যৌনতার ছায়া যখন সম্পর্কে

কৌশিক করের ‘পর্ণমোচী’ নাটকে তারই প্রতিফলন। লিখছেন পিয়ালী দাসযৌনতাকে বাদ দিয়ে জীবন নয়। কিন্তু বর্তমানে সেটা বিকৃতির রূপ নিচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে ব্যক্তিগত জীবন থেকে সামাজিক জীবনে। কৌশিক করের ‘পর্ণমোচী’ নাটকে তারই প্রতিফলন। লিখছেন পিয়ালী দাস

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৬ ০০:০০
Share:

যৌনতাকে বাদ দিয়ে জীবন নয়। কিন্তু বর্তমানে সেটা বিকৃতির রূপ নিচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে ব্যক্তিগত জীবন থেকে সামাজিক জীবনে। এক স্কুল ছাত্র পর্ন ফ্যান্টাসির শিকার। ফলে তাঁর জীবন দ্রুত বদলে যাওয়া, পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা— মূলত এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এগোতে থাকে গল্প। তবে পর্নগ্রাফিকেই হাতিয়ার করে পর্ন ইন্ডাস্ট্রির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করলেন নির্দেশক কৌশিক কর। কলকাতা অপেরা’-র প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হয় ‘পর্ণমোচী’ নাটকটি।

Advertisement

এ দিন উপস্থাপনার আগে নাটক নিয়ে বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল দর্শক মনে। কারণ প্রচারে জানা যায় নাটকে স্ট্রিপ ডান্স থাকবে, লাইভ সেক্স-এর ক্লিপিংসও দেখানো হবে। ছিলও। তবে মঞ্চায়নের সময় তার প্রভাব ততটা পড়েনি। এখন আমরা নিজেদের প্রকাশ করতেই বেশি ব্যস্ত। ফলে সম্পর্কের গোপনীয়তাগুলোও প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। সেই বিষয়টাই জোরালো ভাবে উঠে এল নাটকে। ভারচুয়াল ওয়ার্ল্ডের যৌনতার জালে ক্রমশ মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে ভালবাসার মানুষের থেকে, পরিবার এমনকী সমাজ থেকেও। কিন্তু কী ভাবে? কৌশিক আঙুল তুলে দেখালেন সেই ভয়াবহতা, যন্ত্রণার দৃশ্য।

প্রশ্ন জাগে, পর্ন ফ্যান্টাসি কী ভাবে ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোকে কলুষিত করছে? ঘটনা পরম্পরায়, নাটকের প্রতিটি দৃশ্যে উঠে এল সে সব বাস্তব দৃশ্য। সামনেই মাধ্যমিক পরীক্ষা অনলের। তবুও ডুবে মোবাইলে। স্কুলে ক্লাস চলাকালীন ব্যাগে থাকা মোবাইলে পর্নগ্রাফির ভিডিও চলতে থাকে সশব্দে। পরিণামে অভিভাবক তলব। টিচার্স রুমে শিক্ষকদের আলোচনা চলছে ছেলেটিকে নিয়ে। যৌন শিক্ষা চালু হওয়া উচিত কি না, এ বিষয়েও প্রকাশ্যে চলে আসে কিছু শিক্ষকের অজ্ঞতা। গুলিয়ে যায় যৌনতা আর যৌন শিক্ষা’র মতো দুটি পৃথক বিষয়।

Advertisement

পুলিশ অফিসার মিস্টার ঘোষ ধর্ষকদের শাস্তি দেয়। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে সেও পর্ন ফ্যান্টাসির স্বীকার। বিদেশি পর্ন ভিডিও দেখে বউকে সেই ধরনের যৌনাচারে লিপ্ত হতে বলেন, অশ্লীল ভাষা প্রয়োগে। এই দৃশ্যেও চমক অপেক্ষা করে থাকে যখন স্ত্রী বলে ওঠে, সেও ওই ধরনের ভিডিও দেখেছে। অবাক লেগেছে ছেলেগুলোর ‘শক্তি’ দেখে। এ দৃশ্য ধাক্কা দেয় পুরুষতন্ত্রের বুকে। মহিলাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া পর্ন ফ্যান্টাসির বিরুদ্ধেও যেন বড়সড় বিদ্রোহ।

পিনাকী ব্লু-ফিল্ম বিক্রেতা। চাহিদা অনুযায়ী জোগান দিয়ে থাকে। কিন্তু এক দিন এ কাজের জন্যই তাকে প্রচণ্ড মার খেতে হয়। এই ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে চোখে জল আসে দর্শকদেরও। যখন পিনাকী তার মৃত বউয়ের ছবি জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। বলে, সে তো কখনও কাউকে জোর করেনি। স্ত্রী চলে যাওয়ার পর কোনও সম্পর্কেও যায়নি। এ নিয়েই বেঁচে আছে। পিনাকীর চরিত্রে সতীশ সাউ-এর সাহসী এবং সাবলীল অভিনয় বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।

এক দৃশ্যে বাবা-ছেলের সম্পর্কের সুন্দর রসায়ন ফুটে ওঠে। বাবা যখন একান্তে বসে ছেলেকে বোঝায়, প্রত্যেকের জীবনেই কিছু গোপনীয়তা থাকে। সেগুলোকে পরম যত্নে রক্ষা করতে হয়। এ দৃশ্য এক অন্য গভীরতা পায়। সচেতন, বন্বু-বৎসল পিতার চরিত্রে কৌশিক অনবদ্য। যৌনতায় আসক্ত, বাবার সম্পর্কে এক সময় ভুল ধারণা তৈরি হওয়া, নিজের জগতে বুঁদ হয়ে থাকা, হতাশায় ভোগা— এ সব দৃশ্যে শান্তনু দেবনাথের অভিনয় প্রশংসনীয়।

বেশ সাহসী দৃশ্যে দেখা যায় অঙ্কিতা মাঝিকে। নাটকের প্রয়োজনে সঙ্গম দৃশ্যের ভিডিও ক্লিপিংসে এবং একটি ড্রিম সিকোয়েন্সে, যৌনতার আবেশ রচনায় তিনি ছিলেন বেশ সাবলীল।

বিকৃতকাম মিস্টার ঘোষের চরিত্রে রাহুল সেনগুপ্তের অভিনয় কৌতুকের সঞ্চার করে। বিশেষ করে ভ্রমবশত রেপিস্টদের ঘরের মধ্যে হাতের নাগালে পাওয়া এবং তাদের মেরে ধরে বাপ-বাপান্ত করে রাগ মেটানোর দৃশ্য মনে রাখার মতো। লুঙ্গি গুটিয়ে তাদেরকে মারতে যাওয়ার দেহ-ভঙ্গিমা দর্শকদের মাতিয়েছে। উল্লেখের দাবি রাখেন মায়ের চরিত্রে মধুমিতা সেনগুপ্ত, মিস্টার ঘোষের স্ত্রী’র চরিত্রে নবনীতা আচার্য, পার্ণ’র চরিত্রে তন্নিষ্ঠা বিশ্বাস। টিন-এজ মেয়ের ছটফটানি, সারল্য সুন্দর ফুটে ওঠে ওর অভিনয়ে। এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন দিদিমা-মুনমুন চট্টোপাধ্যায়, শিক্ষক- তাপস রায়, অননীশ, সমীরণ প্রমুখ। নাটকে কখনওই বিষয়কে ছাপিয়ে যায়নি অভিনয়। এখানেও নির্দেশকের সচেতনতার পরিচয় মেলে।

মঞ্চসজ্জায় দেবব্রত মাইতি, আলোয় দীনেশ পোদ্দার, আবহে সমীরণ, রূপসজ্জায় মহম্মদ আলি। স্মোক প্রোজেক্টর ব্যবহারে ঘন ধোঁয়া ভেদ করে মায়ের আঁচলে দুর্গা প্রতিমার মুখ ভেসে ওঠার দৃশ্য মনে রাখার মতো। নীলাভ আলোয় শ্বেত-শুভ্র বরফের কুচি ঝরে পড়ার শেষ দৃশ্য মন ভরিয়ে দেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন