অগ্নিদগ্ধ মানুষের চিকিত্সার জন্য একাধিক সরকারি হাসপাতালে বার্ন ইউনিট খোলা হচ্ছে। কিন্তু সেই সব ইউনিটে ভর্তি হওয়া রোগীর যদি চামড়া প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়, তখন তা আসবে কী করে? কারণ, রাজ্যের একমাত্র স্কিন ব্যাঙ্কে আর একটিও চামড়া সংরক্ষিত নেই।
২০১৩-র এপ্রিল মাসে চালু হওয়ার পরে প্রায় দু’বছর কাটতে চলেছে, এত দিনে এসএসকেএম হাসপাতালে রাজ্যের সবেধন স্কিন ব্যাঙ্কটিতে জমা পড়েছিল সাকুল্যে ৫টি চামড়া। তা ব্যবহার হয়ে গিয়েছে। গত প্রায় দেড় মাস ভাঁড়ার একেবারে খালি। এরই মধ্যে ঘটা করে এম আর বাঙুর হাসপাতালে ৪০ শয্যার আধুনিক বার্ন ইউনিট খোলা হয়েছে। এপ্রিলে সেখানে অস্ত্রোপচার শুরু হবে। কিন্তু প্লাস্টিক সার্জেনরা জানাচ্ছেন, চামড়াই যদি না-পাওয়া যায় তা হলে অস্ত্রোপচার শুরু করা ভস্মে ঘি ঢালার সামিল।
অগ্নিদগ্ধ রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এখনও পশ্চিমবঙ্গে কঠিন। কারণ, প্রায় কোনও বেসরকারি হাসপাতালই তাঁঁদের ভর্তি নিতে চায় না। সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে যে ভাবে অন্য রোগীদের থেকে তাঁঁদের পৃথক করে রাখতে হয়, সেই দায়িত্ব এড়াতে চায় বেশির ভাগ হাসপাতাল। একটা সময় পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালগুলির মধ্যে একমাত্র এসএসকেএমে আলাদা বার্ন ওয়ার্ড ছিল। তাতে শয্যাসংখ্যা মোট ৩০। সেখানেও বহু রোগীকে চামড়া প্রতিস্থাপন করা না যাওয়ায় বাঁচানো যেত না। এ নিয়ে সমালোচনা বাড়তে থাকায় ২০১৩ সালের ২২ এপ্রিল এসএসকেএম হাসপাতালে স্কিন ব্যাঙ্ক চালু হয়। তার ২ বছরের মাথায়, সম্প্রতি এম আর বাঙুর হাসপাতালে চালু হয়েছে এসএসকেএম-এর বার্ন ইউনিটের স্যাটেলাইট ইউনিট।
বাঙুর হাসপাতাল সূত্রের খবর, সেখানে বার্ন ইউনিট খোলা মাত্র মালদহ, দার্জিলিং, দিনাজপুর, হুগলি, বর্ধমান, পুরুলিয়া জায়গা থেকে দলে-দলে রোগী আসতে শুরু করেছেন। জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। সব শয্যা ভর্তি। এসএসকেএম থেকে চিকিত্সকেরাই তাঁদের চিকিত্সা করতে আসছেন। কিন্তু সামনের মাস থেকে কী হবে, তা নিয়ে ডাক্তারেরা চিন্তিত। কারণ, স্কিন ব্যাঙ্ক এখন চামড়াশূন্য। চিকিত্সকদের কথায়, “ছোট শিশুর চামড়া লাগলে তার বাবা বা মায়ের থেকে নেওয়া যায়। কিন্তু বড়দের ক্ষেত্রে সেটা হয় না। এমন অনেক রোগী আসেন যাঁরা এতটাই পুড়ে গিয়েছেন যে তাঁদের দেহের অন্য কোনও অংশ থেকে চামড়া তুলে পোড়া জায়গায় লাগানো যায় না। তখনই দান করা চামড়া প্রতিস্থাপন করা জরুরি।” তাঁদের আরও বক্তব্য, “ভাল চিকিত্সা পাওয়ার আশাতেই তো দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা এখানে এত কষ্ট করে আসছেন। চামড়ার ব্যবস্থা করা না-গেলে তাঁদের আসাটাই ব্যর্থ হবে।”
বিষয়টি ধামাচাপা দিতে স্বাস্থ্যভবনের একাংশ বলছেন, “স্কিন ব্যাঙ্ক তৈরির আগেও আগুনে পোড়া রোগীর চিকিত্সা হত। তা হলে এখন হবে না কেন?” তার উত্তরে দেহদান আন্দোলনের প্রবীণ কর্মী ব্রজ রায়ের উত্তর, “আগে অতিরিক্ত পোড়া রোগীরা অধিকাংশই চামড়া না পেয়ে মারা যেতেন। সে জন্যই স্কিন ব্যাঙ্ক তৈরির চেষ্টা শুরু হয়। তা হলে ধরে নিতে হয় নিজেদের ব্যর্থতা চাপা দিতে স্বাস্থ্যকর্তারা রোগীদের ফের মৃত্যুর হাতেই ছেড়ে দিতে চাইছেন। অথচ কী ভাবে চামড়া সংগ্রহ করা যায়, সেই চেষ্টা তাঁদের তরফে দেখা যাচ্ছে না।”
স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, স্বাস্থ্য দফতরের চেষ্টার ত্রুটি নেই। তা সত্ত্বেও মানুষকে রাজি বা সচেতন করানো যাচ্ছে না। স্কিন ব্যাঙ্কের দায়িত্বে থাকা চিকিত্সক তিবর বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কথায়, “দেহদান করেন অনেকে, কিন্তু সেই দেহ যখন কয়েক ঘণ্টা পরে আমাদের কাছে এসে পৌঁছয় তখন চামড়া আর ব্যবহারযোগ্য থাকে না। আবার এসএসকেএম হাসপাতালে যাঁরা মারা যান, তাঁদের আত্মীয়দের বুঝিয়ে দেহ নেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে।” যদিও এই যুক্তি মানতে চাননি ব্রজবাবু। তিনি বলেন, “কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলিতে বছরে গড়ে ১০-১৫টি দান করা দেহ আসে। এত দেহ থেকে বছরে ৪টি চামড়াও মিলবে না এমন হয় না।” তিনি আরও বলেন, “দেহ তো চিকিত্সকদের সময় মতো আসবে না। যখনই আসুক না কেন, তখনই সেখান থেকে চামড়া তুলে ব্যাঙ্কে সংরক্ষণ করতে হবে। সেই পরিকাঠামোই তৈরি হয়নি। এসএসকেএমে যাঁরা মারা যাচ্ছেন তাঁদের আত্মীয়দের কাউন্সেলিং করে তত্ক্ষণাত্ মৃতদেহ থেকে চামড়া নেওয়ার মতো কাউন্সেলারও নিয়োগ করা হয়নি।”
ফলে নতুন-নতুন বার্ন ইউনিট খোলা হলেও শূন্য স্কিন ব্যাঙ্কের জেরে প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যাচ্ছে অগ্নিদগ্ধ রোগীর যথাযথ চিকিত্সায়।