আলোচনা

হারিয়েছে যেন সেই ‘শম্বুক গতি’

তিনি একজন নীরব ভাস্কর। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় সুনীলকুমার দাস সম্পর্কে। বিগত প্রায় চার দশক ধরে নিমগ্ন কাজ করে যাচ্ছেন। কোথাও কোনও আলোড়ন নেই।

Advertisement

মৃণাল ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share:

প্রতীক: আকৃতি গ্যালারিতে সুনীলকুমার দাসের প্রদর্শনীর একটি ছবি

তিনি একজন নীরব ভাস্কর। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় সুনীলকুমার দাস সম্পর্কে। বিগত প্রায় চার দশক ধরে নিমগ্ন কাজ করে যাচ্ছেন। কোথাও কোনও আলোড়ন নেই। কোনও আত্মপ্রচার নেই। তাঁর প্রতিটি রচনায় প্রায় প্রচ্ছন্ন কৌতুক ও করুণার সঙ্গে মিশে থাকে প্রতিবাদের দৃঢ়তা। জীবনে যেমন, তেমনই শিল্পেও এই অনমনীয় দৃঢ়তা নিয়েই তিনি গড়ে তোলেন আত্মপরিচয়। ১৯৮৩ থেকে সুনীল ‘সোসাইটি অব কন্টেম্পোরারি আর্টিস্টস’ দলের সদস্য। সোসাইটির প্রদর্শনীতেই আমরা তাঁর ভাস্কর্য নিয়মিত দেখে এসেছি। একক প্রদর্শনী করেছেন খুবই কম। চরিত্রের নির্লিপ্ত নির্জনতার ভিতর দিয়ে এই দুটি বৈশিষ্ট্যকেই তিনি নিষ্ঠাভরে আয়ত্ত করেছেন।

Advertisement

সম্প্রতি আকৃতি গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল তাঁর ৩৫টি ভাস্কর্য নিয়ে সমৃদ্ধ একক, যার শিরোনাম ‘বাহন’। মানুষের সামনে দুটি শ্রেণি আছে। একদল ভোগ করে, বিলাসিতা করে, আত্মপ্রচার করে। আর একদল সেই অহঙ্কারী আলোড়নের ভার বহন করে। তাঁরাই এই সমাজের ভিত্তিভূমি। তাঁদের শ্রম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার উপরই সমাজ দাঁড়িয়ে থাকে। এই ‘বাহন’-এর প্রতি সহানুভূতি সুনীলের কাজের একটি বৈশিষ্ট্য। এ থেকেই সঞ্চারিত হয় তাঁর প্রতিবাদী চেতনা। এই অনুভবকেই তিনি বিস্তৃত করেছেন মানুষ ছাড়িয়ে পশু, প্রকৃতির মধ্যে।

এ বারের প্রায় সব কাজেরই মাধ্যম ব্রোঞ্জ ও পাথর। ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য গড়ে ওঠে সংযুক্তির প্রক্রিয়ায়। আর পাথরের রচনায় থাকে বিযুক্তির প্রক্রিয়া। যোগ ও বিয়োগের যৌথতায় গড়ে ওঠা সম্মিলিত প্রক্রিয়া তাঁর রচনায় বিশেষ এক বিপরীতের সমাবেশ ঘটায়, যে বৈপরীত্য ও দ্বান্দ্বিকতা জীবন ও প্রকৃতির অন্যতম এক নিয়ামক।

Advertisement

কত প্রচ্ছন্ন নির্লিপ্ততায় তিনি তাঁর কাজে গভীর এক প্রতিবাদী চেতনা গড়ে তোলেন তার দৃষ্টান্ত হিসেবে দুটি রচনার উল্লেখ করা যেতে পারে। দুটিরই শিরোনাম ‘গতি’। একটিতে দেখা যাচ্ছে একটি শামুক চলেছে ধীর গতিতে। এই বাহনের উপর অধিষ্ঠিত আছে যন্ত্র ও কৃষির প্রতীক দুটি প্রতিমাকল্প। এই হল আমাদের দেশের উন্নয়নের শম্বুকগতির এক আলেখ্য। দ্বিতীয়টিতে শিল্পী রূপায়িত করেছেন একটি চলমান কচ্ছপকে। তার পিঠের উপর সংস্থাপিত বিচার ব্যবস্থার প্রতীক আসবাবের উপর হাতুড়ি। এই হল আমাদের বিচার ব্যবস্থা। ‘ভরত’ নামে একটি রচনা আছে। হিন্দুত্বের বাহন হয়ে উঠেছে আজকের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। আজকে যে পরিকীর্ণ হিংসা ও হত্যার আবহ চলছে তার প্রতীকী ভাষ্য রচনা করেন শিল্পী পাখির প্রতিমায় ‘ঘাতক’ শিরোনামের কয়েকটি রচনায়। এই মৃত্যু ও নাস্তি-ই হয়ে ওঠে এক শ্রেণির ভোগের বাহন। নদীস্রোতে ভাসমান একটি মৃতদেহ খুঁটে খাচ্ছে একটি কাক। শিরোনাম ‘নেই তাই খাচ্ছো কোথায় পেতে’।

১৯৩০-এর দশকে রামকিঙ্করের আত্মপ্রতিষ্ঠার পর থেকে আমাদের ভাস্কর্য অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছে। ষাটের দশকে ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে এক টানাপোড়েন। সেখানে পাশ্চাত্যের আধিপত্যই ছিল বেশি। তার পর এসেছে ‘পোস্ট মর্ডান’-এর ঝড়। কনসেপ্ট-এর দাপটে অনেক সময়ই ওষ্ঠাগত হয়েছে লাবণ্যের প্রাণ। এরই মধ্যে কিছু শিল্পী জীবনের সঙ্গে যাঁদের সম্পর্ক নিবিড়, গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন ভাস্কর্যের সুস্থিত আত্মপরিচয়। সুনীলকুমার দাস সেই ঘরানারই একজন উজ্জ্বল শিল্পী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন