শহরে সোয়াইন ফ্লুয়ের প্রথম শিকার দুই মহিলা

মুম্বই থেকে এসেছিলেন এক মহিলা। অন্য মহিলা হুগলির বাসিন্দা। সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত হয়ে বুধবার মৃত্যু হয়েছে দু’জনেরই। একই সঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছে ভিন্ রাজ্য থেকে ওই রোগ আসার ধারণা এবং সেই ধারণা থেকে জন্মানো সন্তুষ্টি। এই মুহূর্তে যে সারা রাজ্যে মোট ১০ জন সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত, উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে সেই তথ্যও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা ও চন্দননগর শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:২৭
Share:

মুম্বই থেকে এসেছিলেন এক মহিলা। অন্য মহিলা হুগলির বাসিন্দা। সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত হয়ে বুধবার মৃত্যু হয়েছে দু’জনেরই। একই সঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছে ভিন্ রাজ্য থেকে ওই রোগ আসার ধারণা এবং সেই ধারণা থেকে জন্মানো সন্তুষ্টি। এই মুহূর্তে যে সারা রাজ্যে মোট ১০ জন সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত, উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে সেই তথ্যও।

Advertisement

সংক্রমণে দুই মহিলারই মৃত্যু হয়েছে কলকাতার দু’টি বেসরকারি হাসপাতালে। তাঁদের মধ্যে এক জন আদতে মুম্বইয়ের বাসিন্দা। একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। ঢাকুরিয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। আর হুগলির মহিলা ভর্তি ছিলেন ভবানীপুরের একটি নার্সিংহোমে। ওই দু’জনের প্রাণহানির সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যে ১০ জনের শরীরে সোয়াইন ফ্লু-র ভাইরাস শনাক্ত করা গিয়েছে বলে স্বাস্থ্য দফতরের খবর।

জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে গত জুলাইয়ে ছড়িয়ে পড়া একটি রোগে উত্তরবঙ্গে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। উত্তরবঙ্গ থেকে ঠিক সময়ে খবর না-আসায় পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছিল। তার জন্য উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েক জন স্বাস্থ্যকর্তাকে বদলি করে দেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই রোগের স্বরূপ-সন্ধানে দিল্লির বিশেষজ্ঞদল এসেছিল। কিন্তু রোগটির রহস্য থেকেই গিয়েছে।

Advertisement

সোয়াইন ফ্লু নিয়ে যাতে তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি যাতে না-হয়, তার জন্য স্বাস্থ্য ভবন এ বার বাড়তি সতর্কতা নিচ্ছে। সোয়াইন ফ্লু-র উপসর্গ চিহ্নিত করার ব্যাপারে ডাক্তারদের বিশেষ ভাবে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওই পরীক্ষা করা যাবে না। আপাতত এ রাজ্যে শুধু ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজ (নাইসেড)-এই ওই পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে নমুনা পাঠানো হচ্ছে সেখানেই।

বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে সোয়াইন ফ্লু-র চিকিৎসায় পৃথক ওয়ার্ড খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য ভবন। এই ধরনের কোনও রোগী ভর্তি হলেই দ্রুত স্বাস্থ্য ভবনে তা জানানোর জন্য সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতালকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে বলেন, “আমরা পরিস্থিতির উপরে নজর রাখছি।” বঙ্গবাসী যাতে অযথা আতঙ্কিত হয়ে না-পড়েন, সেই আবেদন জানিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারা।

গত সেপ্টেম্বরেও রাজ্যে সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত তিন রোগীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। তিন জনেই ভর্তি ছিলেন ই এম বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে। তাঁদের মধ্যে এক জন ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা। সেই রোগী মারা যান। তখনও বলা হয়েছিল, রোগটি এসেছে ভিন্ রাজ্য থেকে। কিন্তু পরে এ রাজ্যেরই দু’জনের শরীরে ওই রোগের ভাইরাস ধরা পড়ে। তখন তৎপরতা শুরু হয়।

এ বারেও মুম্বইয়ের মহিলা বেশ কয়েক দিন ভর্তি ছিলেন ঢাকুরিয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, এক সপ্তাহ ধরে তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। বুধবার সকালে তিনি মারা যান। ওই মহিলা অন্য রাজ্যের বাসিন্দা বলে দায় এড়ানোর উপায় থাকছে না। কারণ, এ দিনই ভবানীপুরের একটি নার্সিংহোমে সোয়াইন ফ্লু সংক্রমণে মৃত রূপালি ঘোষ খাস বাংলারই বাসিন্দা। বাড়ি হুগলিতে। ২৮ জানুয়ারি আত্মীয়ের বিয়েতে হাওড়ার রামরাজাতলায় যান তিনি। সেখানে তাঁর জ্বর হয়। পরের দিন স্থানীয় এক চিকিৎসককে দেখিয়ে বাড়ি ফেরেন। জ্বর, সর্দি-কাশি বেড়ে যায়। ৩০ তারিখে তাঁকে স্থানীয় এক চিকিৎসকের পরামর্শে চন্দননগরের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়।

কয়েক দিন পরে রূপালিদেবীকে শ্রীরামপুরের শ্রমজীবী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ভবানীপুরের নার্সিংহোমে নিয়ে যান বাড়ির লোকেরা। ওই নার্সিংহোমের তরফে আইডি হাসপাতালে মহিলার রক্ত পরীক্ষা করানো হয়। তাতেই সোয়াইন ফ্লু ধরা পড়ে। বুধবার সকাল ৮টা নাগাদ মহিলার মৃত্যু হয়। দুপুরে হুগলির উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক (২) অরবিন্দ তন্ত্রী তাঁর বাড়িতে যান। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। তিনি বলেন, “ওই এলাকায় শুয়োর বিশেষ নেই। তা সত্ত্বেও কী ভাবে মহিলার শরীরে ওই ভাইরাস এল, সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” সোয়াইন ফ্লু-র উপসর্গ কী কী এবং তার মোকাবিলায় কী কী করা উচিত, তা নিয়ে এ দিন ওই এলাকায় প্রচারপত্র বিলি করে স্বাস্থ্য দফতর।

মূলত শুয়োরই সোয়াইন ফ্লু-র এইচ১এন১ ভাইরাসের বাহক। ২০০৯ সালে ভাইরাসের চরিত্র বদলের ফলে শুয়োর থেকে রোগটি ছড়াতে শুরু করে মানুষের মধ্যে। হাঁচি-কাশির মাধ্যমেও ছড়ায় এই রোগ। স্বাস্থ্য দফতরের খবর, ২০১০-এই প্রথম এ রাজ্যের অন্তত ৬৩ জন আক্রান্ত হন এই ভাইরাসে। মারা যান পাঁচ জন। ২০১৩-র এপ্রিলে আক্রান্ত হন ৪০-৪২ জন। প্রাণ হারান তিন জন। তার পরে গত সেপ্টেম্বরে এ রাজ্যে সোয়াইন ফ্লু ধরা পড়ে তিন জনের মধ্যে।

২০১৫-র শুরু থেকে অনেক রাজ্যেই রোগটি ফের ছড়াতে শুরু করেছে। এ দিন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনেই সারা দেশে সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন ২১৬ জন। এই নিয়ে চলতি বছরে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ৪০৭। এই দফায় মুম্বই-সহ মহারাষ্ট্র এবং তেলঙ্গানায় বেশ কিছু মানুষ সোয়াইন ফ্লুয়ে মারা গিয়েছেন। বিকানের ও অজমেরের তিন বাসিন্দা এবং জয়পুর, বারমের, কোটা, উদয়পুর, বাঁশওয়ারা ও চিতোরগড়ের চার জন করে বাসিন্দার মৃত্যু হয়েছে ওই রোগে। মুম্বইয়ে ২৩ জন সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত। সেখানে মৃত্যু হয়েছে চার জনের। তেলেঙ্গনায় ৩৯ জন সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত। রোগটি দ্রুত ছড়াচ্ছে গুজরাতেও।

পরিস্থিতি সব থেকে খারাপ রাজস্থানে। গত দু’দিনে ওই রাজ্যে সোয়াইন ফ্লুয়ে মারা গিয়েছেন ৮১ জন। এক মাসের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৭০০। স্বাস্থ্য দফতরের খবর, ওই রাজ্যের ৩৩টি জেলার মধ্যে ২৯টির বহু মানুষ সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত। স্বাস্থ্য আধিকারিকদের সঙ্গে মঙ্গলবার রাতে জরুরি বৈঠকে বসেন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া। সোয়াইন ফ্লু রুখতে জেলা ও রাজ্য স্তরে সচেতনতা বাড়ানোর বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন তিনি।

বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর তরফে তেমন উদ্যোগ এখনও দেখা যায়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন