আট শিল্পীর আঙিনায় আলাপনের আখ্যান

মৈনাক ধরের ছবিতে বেশ কিছুটা গ্রাফিক কোয়ালিটি কাজ করেছে। বিশেষত যখন রসেনবার্গের প্রিন্ট মেকিং অপ্রত্যক্ষ ভাবেও ছবিতে ফিরে আসে, তার পর হঠাৎ সেখান থেকে একরাশ উজ্জ্বল অ্যাক্রিলিকের প্রতিচ্ছায়া গ্রাস করে সমগ্র পটকে।

Advertisement

অতনু বসু

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০১
Share:

রং-তুলিতে: মৈনাক ধরের কাজ। সম্প্রতি অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে

আট জন শিল্পী কে কী ভাবে দেখেছেন, তাঁদের দর্শনে ভাবনাচিন্তা কী ভাবে শিল্পের রূপ পেয়েছে, তা একটু গভীর ভাবে দেখলে কাজের ধারাবাহিকতার মধ্যে কতখানি নিবিষ্টতা ও ফাঁক— বুঝতে অসুবিধা হয় না। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে প্রদর্শিত হল দ্য এইট-এর বেশ কিছু পেন্টিং, ড্রয়িং এবং ভাস্কর্যের কাজ।

Advertisement

মৈনাক ধরের ছবিতে বেশ কিছুটা গ্রাফিক কোয়ালিটি কাজ করেছে। বিশেষত যখন রসেনবার্গের প্রিন্ট মেকিং অপ্রত্যক্ষ ভাবেও ছবিতে ফিরে আসে, তার পর হঠাৎ সেখান থেকে একরাশ উজ্জ্বল অ্যাক্রিলিকের প্রতিচ্ছায়া গ্রাস করে সমগ্র পটকে। আর হঠাৎ এই নিরীহ শান্ত পটভূমিকা থেকে অতি আধুনিকতার ঝোড়ো বিবর্তন পটকে অস্থিরতার আবহে নিয়ে যায়। দ্বিমাত্রিকতার চরিত্রকে রূপারোপের বাঁধনে ধরতে গেলে স্পেসের ভূমিকা যেমন অপরিহার্য, তেমনই ফর্মও এক উল্লেখযোগ্য অস্ত্র হয়ে ওঠে। মৈনাক তা নিয়ে কেন ভাবেননি, তা খুব স্পষ্ট নয়। এমনকী সুযোগ থাকা সত্ত্বেও
জ্যামিতির দিকেও যাননি।

চন্দন ভাণ্ডারী প্রস্তর ও ধাতুর চেনা ‘মেটেরিয়াল কোয়ালিটি’ থেকে প্রায় অনেকটাই সরে গিয়ে কাজ করেছেন। পর্যায়ক্রমে কাজ দেখা ও অনুশীলনের অভাবে মার খেয়েছে চন্দনের কাজ। পাথরের গড়নে কোনও নির্দিষ্ট কাম্য ফর্মেশন নেই। কতটা সমতলীয় তথা পেডেস্টাল থেকে উঠে থাকবে, কাজের চরিত্রানুযায়ী কী ভাবে তার বিস্তার হবে, সেই ভাবনাই কোনও কাজ করেনি। ওঁর অন্যান্য কাজেও ভাস্কর্যের গুণাগুণ সেই হিসেবে যেন প্রতিফলিত হয়নি।

Advertisement

অনুপম দাসের কাজে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বেশ একটা অবাধ যাত্রা আছে। আবার একই সঙ্গে এক ধরনের টানাপড়েনও কাজ করেছে। তবে ড্রয়িং-পেন্টিংয়ের যে সব গুণ ছবিকে একঘেয়েমি ভেঙে নির্দিষ্টতার দিকে নিয়ে যায়, অনুপম তা অনুভব করেছেন। রঙের উজ্জ্বল মিশ্র মাধ্যমে ছোট্ট ছোট্ট ছবি হয়ে উঠেছে এক-একটি নাটকীয় ঘটনার বিন্যাসপর্ব। ভার্টিকাল ড্রয়িংয়ে তারা আধুনিক-অনাধুনিকের মধ্যবর্তী এক শৈল্পিক রূপারোপে হয়ে উঠেছে পাপেটের চরিত্র। রবীন্দ্রনাথ এবং পল ক্লী যেন এক আশ্চর্য মেলবন্ধন ঘটিয়ে দিচ্ছেন ঘটনার পরম্পরায়। রং-রেখার আশ্চর্য টেকনিককে কাজে লাগিয়ে শিশুসুলভ সারল্যের পাশাপাশি গভীর মূল্যবোধ থেকে ওঠা ক্রীড়নকেরা দ্বিমাত্রিক পটে পেন্টিংয়ের স্বাচ্ছন্দ্যকে সচিত্রকরণ থেকে অদ্ভুত আলাদা করে দিচ্ছে।

প্রদীপ ঘোষের জলরঙের নিসর্গটি মনোরম হলেও অন্য প্রতিচ্ছায়ানির্ভর ছবির অন্তর্নিহিতে রক্ত-মাংস-মজ্জার অভাব— যা বহির্দৃশ্যেও প্রকাশিত।

তেলরং নিজের অধীনে কতটা স্বচ্ছন্দ এবং কতটা নয়, সেটা বুঝে এই মাধ্যমে কাজ করা যথেষ্ট ঝুঁকির। নিরাপদ দূরত্বে থেকে বরং অন্য মাধ্যমকে অনায়াসেই ব্যবহার করা যেত। প্রলয় কুণ্ডুর রচনায় বিভিন্ন ধরন কোনও রকম নিজস্বতাই তৈরি করেনি। উপরন্তু স্পেসের ব্যবহারেও সে রকম মুনশিয়ানার দেখা মিলল না টেম্পারায়।

প্রমাণ মাপের একটি মাত্র কাঠের লাউ, তার সঙ্গে ধাতুনির্মিত লাউপাতা এত ক্ষুদ্র? ডমিনেন্ট-এর মিশ্র মাধ্যমে দাবার ছকটি মন্দ নয়। ক্যাটালগে মুদ্রিত কাজটিতে অসীম পালের কোন ভাবনা কাজ করেছিল, জানতে ইচ্ছে করে।

ব্রোঞ্জের কিছু অতি সমতল চৌকো ফর্ম আর খাড়া দণ্ডায়মান কিছু শিক, এই দুইয়ের সংযোগে ভাস্কর্য গড়েছেন পার্থপ্রতিম গায়েন। কাজগুলিতে ভল্যুমই রাখেননি কোথাও। বিন্যাসের দিক থেকেও কেমন একঘেয়ে বলে মনে হয়। কম্পোজিশনে যদিও এই ফর্মেশনের মধ্যেও অন্য সুযোগ ছিল, যা শিল্পীকে সে পথে পরিচালিত করেনি।

প্রদর্শনীর অন্যতম সেরা কাজগুলি শৈশব মনের অন্তঃস্তল থেকে উঠে আসা রূপকথার এক আশ্চর্য পৃথিবীর রঙিন নকশিকাঁথা যেন। কাগজে অ্যাক্রিলিক দিয়ে যে কাঁথা বুনেছেন পল্টু ঘোষ! জমানো পট। তাঁর পরিচ্ছন্ন টেকনিকই তৈরি করে দিচ্ছে এক অনিন্দ্যসুন্দর নিসর্গ। যেন রঙের বিবিধ টোন ও উজ্জ্বলতার উষ্ণ আবহ থেকে উঠে আসা আলোকিত বিভায় ফুল-পাখি-মাছ-হাতি-গাছপালা-পাহাড়-মানুষ-কীটপতঙ্গ ইত্যাদি ছবিকে নিয়ে যাচ্ছে লোকশিল্পের সরল উদ্ভাসিত এক চিত্রময় অদেখা গ্রহের অভ্যন্তরে। আলঙ্কারিক নকশা, কাব্যিক রেখার ছন্দোময় রূপবন্ধের পাশে কবরীগুচ্ছর লাবণ্যময় প্রবাহ কম্পোজিশনকে এক নিবিড় পূর্ণতা দিয়েছে। এই সামগ্রিক আলোড়নই ওঁর ‘মাই ফ্লাওয়ার ভাস’ সিরিজটিকেও আন্দোলিত করেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন