শুধুই সাইনবোর্ড। —নিজস্ব চিত্র
এ রাজ্যে সরকারি পরিকাঠামোয় বন্ধ্যত্ব চিকিত্সার যে কেন্দ্র নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হওয়ার কথা ছিল, তা বাতিল করল স্বাস্থ্য দফতর। দীর্ঘ ১০ বছর নানা টালবাহানার পরে শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁদের পরিকল্পনায় ওই প্রকল্পটির এখন আর কোনও ঠাঁই নেই। কেন রাজ্যের এই মত বদল, সে ব্যাপারে স্বাস্থ্যকর্তারা স্পষ্ট ভাবে কিছু জানাননি।
বাম আমলে পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল ওই কেন্দ্রের জন্য। স্থির হয়েছিল, বন্ধ্যত্ব নিয়ে গবেষণা এবং চিকিত্সার উত্কর্ষকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে ওই প্রকল্প। বর্তমানে বাধাটা ঠিক কোথায়, সে সম্পর্কে স্বাস্থ্যকর্তারা নীরবই থেকেছেন।
ওই কেন্দ্রের মুখ্য পরামর্শদাতা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল বন্ধ্যত্ব চিকিত্সক বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর নাম। বেশ কয়েক বার তাঁকে এনআরএসে নিয়েও যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার পরে পরামর্শমতো কিছুই হয়নি। বৈদ্যনাথবাবু বলেন, “আমি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু ধাপে ধাপে সবটাই ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। এমনকী, কেন্দ্রটা আদৌ হচ্ছে কি না, সেটাও আমাকে কোনও দিন জানানো হয়নি। এখন আপনাদের কাছ থেকে শুনছি যে, কিছুই হবে না।”
ওই কেন্দ্রটি ভারতে নলজাতকের স্রষ্টা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত হওয়ার কথা ছিল। জীবদ্দশায় স্বীকৃতি পাননি সুভাষবাবু। মৃত্যুর কয়েক বছর পরে বামফ্রন্ট সরকার তাঁর প্রতি সম্মান জানাতে কেন্দ্রটি চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও একাধিক বার জানিয়েছেন, সুভাষবাবুকে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দিতে চান তাঁরা। তা হলে কেন্দ্রটি হচ্ছে না কেন? স্বাস্থ্যকর্তারা এর কোনও স্পষ্ট উত্তর দেননি। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “ওই কেন্দ্র নিয়ে আমাদের আর কোনও ভাবনাচিন্তা নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুভাষবাবুর নামে একটা চেয়ার করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। দেখা যাক, কী হয়।”
১৯৮১ সালে সুভাষবাবুর মৃত্যু হয়। তার কয়েক বছর পর থেকেই তাঁর নামে একটি কেন্দ্র গড়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন তাঁর পরিবার এবং সহকারী চিকিত্সকেরা। বহু চেষ্টাচরিত্রের পরে ২০০৫ সালের ৩১ মে স্বাস্থ্য দফতরে এই সংক্রান্ত একটি ফাইল পাশ হয়। এনআরএস হাসপাতালে কেন্দ্রটি তৈরি হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১১ সালে তত্কালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র উদ্বোধন করেন। তার পরে কাজ আর কিছু এগোয়নি। হাসপাতাল চত্বরের ভিতরে একটি বাড়ির গায়ে একটি বোর্ড। এখনও সম্বল বলতে এটুকুই।
এনআরএসের স্ত্রীরোগ বিভাগের বর্তমান প্রধান নবেন্দু ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। বিভাগের প্রবীণ চিকিত্সকেরাও জানিয়েছেন, তাঁরা শুনেছিলেন এমন কিছু একটা হতে চলেছে। কিন্তু তার পরে আর কিছু জানতে পারেননি। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও এমন একটি কেন্দ্র গড়তে উদ্যোগী হয়েছিলেন সেখানকার চিকিত্সকেরা। কয়েকটি ফাইল চালাচালির পরে সেই প্রকল্পও আপাতত বস্তাবন্দি।
বন্ধ্যত্ব চিকিত্সক তথা রাজ্যের মন্ত্রী সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার বলেন, “সরকারি পরিকাঠামোয় বন্ধ্যত্বের চিকিত্সাকেন্দ্র হওয়া খুব কঠিন। কারণ বিপুল খরচ। কোষাগারের যে হাল পেয়েছি, তাতে এমন প্রকল্প কঠিন। আগের সরকারের আমলে কী সিদ্ধান্ত হয়েছিল, জানি না। বর্তমান সরকারের আমলেই ওঁর নামে চেয়ারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেটাও যথেষ্ট সম্মানের।”
সুভাষবাবুর অন্যতম সহকারী ও তাঁর টিমের একমাত্র জীবিত সদস্য সুনীত মুখোপাধ্যায় গোটা বিষয়টিতে খুবই হতাশ। তাঁর কথায়, “একটি খালি ঘরে নিয়মরক্ষার মতো করে একটি বোর্ড টাঙানো হয়েছিল। গত ১০ বছরে আর কিছুই হয়নি। এর চেয়ে লজ্জার কী আছে?” সুনীতবাবু জানিয়েছেন, সুভাষবাবুর উপরে হওয়া সমস্ত অবিচার নিয়ে তিনি একটি বই লিখেছেন। শুক্রবার সেটিও প্রকাশিত হচ্ছে।
আজ, ১৬ জানুয়ারি সুভাষবাবুর জন্মদিন। এই উপলক্ষে একটি বক্তৃতাসভার আয়োজন করেছে সুভাষ মুখোপাধ্যায় মেমোরিয়াল রিপ্রোডাক্টিভ বায়োলজি রিসার্চ সেন্টার। বিষয় সিঙ্গল এমব্রায়ো ট্রান্সপ্ল্যান্ট। ওই সভার বক্তা স্ত্রীরোগ চিকিত্সক গৌতম খাস্তগির। ঘটনাচক্রে সম্প্রতি এসএসকেএম হাসপাতালে বন্ধ্যত্ব চিকিত্সার একটি কেন্দ্রের কাজ শুরু করার দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি। গৌতমবাবু বলেন, “আমি নিজে থেকে স্বাস্থ্য দফতরে চিঠি লিখে সরকারি পরিকাঠামোয় কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম। এসএসকেএমের কথাও আমিই বলেছিলাম। ওঁরা সম্মত হয়েছেন। আমি আশাবাদী। কম খরচে বন্ধ্যত্বের চিকিত্সার ব্যবস্থা হবেই।”