চিত্রণ: শেখর রায়
•হুতোমের নকশায় প্রেতচর্চাকে ‘বুজরুকি’ বলে গাল পেড়েছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ!
•এ দিকে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু রীতিমতো ‘মিডিয়াম’ নিয়ে বসাতেন প্রেতবৈঠক। তাঁর আসরে ‘দেখা’ দিয়েছিল সুকুমার রায়ের আত্মাও।
•আবার বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি কথা বলতেন তাঁর মৃতা স্ত্রীর সঙ্গে!
•অবনঠাকুরের জামাতা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছাপাখানাটি ছিল ‘আত্মা’ নামানোর বিখ্যাত ঠিকানা।
বাঙালির প্রেতবৈঠকের ইতিহাস রুদ্ধশ্বাস রোমহর্যক কাহিনিকেও হার মানায়।
আত্মা নির্দেশ দিল দেশবন্ধুকে
আলিপুর বোমা মামলা।
প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ডকে মারার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অনেকের সঙ্গেই ধরা পড়েছেন অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষরা।
অভিযুক্তদের হয়ে মামলা লড়ছেন ব্যারিস্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তী। মামলা শুনছেন বিচারপতি বিচক্রফ্ট।
ও দিকে, সে সময় ভূতপ্রেত নিয়ে মেতে আছেন আর এক ব্যারিস্টার, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। কখনও পুরুলিয়ায়, কখনও কলকাতায় তাঁর রসা রোডের বাড়িতে বসছে আত্মা-আনয়ন চক্রের বৈঠক।
নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়ও সাধারণত থাকেন সেই সব বৈঠকে। বন্ধ দরজার ভিতর দিয়ে বাড়ির ছোটরা পরলোক থেকে নেমে আসা অশরীরীদের আভাস পাওয়ার চেষ্টা করে।
আলিপুর মামলা নিয়ে কিছু আলোচনার জন্য একদিন ব্রাহ্মবান্ধবের আত্মাকে ডেকে আনলেন দেশবন্ধু। আত্মা পেন্সিল দিয়ে বারবার লিখে দিল, ‘‘ইউ মাস্ট ডিফেন্ড অরবিন্দ।’’
কিছু দিনের মধ্যে আলিপুর বোমা মামলা চলে এল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের হাতে।
বরোদা। উনিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিক। ভাই বারীনের সঙ্গে আত্মা ডেকে আনার আসর বসাতেন অরবিন্দ ঘোষ।
পণ্ডিচেরিতে শ্রীঅরবিন্দ এক সময় নিয়মিত বসতেন ‘সেঅন্স’ অর্থাৎ আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের বৈঠকে। তেমনই কয়েকটা আসরে, প্রায় সাত-আট দিন লিখে তিনি ইংরেজিতে শেষ করলেন একটি বই। নাম দিলেন ‘যোগিক সাধন’।
নিজে লিখলেও বইয়ে নিজের নাম ছাপতে দিলেন না ঋষি অরবিন্দ। কেন?
বললেন, তাঁর হাত দিয়ে আসলে অন্য কেউ এসে লিখে গেছেন সেই বই। প্রেত-তাত্ত্বিকরা একেই বলবেন ‘স্বয়ং-লিখন’।
শিবাজির বিদেহী আত্মা
লেখালেখির পাশাপাশি, পেশায় আইনজীবী সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় তখন বন্ধুদের নিয়ে মেতে আছেন প্রেতচর্চায়।
হীরেন্দ্রনাথ দত্ত আর সৌরীন্দ্রের মেজকাকা রাজেন্দ্রলাল মুখোপাধ্যায় সেই সময় সম্পাদনা করেন ‘থিওসফিকাল সোসাইটি’র পত্রিকা ‘পন্থা’।
তিন পায়া টেবিলকে ঘিরে ধরে আত্মা নামানোর চক্র বসাতেন সৌরীন্দ্রমোহন, যার চলতি নাম ছিল ‘টেবল টার্নিং’।
আত্মা এলে কেঁপে উঠত টেবিলের পায়া। পায়া কতবার পা ঠুকল মাটিতে, সেই অনুযায়ী ধরা হত আত্মার উত্তর।
‘‘রহিম সাহেবের জজ হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি?’’ প্রেতচক্রে এই প্রশ্নের উত্তরে টেবিলের পায়া একবার শব্দ করল। তাতেই স্পষ্ট হল জবাব—
‘‘হ্যাঁ।’’ পরে এই ‘হ্যাঁ’টা মিলেও যায়। ওঁদের প্রেতচক্রে আর একবার এল স্বয়ং ছত্রপতি শিবাজির আত্মা।
তাকে প্রশ্ন : ভারত কোনও দিন স্বাধীন হবে কি না। আবার এক বার পায়ার ঠোক্কর মাটিতে। অতএব— ‘‘হবে।’’
তখন প্রশ্ন, কত দিন পর?
টেবিলের পায়া ঠক ঠক ঠক করে চলল—চল্লিশবার। উপস্থিত চক্রীদের কেউ সে দিন বিশ্বাস করেননি, চল্লিশ বছরের মধ্যেই সত্যি সত্যি স্বাধীন হয়ে যাবে ভারতবর্ষ।
চিত্রণ: শেখর রায়
ভারতী-র ভবিষ্যতে আত্মার রায়
ঠাকুরবাড়ি। রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদনা করতেন মাসিক পত্র ‘ভারতী’।
হঠাৎ তাঁর স্বামী জানকীনাথ ঘোষাল মারা গেলেন। এর পর যাবতীয় কাজকম্ম যেন স্বর্ণকুমারীর কাছে ভার হয়ে দাঁড়াল। সমস্ত কিছু থেকে অব্যাহতি চেয়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইলেন তিনি।
তখন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে প্রেতবৈঠক বসে। সেখানে মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় ডাকলেন জানকীনাথের আত্মাকে। কৌতূহলী প্রেতচক্রীদের প্রশ্ন— এর পর ‘ভারতী’র কী হবে?
জানকীনাথের আত্মা জানাল, একদিন সৌরীন্দ্রনাথ আর মণিলাল দ্বায়িত্ব নেবেন ‘ভারতী’র। সে-কথাটাও মিলে ছিল অক্ষরে অক্ষরে। ‘ভারতী’র সম্পাদক হয়েছিলেন ওই দুজনে।
ভাল মন নিয়ে ডাকলে ওঁরা আসে
বড় ছেলে মারা গেলে, বউয়ের আবদারে, প্ল্যানচেটে বসলেন সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী।
মনে কিন্তু শুধুই অবিশ্বাস আর সন্দেহ। কিছু দিন যেতেই সেই সতীশচন্দ্রই ‘বুঝলেন’, ভাল মন নিয়ে ডাকলে আত্মারা আসে।
আরও বুঝলেন, ঐহিক বিষয় নিয়ে জ্বালাতন আত্মারা পছন্দ করে না। আত্মাদের সঙ্গে নিজের কথাবার্তা বারবার পড়ে তিনি এতটাই খুশি হয়ে পড়তেন যে, এক বার লিখেছিলেন, যেন ‘‘ধর্মপুস্তক পাঠ করিবার পবিত্র আনন্দ উপভোগ করি।’’
সতীশচন্দ্রের আত্মাচর্চা প্রেতচক্রের গল্পে আত্মার ভোজন-পর্বের কথাও এসে পড়ে। অবাক করা সে সব কাহিনির দু’-একটা নমুনা দেওয়া যাক।
দেখা যাচ্ছে, মৃত পুত্র পরিতোষের আত্মা এসে একবার সতীশচন্দ্রকে জানাচ্ছে, ‘‘মৃত্যুর পূর্বে ডাব খাইতে চাহিয়াছিলাম।’’
সতীশচন্দ্র বিলক্ষণ জানতেন, জীবদ্দশায় পরিতোষ চমচম ভালবাসত। ছেলের আত্মাকে বাবা বললেন, ইদানীং স্পঞ্জ রসগোল্লা পাওয়া যাচ্ছে, যা পরিতোষের মৃত্যুর সময় বাজারে ছিল না।
পরিতোষের আত্মাকে সতীশচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, স্বর্গে ‘‘তুমি কি স্পঞ্জ রসগোল্লার আস্বাদ পাইবে?’’
উত্তর এল, ‘‘না। সাধারণ রসগোল্লার তৃপ্তি পাইব।’’
প্রেত অধিবেশনের শেষে সতীশচন্দ্র লিখে রাখলেন অভ্রান্ত উপসংহার: ‘‘বুঝিলাম আত্মারা স্মৃতির সাহায্যে আস্বাদজনিত তৃপ্তি পাইয়া থাকে।’’
এর পরের আরেক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে অন্য এক জায়গায়। তাতে দেখা যাচ্ছে, সতীশচন্দ্রের প্রেতচক্রে নয় জন বিদেহী আত্মা ডাব ও আম দিয়ে ভোজ সারছেন। আর ছেলের উদ্দেশে নিবেদিত চমচম, অনাহুত আত্মা নিঃশেষ করে দিলে, ছেলের আত্মা প্রেতচক্রে ধরা দিয়ে বলছে, ‘‘তারা শালা সব নষ্ট করিয়াছে।’’
শুধু তাই নয়, আকস্মিক মৃত্যুর পর প্রেতচক্রে একবার নেমে এলেন পাড়ায় ‘ছোড়দি’ বলে পরিচিত জনৈক হেডমাস্টারের ভ্রাতুষ্পুত্রী।
চক্রে তিনি এমন ‘চপলতা’ প্রকাশ করলেন যে, সতীশ্চন্দ্রের ঠোঁট স্পর্শ করে ফেলল আবির্ভূত মহিলার কান।
বিব্রত সতীশচন্দ্র বলে উঠলেন, ‘‘ছি: ছোড়দি!’’
হাসতে হাসতে হাততালি দিয়ে সেই আত্মা বলল, ‘‘এখন আপনি বকুন আর মারুন, কিছুতেই আমার আপত্তি নাই। আমি আমার কাজ হাসিল করিয়া লইয়াছি!’’
কেশবচন্দ্র, প্যারীচাঁদ এবং...
হালের বাঙালির স্মৃতির দরজায় টোকা দিলেই আজও বেরিয়ে পড়ে রাশি রাশি এমনই সব আশ্চর্য বিশ্বাসের কাহিনি।
আঠেরো শতকের শেষ তিন দশক থেকে উনিশ শতকের পাঁচের দশক পর্যন্ত প্রবলভাবে বহু বাঙালি মেতেছিলেন পরলোক আর প্রেতচর্চায়।
তাকে ইংরেজিতে কেউ বলেছেন প্ল্যানচেট, ফরাসিতে সেটাই আবার ‘সেঅন্স’। এরই অন্য নাম— ‘চক্র’, ‘সার্কল’ অথবা ‘পিঠাসন’।
ডাক্তার, গৃহবধু, সন্ন্যাসী, ব্যারিস্টার, বিচারপতি, বিপ্লবী, সাহিত্যিক, কবি, শিক্ষক, সাংবাদিক, প্রকাশক, সমাজসংস্কারক— কে নেই সেই কৌতূহলী, অনুসন্ধিৎসু প্রেতপিয়াসী বাঙালির তালিকায়! অনেক সময়, বিদেহী আত্মাকে মর্তে ডেকে আনতে প্রেতচক্রে সহায়ক হতেন প্রেত-আহ্বায়ক অর্থাৎ ‘মিডিয়াম’।
তাঁর গলায় কখনও ভেসে আসত বিদেহী আত্মার পরিচিত কণ্ঠস্বর, অদৃশ্য হাতে কখনও বেজে উঠত পিয়ানো। কখনও আভির্ভূত হত প্রয়াত মানুষের ছায়ামূর্তি। কখনও অধিবেশনে উপস্থিত জনদের প্রশ্নের উত্তরে ‘স্বয়ং-লিখন’-এ ফুটে উঠত বিদেহী আত্মার উত্তর। কখনও অনুভব করা যেত বিদেহী আত্মার হাতের ছোঁওয়া অথবা অযাচিত স্নেহের অত্যাচার।
চক্র চলার সময় বহু ‘মিডিয়াম’ মূর্চ্ছা যেতেন, অথবা থাকতেন তন্দ্রাচ্ছন্ন। অধিবেশনের মধ্যে তাঁদের অনেকের আচরণ চলে যেত নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
কখনও ভয়ংকর অসুখ, কখনও মৃত্যু তাড়া করত তাঁদের। মদ্যপ কেউ চক্রে বসার অনুমতি পেতেন না। জানা যায়, সূক্ষ দেহ ধারণ করা আত্মারা মর্ত্যবাসীদের সূক্ষ দেহই দেখতে পেত শুধু।
তান্ত্রিক সাধনার বাইরে, অবিভক্ত বাংলায় ঠিক কবে থেকে প্রেতচর্চা শুরু হল, নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন।
তবে বহু বইপত্র, বিজ্ঞাপন, সংবাদপত্র থেকে বাঙালির প্রেতচর্চার মোটের উপর একটা ছবি ভেসে আসে।
১৮৭৯ সালে প্রকাশিত তেমনই একটি বই হল ‘ইহলোক পরলোক’। সেখানে নির্দিষ্ট করে বলা রয়েছে রাস্তা বা গলি থেকে দূরে, কেমন হবে চক্রকক্ষের পরিবেশ অথবা তার মাপ। ক্ষমতাশালী মিডিয়াম না হলে বড় ঘরে চক্র না বসানোর, চক্রে দু’একজন মহিলা বা কোমল প্রকৃতির মানুষকে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আগ্রহীদের ইংল্যান্ড আর আমেরিকায় গিয়ে কিছু দিন প্রেতবিদ্যা চর্চা করার উৎসাহ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘‘তথায় ছয় মাসে আমরা যা শিখিব ও দেখিব তাহা এদেশে দশ বৎসরেও সম্ভব হইবেনা।’’
জানা যায়, রাজা দিগম্বর মিত্র ছিলেন পরলোকবাদী। কেশবচন্দ্র সেনও আমেরিকায় গিয়ে পরলোকবাদীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন।
১৯২৭-এ প্রকাশিত হয়েছিল কেশবচন্দ্র সেনের বই ‘পরলোকের সন্ধানে’।
‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র সম্পাদক শিশিরকুমার ঘোষের আট ভাইয়ের একজন, হীরালাল, আত্মহত্যা করে মারা গেলেন ১৮৬৫-তে।
তখন তাঁদের বিদ্ধস্ত মা, বড় ছেলেকে বললেন, যদি পৃথিবী থেকে পরলোকে যাওয়া মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের সম্ভাবনা নাই থাকে, তবে সকলকে হয়তো হীরালালের মতো আত্মহত্যার পথেই যেতে হবে। শিশিরকুমারও খুঁজে বেড়ালেন মায়ের কষ্টের কারণ। তাঁর মনে হল, কাছের বন্ধু আর আত্মীয়েরা যখন দূরদেশে যায়, সেই চলে যাওয়ায় মৃত্যুর মতো এত প্রবল শোকের উদয় হয় না এই ভেবে যে, দূরে যাওয়া মানুষ এক সময় ঠিক ফিরে আসবেন।
শিশিরকুমার ভাবলেন, পরলোকে যাওয়া মানুষের বিষয়েও ঠিক তেমনই একটা আশ্বাস পাওয়া গেলে হয়তো মৃত্যুশোক কমানো যাবে। মৃত্যু সহজ মনে হবে। মৃত্যুভয়ও আর থাকবে না।
সেই আলোর খোঁজে শিশিরকুমার যখন ইংল্যান্ড অথবা আমেরিকার যাওয়ার কথা ভাবছেন, তখনই তাঁর দেখা হল অধ্যাত্মবাদীদের একজন— প্যারীচাঁদ মিত্রের সঙ্গে। পরপর বেশ কিছু শোক পেয়ে প্যারীচাঁদ যখন পরলোকচিন্তায় ডুবে আছেন, কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদক হিসেবে তাঁর হাতে এসেছিল পাশ্চাত্যে পরলোকচর্চার বেশ কিছু বইপত্র।
অস্ট্রেলিয়া থেকে কলকাতায় আসা এক ফরাসি হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের বাড়িতে প্রেতচক্রের আসরে যেতেন প্যারীচাঁদ। তাঁর বউ আর ছেলেদের ‘মিডিয়াম’ করেও চলত প্রেত-আহ্বানের অধিবেশন।
প্যারীচাঁদ আর তাঁর কয়েক জন সমমনস্ক বন্ধু মিলে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশন অব স্পিরিচুয়ালিজম’।
এ দিকে ‘থিওসফিকাল সোসাইটি’-র উদ্যোগে প্রকাশিত হতে থাকে সমিতির মুখপত্র ‘দ্য থিওজফিস্ট’।
প্যারীচাঁদের প্রভাবে কলকাতায় বসেই প্রেত-আহ্বানে উৎসাহী হন শিশিরকুমার ঘোষ। পরলোকতাত্বিকদের অন্যতম হীরেন্দ্রনাথ দত্ত লিখছেন, ১৮৮১ সাল থেকে শুরু করে ডাক্তার পিবলস, এগলিনটনের মতো বিখ্যাত প্রেততাত্ত্বিকেরা কলকাতায় এসে আশ্চর্য সব কাণ্ড দেখিয়েছিলেন। লিখছেন, ‘‘স্বনামধন্য প্যারীচাঁদ মিত্র, মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, দেশপূজ্য শিশিরকুমার ঘোষ প্রভৃতি ঐ সকল ঘটনার প্রত্যক্ষকারী। অতএব ঐ ঐ ঘটনা ভোজবাজি বলিয়া উড়াইয়া দিবার সম্ভাবনা নাই।’’
১৯৩৩-এই, লেড বিটারের বই ‘অন দ্য আদার সাইড অব ডেথ’ হীরেন্দ্রনাথ দত্তের অনুপ্রেরণায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন হরিদাস বিদ্যাবিনোদ।
আত্মাকে রবীন্দ্রনাথ গান শোনালেন
নারী আর পুরুষের ‘আনন্দের সম্বন্ধ’’ আর ‘মিলনের আকাঙ্ক্ষা’ পরলোকেও কি দেখা যায়? নিজস্ব প্রেতচক্রে একবার মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মার কাছে জানতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্ল্যানচেটের রীতিমতো চল ছিল। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য ঘটনাবলির মধ্যে দুটি চিঠির উল্লেখ করা যায়।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিষয়ে কিছু মনে আছে কি না, জানতে চাওয়ায় প্রমথনাথ বিশিকে রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘আমি তাঁকে দেখিনি, একবার প্রেতবাণী চক্রযানে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, সেটা আদালতে সাক্ষ্যরূপে গ্রাহ্য হবে না।’’
১৯২৯-এ রানি মহলানবিশকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘‘সেদিন বুলা এসেছিল। হঠাৎ কথায় কথায় প্রকাশ পেল তার হাতে প্রেতাত্মা ভর করে, পেন্সিল চালিয়ে কথা কইতে পারে। বলা বাহুল্য শুনে মনে মনে হাসলাম. বললুম— আচ্ছা দেখা যাক।’’
সে বছরেরই শেষের দিকে শান্তিনিকেতনের উদয়ন আর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রায় দু’মাস, ধারাবাহিকভাবে তাঁর বিদেহী প্রিয় বন্ধু ও আত্মীয়দের ডেকে এনে কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
নানা সময় তাঁর সঙ্গে থাকতেন অবনীন্দ্রনাথ, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, অজিতকুমার চক্রবর্তী ও অন্য কেউ কেউ।
বন্ধু মোহিতচন্দ্র সেনের কবি ও সুন্দরী কন্যা উমা ছিলেন সেই সব অতীন্দ্রিয় অধিবেশনের ‘মিডিয়াম’। যার ডাক নাম ছিল বুলা। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে মারা যান তিনি।
নতুন বৌঠান কাদম্বরী, স্ত্রী মৃণালিনী, পুত্র শমী, কন্যা মাধুরীলতা, নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতোই প্রেত-অধিবেশনে একদিন এলেন বিদেহী সুকুমার রায়। তাঁর গানের সমঝদার সুকুমারের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ ধরলেন ‘তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়...’। মাঝপথে থেমে গেলেন গানটার কথা ভুলে! সুকুমারের আত্মা রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করে বসল, ‘‘আমার ছেলেকে আপনার আশ্রমে নিতে পারেন?’’
সুকুমারের এই ইচ্ছের কথা তাঁর স্ত্রী সুপ্রভাকে জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। এই কথা শুনে কিছু দিন ছেলেকে নিয়ে কবির শান্তিনিকেতনে কাটিয়েও যান সুপ্রভা। কিন্তু সদ্য বাবা-হারানো ছেলেকে কী ভাবে আর একা ছেড়ে আসেন সেখানে! কিন্তু এর ঠিক দশটা বছর পর দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের আশ্রমে সত্যজিৎকে পড়তে পাঠিয়ে দিচ্ছেন সুপ্রভা রায়।
প্রেতচর্চায় বিখ্যাত বাঙালি
• বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম স্ত্রী মোহিনীর মৃত্যুর পর বিয়ে করেন রাজলক্ষ্মীকে। পরিণত জীৱনে তিনিই দেখতেন প্রথম স্ত্রীর ছায়া। আত্মীয় সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে বলতেন, ‘‘তোর সেজদিকে দেখেছি রে... আমিও এবার তার কাছেই যাব।’’
• শাশুড়ির মৃত্যুর পর প্ল্যানচেট শুরু করা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে চিঠিতে বিভূতিভূষণ লিখলেন, বৃহদারণ্যক ও ঈশোপনিষদের মতো তিনিও বিশ্বাস করেন পৃথিবীর বহু উপরে বহু স্তরের অস্তিত্ব রয়েছে। আর প্রেতলোকের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ করার কিছু নেই।
• স্বামী বিবেকানন্দের উৎসাহে স্বামী অভেদানন্দ, আঠেরো শতকের শেষে পাশ্চাত্যে গিয়েছিলেন বেদান্ত দর্শন প্রচার করার জন্য। আমেরিকার প্রথম সারির প্রেততাত্ত্বিকের সঙ্গে তাঁর ভাবনার আদানপ্রদান হয়। প্রায় দুই দশকের প্রবাসজীবনে পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত পরলোকচর্চার কেন্দ্রগুলোতে দেওয়া তাঁর বক্তৃতা সমাদৃত হয়েছিল। মরণের পরে আত্মা কোথায় যায়, এই প্রশ্নের উত্তরে সাংখ্যকার কপিল আর অন্যান্য হিন্দুদার্শনিকদের সুরেই একবার অভেদানন্দ বলেছিলেন, মৃত্যুর পর পঞ্চপ্রাণ, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির মতো সতেরোটা উপাদানে তৈরি সূক্ষ্মদেহ ধারণ করে আত্মা যায় স্বপ্নলোকের মতোই মনলোকে।
• মালদহের ইংরেজবাজারের কলাতলা। সেখানে শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের মেজদা অসুস্থ। সেবা চলছে পালা করে। সজনীকান্তকে ঘুম থেকে তুলে দাদার পাশে বসিয়ে বাবা গেলেন ছাদে আর গিয়েই বললেন, ‘‘আজই সব শেষ হয়ে যাবে।’’ শেষ রাতে ছেলের মাথার কাছে লাল আলো দেখলেন বাবা। বিছানায় উঠে বসে ছেলে বলল, ‘‘আমি যাচ্ছি।’’ তারপরই উধাও সেই লাল আলো। পরদিন দুপুরের আগেই মারা গেলেন মেজদাদা।
• আচার্য ব্রজেন্দ্রলাল শীল মৃত্যুর পর জরুরি কাগজপত্র খুঁজে পেয়েছিলেন প্রয়াত স্ত্রীর স্বপ্নে দেখানো ঠিকানায়। জ্যোতিষশাস্ত্রের মতোই প্ল্যানচেটে আস্থা রেখেছিলেন সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।
• প্রয়াত স্ত্রী গৌরীর সঙ্গে কথা বলতেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদ্যালয়ে উৎসাহীদের নিয়ে প্ল্যানচেটের আসর বসিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ আর জেলাপ্রশাসনের প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন। তার জেরেই শেষ পর্যন্ত তাঁকে খোয়াতে হয়েছিল হুগলি জেলার জঙ্গিপাড়ার দ্বারকানাথ হাইস্কুলের চাকরি। শুধু তাই নয়, প্ল্যানচেটে মা মৃণালিনীর সম্মতি পেয়ে স্ত্রী-হারা বিভূতিভূষণ রাজি হয়ে যান বয়সে সাতাশ বছরের ছোট, তাঁর প্রেমে হাবুডুবু, কল্যাণীর সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়েতে। মৃত্যুর আগে ধারাগিরিতে বেড়াতে গিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনে এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটেছিল। শোনা যায়, এক মৃতদেহের চাদর সরিয়ে তিনি আঁতকে উঠেছিলেন তাঁর নিজেরই মুখ দেখতে পেয়ে!
থিওসোফিস্টদের প্রেতচর্চা
১৮৭৫-এ আমেরিকায় ‘থিওসফিকাল সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন হেলেনা পেত্রোভনা ব্লাভাৎস্কি, কর্নেল হেনরি স্টিল অলকট-এর মতো কয়েকজন পরলোকবাদী। ১৮৭৮-এ ব্লাভাৎস্কি আর অলকট চলে আসেন বম্বেতে। সেখান থেকেই নানা দেশে ছড়িয়ে দেন এই সমিতির শাখা।
প্রতিষ্ঠার সময় সমিতির প্রচারিত লক্ষ্যের অন্যতম ছিল, ব্যাখ্যার অতীত প্রাকৃতিক নিয়ম আর মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শক্তি খুঁজে বের করা।
ব্লাভাৎস্কি আর অলকট মারা যাওয়ার পর ‘থিওসফিকাল সোসাইটি’-র সভাপতি হন অ্যানি বেশান্ত। ১৮৮২-তে কলকাতায় গড়ে ওঠে তার শাখা। এই সমিতির পরিচালনার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর দিদি স্বর্ণকুমারী।
এই সমিতির সদস্যরা বিশ্বাস করতেন আত্মা অমর এবং অবিনশ্বর। বিশ্বাস করতেন, পার্থিব জন্মে আত্মা বাসা বাঁধে স্থূলদেহের ভিতর। মৃত্যুর পর কখনও ক্ষণস্থায়ী, কখনও দীর্ঘ মৃত্যু-মূর্ছার শেষে আত্মা চলে যায় সূক্ষ্মলোকে, দিব্যজীবন লাভের চেষ্টায়।
প্রেতচক্রে আগ্রহ থাকা বাঙালিদের অনেকেরই পরলোক নিয়ে বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল সনাতন ভারতের তন্ত্রসাধনা, জ্যোতিষশাস্ত্র, সাহিত্য, দর্শন আর আধ্যাত্মিক চিন্তাকে ভিত্তি করে।
সেই উৎসাহে প্রশ্রয় দিয়েছিল ‘থিওসফিকাল সোসাইটি’ প্রচারিত পশ্চিমি দুনিয়ার নানা অতীন্দ্রিয় তত্ত্ব আর ঘটনার বিচিত্র সব বিবরণ।
শুধু নিভৃত প্রেতসাধনায় থেমে না থেকে প্রেতচর্চার তত্ত্ব আর অভিজ্ঞতার কথা লিখে গিয়েছিলেন অনেকেই। প্রেতচর্চার দৌলতে বাংলায় তৈরি হয়ে গিয়েছিল কিছু পরিভাষাও।
কান্তিক প্রেসে ভুতুড়ে কাণ্ড
২০ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে ছিল অবনীন্দ্রনাথের জামাই, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন ছাপাখানা। ‘কান্তিক প্রেস’। তার দোতলার ঘরে বসত প্ল্যানচেটের আসর। থাকতেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সাহিত্যিক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
একদিন সেখানেই প্রেত-অধিবেশনে এল রবীন্দ্রনাথের প্রিয়, শান্তিনিকেতন আশ্রমবিদ্যালয়ের অকালপ্রয়াত শিক্ষক সতীশচন্দ্র রায়ের আত্মা।
আত্মা জানাল, আসরে উপস্থিত সকলের মধ্যে স্বল্পায়ু অজিতকুমার চক্রবর্তী মারা যাবেন সকলের আগে।
সত্যিই অজিতের মৃত্যু হয়েছিল অকালেই। ইনফ্লুয়েঞ্জায়। কলকাতা শহরে।
প্রেতচর্চার বিষয়ে ‘কান্তিক প্রেস’ থেকে ছাপা মণিলালের বই ‘ভুতুড়ে কাণ্ড’ তুমুল জনপ্রিয় হয়।
আত্মারা মানুষের ডাকাডাকিতে উত্যক্ত হয় জানিয়ে মণিলালের চক্রে হাজির হওয়া এক আত্মা বলেছিল, ‘‘দেখো, আজ তোমরা প্রেতাত্মা লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছ, অনেককে তোমরা শাস্তির ভাগী করিতেছ; যখন তোমাদের মৃত্যু হইবে,—তখন সেই সব আত্মা তোমাদের উত্যক্ত করিবে, — তোমাদের লইয়া ছেঁড়াছিঁড়ি করিবে।’’
অকালে মেয়ে রমাকে হারিয়ে প্রেতচর্চায় হাতপাকানো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুরেন্দ্রনাথ মিত্র লিখে ফেলেছিলেন তাঁর নিজের বই— ‘লোকান্তর’। ১৯৪৪-এ প্রকাশিত সেই বইয়ের মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, সত্যি সত্যি চোখে দেখতে না পেলেও প্রতিদিনের অধিবেশনে যেন মেয়ের সত্যিকারের রূপই দেখেছেন তিনি। যেন শুনেছেন একেবারে নিজের মেয়ের কথাই।— ‘‘যেন পাশাপাশি বসেই আমরা তোমার সঙ্গে কথা কয়েছি।’’
এক সময় অনির্দিষ্ট, অমীমাংসিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, বাঙালির
প্রেত-বৈঠক কখন যেন হয়ে উঠেছিল অসহায়, স্বল্পায়ু, স্থূলদেহী জীবন আর অচেনা পরলোকের সেতু। এটাই কিন্তু চেয়েছিলেন থিওসফিস্টরা।
রবীন্দ্রনাথের আত্মা চলে গেলে...
১৯৪৫। পরলোকে উৎসাহী রাজেন্দ্রলাল ভট্টাচার্য প্ল্যানচেটে ডেকে আনলেন রবীন্দ্রনাথের আত্মাকে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ নাকি জানিয়েছিলেন, জনাকয়েক অবাঙালির হাত ধরে পরলোকে কুয়াশাচ্ছন্ন, অন্ধকার এক এলাকা থেকে ক্রমশ এসেছেন তীব্র আলোয় ধুয়ে যাওয়া স্থানে। দিলীপকুমার রায় আর রজনীকান্ত নতুন গান লিখে কবিকে পরলোকে স্বাগত জানিয়েছেন। দেখা হয়েছে বাবা মহর্ষিদেবের সঙ্গেও। চারপাশে আশ্চর্য সুন্দর সব ফুল আর পাখি। রাজেন্দ্রলাল পরলোক নিয়ে বই লিখবেন শুনে রবীন্দ্রনাথের আত্মা বলছিল, ‘‘তুমি তোমার বইতে লিখে রেখো যে এইখানে ভয় পাবার কিছুমাত্র নেই।’’
তারপরও আরও কথা, ‘‘অবশ্য আমি যে স্তরে আছি নিজের সুকৃতির ফলেই লোক সেখানে আসতে পারে।’’ রবীন্দ্রনাথের আত্মা চলে যাওয়ার সময় তেপায়া নড়ে ওঠে। রাজেন্দ্রলালের এই সব অভিজ্ঞতা নিয়ে ছাপা হয়েছিল তাঁর বই, ‘মৃত্যুর পরপারে’।
প্রেতচক্রে আগ্রহীদের অনেকেই বিশ্বাস করতেন ইহলোক আর পরলোকে আছে অস্তিত্বের সাতটি করে স্তর।
১৯৫৩-য় প্রকাশিত ‘পরলোক সমীক্ষণ’-এ ‘চক্রপতি’ ফণিভূষণের নানা অধিবেশনের বর্ণনায়, এক আত্মা জানাচ্ছে, নিম্নস্তরের আত্মারা খেতে পায় না, আর অস্তিত্বের পঞ্চম স্তরে মেলে জলের দেখা।
প্ল্যানচেট-এ ‘সত্য বিবরণ’ নিবেদন করে ফণিভূষণ লিখছেন, ‘‘ইহাতে পরলোকবাসীর অদ্ভুত ক্রিয়া দেখিয়া চক্র করিবার আকাঙ্খা হইবে এবং চক্র করিলে দেখিতে পাইবেন ইহা কত সত্য।’’
প্রেতবৈঠকের আসরে যেমন শোনা যেত পরিচিত, মৃত মানুষের কণ্ঠস্বর, তেমনই পরিচিত পোশাকেও দেখা যেত কাউকে কাউকে। আত্মারা মর্ত্যে এসে এঁকে যেত ছবি, গেয়ে যেত গান।
প্রেতচক্রীদের কেউ কেউ দেখেছিলেন, জীবদ্দশায় সৃজনে অতৃপ্ত আত্মাদের নিজেদের প্রকাশ করার প্রবণতা ছিল বেশি। দেখা যায় প্রেতচক্রে ধরা দেওয়া আত্মারা পৃথিবীতে থাকতে চাইছে না বেশিক্ষণ। তাদের মুখে শুধুই যেন ‘যাই আর যাই’!
প্রেত-আহ্বায়করা বিদেহী আত্মাদের কাছে যেমন জানতে চাইতেন পরলোকের কথা, কঠিন রোগের ওষুধ, হারানো সম্পত্তির হদিশ, তেমনই চাইতেন অনির্দিষ্ট মর্ত্য জীবনের ভবিষ্যৎ পথ নির্দেশ।
ধর্ম নির্বিশেষে ধরা দিত আত্মারা, যদিও ‘হিন্দুচক্র’ জাতীয় প্রেতবৈঠকের উল্লেখও পাওয়া যায়। পদ্ধতিগতভাবে বৈচিত্রময় হলেও প্রেতবৈঠকের মূল ভাবনা ছিল পরলোক আর অবিনশ্বর আত্মায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস রেখে একসঙ্গে কোথাও মিলিত হয়ে মনঃসংযোগের মাধ্যমে বিদেহী আত্মাকে মর্ত্যে ডেকে আনা। অগণিত বিশ্বাসীরা প্রেতচর্চায় আস্থা রেখেছিলেন।
তবে এইসব অভ্যাসকে ‘বুজরুকি’ অথবা ‘ভূত নাবানো’ আখ্যা দিয়ে বিদ্রুপ করতে ছাড়েননি কালীপ্রসন্ন সিংহের মতো লেখক তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য়।
অথচ প্রেতচর্চার টান এক সময় কী যে প্রবল ছিল! তার ছোট্ট একটা নমুনা এই রকম— স্ত্রী-পুত্রের মৃত্যুর পর পরলোকের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন শার্লক হোমসের স্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েল। ইংল্যান্ডে British College of Psychic Science -এর কাছেই একটা ঘরে তাঁর সঙ্গেই কয়েকটা প্রেতবৈঠক করে এসেছিলেন এক প্রেততাত্ত্বিক বাঙালি।
তবে পরলোক-উৎসাহীদের উদ্দেশে মোক্ষম প্রশ্নটা কিন্তু রেখে গিয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির এক খাজাঞ্চি কৈলাস মুখুজ্জেই।
‘জীবনস্মৃতি’- তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, পরলোকের ব্যবস্থা কেমন, গুরুজনেরা প্ল্যানচেটযোগে একবার স্বভাব-রসিক কৈলাসকে এই প্রশ্ন করলে উত্তর এসেছিল, ‘‘আমি মরিয়া যাহা জানিয়াছি আপনারা বাঁচিয়াই তাহা ফাঁকি দিয়া জানিতে চান? সেটি হইবে না।’’
প্ল্যানচেট কিন্তু আসলে ছিল প্রেতচক্রে ব্যবহার করা এক যন্ত্র। ১৯০৮ সালে ছাপা, সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য তাঁর বই ‘প্রেত-তত্ত্ব’-য় প্ল্যানচেট যন্ত্রের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে : ‘প্ল্যানচেটের আকার পানের ন্যায়। এক খানি কাষ্ঠনির্মিত সিকি ইঞ্চি বেধবিশিষ্ট তক্তাদ্বারা নির্মিত। তক্তার একদিকে একটি শিসক পেন্সিল সংলগ্ন থাকে, অপর দুইদিকে বোতামের ন্যায় দুইখানি হাড়ের চাকা এমন কৌশলের সহিত সংলগ্ন থাকে যে, ঐ যন্ত্র যে দিকে ইচ্ছা অনায়াসে নড়িতে পারে।’
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, কলকাতার পঞ্জিকায় পাতা-জোড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে ফকিরচাঁদ চক্রবর্তী লেনের এফ.সি সরকার মাশুল-সমেত তিন টাকায় বিক্রি করতেন ‘প্ল্যানচেট বা অতি আশ্চর্য্য ভৌতিক যন্ত্র’।
ঋণ: প্রবন্ধে উল্লিখিত বইপত্র ও সূত্র ছাড়াও ‘মরণের পরে’ (স্বামী অভেদানন্দ), ‘পরলোক ও প্রেততত্ত্ব’, (স্বামী দিব্যানন্দ), ‘অনন্তের লুকোচুরি’ (সুভাষ ঘোষাল), ‘পথের কবি’ (কিশলয় ঠাকুর), ‘Theosophy and the Theosophical Society’, (Annie Besant), ‘প্ল্যানচেটে পরলোকের কথা’ (সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী), ‘পরলোকের কথা’ (মৃণালকান্তি ঘোষ), ‘মানুষ চিত্তরঞ্জন’ (অপর্ণা দেবী), ‘রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা’ (অমিতাভ চৌধুরী), ‘পরলোকবিচিত্রা’ (সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়), অসিত পাল