাবুর। যদিও সংগঠনের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা কত দিনের, সে সম্পর্কে চিকিৎসক-নেতা স্পষ্ট কিছু জানাননি।

বস্তুত নতুন সরকারের আমলে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য-আধিকারিকদের শাস্তির একাধিক ঘটনা ঘিরে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। এর আগে বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি-র তৎকালীন অধিকর্তা শ্যামাপদ গড়াইকে শো-কজ না-করে সাসপেন্ড করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। এ বার উত্তরবঙ্গের চার স্বাস্থ্যকর্তাকেও আচমকা সাসপেনশনের নোটিস ধরানো হয়েছে। প্রতিবাদীদের বক্তব্য, শো-কজ না-করে এবং তদন্ত শুরুর আগেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না-দিয়ে শাস্তি দেওয়া যায় না। স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর অবশ্য যুক্তি, “সাসপেনশন কোনও শাস্তি নয়। বিভাগীয় তদন্ত শুরু হলে ওঁরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন।” একই যুক্তি বুধবার দিয়েছিলেন স্বাস্থ্য-সচিব মলয় দে। এ দিন সচিবের মন্তব্য, “দফতর এ ভাবে তড়িঘড়ি কোনও কাজ করে না। কোনও সিদ্ধান্ত হলে প্রকাশ্যেই জানানো হবে।”

শ্যামাপদবাবুকে কি পরে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে?

শ্যামাপদবাবু এ দিন বলেন, “সাসপেন্ড করার তিন মাস বাদে আমাকে শো-কজ করা হয়। তার তিন মাস বাদে চার্জশিট। তারও তিন মাসের মাথায় স্রেফ এক বার তদন্ত কমিশনের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ এসেছিল। তখন যেটুকু বলার, বলেছি।” তাঁর অভিযোগ, আজ পর্যন্ত তিনি সরকারকে তিনটে চিঠি দিয়েও কোনও জবাব পাননি। ২০১১-র ২৬ মে-র পরে তিনি সরকারের থেকে বেতনও নেননি বলে জানিয়েছেন শ্যামাপদবাবু।

পাশাপাশি বিভিন্ন হাসপাতালের ১৭৬ জন ডাক্তারকে বদলির সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত ঘিরেও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ওঁদের মধ্যে উত্তরবঙ্গের অন্তত ১৯ জন। অভিযোগ: এই সিদ্ধান্তে এনসেফ্যালাইটিসে জর্জরিত উত্তরবঙ্গে চিকিৎসা-পরিষেবা ব্যাপক ধাক্কা খেয়েছে শুধু নয়, বহু ক্ষেত্রে বেছে বেছে বামপন্থী সংগঠনের ডাক্তারদের বদলি করা হয়েছে। “আমাদের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা চলছে যে, স্রোতে গা না-ভাসালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” বললেন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের এক চিকিৎসক। আরজিকরের এক শিক্ষক-চিকিৎসকের আক্ষেপ, “নিয়ম অনুযায়ী ২৫ জন ছাত্রপিছু এক জন ডেমনস্ট্রেটর থাকার কথা। অর্থাৎ, দু’শো পড়ুয়ার জন্য আট জন। অথচ এখানে অধিকাংশ বিভাগে দু’-তিন জনের বেশি নেই। তাঁদেরও বদলির তালিকায় ফেলায় পরিষেবা, পঠনপাঠন সবই শিকেয় উঠতে চলেছে।”

পরিকাঠামোর এমন দুঃসময়েও সরকার বদলির অস্ত্রে আক্রোশ মেটাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ওই শিক্ষক-চিকিৎসক। সরকারি চিকিৎসকদের একাংশের আরও অভিযোগ, মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)-এর অনুমতির জন্য নানা হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের যে সব ডাক্তারের নামের তালিকা কাউন্সিলকে পাঠানো হয়েছিল, বদলির দরুণ তাঁরা অনেকেই আর সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে থাকছেন না।

এমতাবস্থায় চিকিৎসকদের অনেকের আশঙ্কা, এনসেফ্যালাইটিসের ডামাডোল মিটে গেলে এমসিআই-অনুমোদন নিয়ে রাজ্য আবার ঘোরতর ফাঁপরে পড়বে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন