শূন্য ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের জন্য হাহাকার

ব্লাড ব্যাঙ্কের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন হাঁসখালির ফুলবাড়ির বাসিন্দা অলোক বিশ্বাস। তাঁর ভাই বছর তেইশের অমিত থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। তিন দিন ধরে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে ঘুরছেন রক্তের জন্য। কিন্তু ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত নেই। অগত্যা প্রতিবেশী এক যুবককে রাজি করিয়ে নিয়ে এসেছেন রক্ত দেওয়ার জন্য। রক্ত পরীক্ষা করে এখনও উপযুক্ত কি না নির্ধারিত হয়নি।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৪ ০১:২৭
Share:

ব্লাড ব্যাঙ্কের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন হাঁসখালির ফুলবাড়ির বাসিন্দা অলোক বিশ্বাস। তাঁর ভাই বছর তেইশের অমিত থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। তিন দিন ধরে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে ঘুরছেন রক্তের জন্য। কিন্তু ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত নেই। অগত্যা প্রতিবেশী এক যুবককে রাজি করিয়ে নিয়ে এসেছেন রক্ত দেওয়ার জন্য। রক্ত পরীক্ষা করে এখনও উপযুক্ত কি না নির্ধারিত হয়নি। বিধ্বস্ত অলোকবাবু বলেন, ‘‘রক্তটা আজই দিতে হবে। কোনও কারণে এই রক্ত যদি না দেওয়া যায় বিপদে পড়ে যাব।’’

Advertisement

দিন কয়েক ধরে এভাবেই এক বোতল রক্তের জন্য নদিয়ার শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের সামনে মাথা খুঁড়ছেন অজস্র মানুষ। সকাল থেকে গভীর রাতব্লাড ব্যাঙ্কের সামনে ভিড় করে আছেন তাঁরা। কিন্তু ভোট আর গরমের জাঁতাকলে রক্ত শূন্য ব্লাড ব্যাঙ্ক।

নদিয়ার জেলা হাসপাতালে এই ব্লাড ব্যাঙ্কের উপরে নির্ভর করে আছে তেহট্ট ও কৃষ্ণনগর সদর মহকুমা ছাড়াও রানাঘাট মহকুমার হাঁসখালি ও শান্তিপুর ব্লকের লোকজন। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ বোতল রক্ত লাগে। এই মাসে শেষ বার রক্তদান শিবির হয়েছে ২৩ মে। তা-ও সেই শিবির থেকে মাত্র ২১ বোতল রক্ত সংগ্রহ হয়েছিল। তার আগে ১৭ মে একটা শিবির হয়েছিল। সেখানে রক্ত সংগ্রহ হয়েছিল ৪৫ বোতল। সেই সামান্য রক্ত দিয়ে কোনও মতে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু ২৩ মে-র পর আর কোনও শিবির হয়নি। পরপর ছ’টা শিবির বাতিল করেছে আয়োজক সংস্থাগুলি। আর রক্ত সংগ্রহ না হওয়ায় ফ্রিজ খাঁ খা।ঁ এক বোতলও রক্ত নেই ফ্রিজে। মে মাসে সব মিলিয়ে ২০টি রক্তদান শিবির থেকে যে ছ’শো বোতল রক্ত সংগ্রহ হয়েছিল, তা শেষ। ব্লাড ব্যাঙ্কের এক কর্মী বলেন, ‘‘প্রতি মাসে শিবিরের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু চাহিদা কমেনি। ফলে আমাদের সংগ্রহে কিছু থাকছে না। শিবির বন্ধ হতেই রক্তের ভাঁড়ার শূন্য হয়ে গিয়েছে।”

Advertisement

রক্তদান শিবির হচ্ছে না কেন?

জানা গিয়েছে, ভোটের কারণে এপ্রিল ও মে মাসে রাজনৈতিক দলের শাখা সংগঠনগুলি রক্তদান শিবির করতে পারেনি। যে সব ক্লাব বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে থাকে, তারাও প্রচণ্ড গরমে শিবির বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। হাসপাতালের সুপার হিমাদ্রী হালদার বলেন, “নির্বাচনের কারণে এমনিতেই রক্তদান শিবির কম হয়। তার উপরে এবার গরমের কারণে অনেক শিবির বাতিল করে দিয়েছেন আয়োজকরা। ফলে রক্তের জোগান বন্ধ হয়ে গিয়েছে।”

এই জেলায় যারা নিয়মিত রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে, তাদের মধ্যে অন্যতম ডিওয়াইএফআই। সংগঠনের জেলা সম্পাদক সুমিত বিশ্বাস বলেন, ‘‘নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ হবে বলে আমরা ওই সময় শিবির করতে পারিনি। এই মাসে দু’টি শিবির গরমের জন্য বাতিল করতে বাধ্য হয়েছি। তবে সামনের মাস থেকে আবার পুরোদমে শিবির করে সমস্যার মোকাবিলা করব। আমরা প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছি।’’

কিন্তু অন্য কেউ রক্তদান শিবিরের আয়োজন না করলে হাসপাতালের দায়িত্ব শিবির করে রক্ত সংগ্রহ করার। এক্ষেত্রে কেন সেটা হল না? সুপার বলেন,‘‘উপযুক্ত পরিকাঠামো ও কর্মী সঙ্কটের কারণেই আমরা সেটা করে উঠতে পারছি না। তবে আশা করছি দু’এক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’’

এই অবস্থায় রোগীর পরিজনদের রক্তদাতা নিয়ে আসতে বলছেন ব্লাড ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। ২৬ মে থেকে ব্লাড ব্যাঙ্কের ভিতরেই শুরু হয়েছে রক্ত সংগ্রহ। চার দিনে এভাবে ৫৩ বোতল রক্ত সংগ্রহ হয়েছে। যার সবটুকুই ব্যবহার হয়ে গিয়েছে। হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘ভাগ্য ভাল যে এই ক’দিনে তেমন কোনও বড় দুর্ঘটনা ঘটেনি। ব্লাড ব্যাঙ্কের যা অবস্থা তাতে দুর্ঘটনায় মুমুর্ষু রোগীরা ভর্তি হলে চরম সঙ্কট তৈরি হত।’’

এ দিকে, থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তদের জন্য মাসে প্রায় আড়াইশো বোতল রক্ত লাগে। এই মাসে এখনও পর্যন্ত মাত্র ৭৮ বোতল রক্ত দেওয়া গিয়েছে। বাকিদের অবস্থা ফুলবাড়ির অমিতের মতো।

শান্তিপুরের বিশ্বনাথ দত্তের এক আত্মীয়ার জরায়ুতে টিউমার অপারেশন হবে। রক্তের অভাবে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। রক্তের জন্য ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মীদের হাতে-পায়ে ধরছেন বিশ্বনাথবাবু। তাতেও কিছু না হওয়ায় টাকার প্রস্তাবও দিয়েছেন। না, তাতেও লাভ হয়নি।

টাকা দিয়ে সব কিছু পাওয়া যায় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন