জাগাও কবিকে, ও সে ঘুমে অচেতন

হাসপাতালে মারাত্মক রোগযন্ত্রণায় কেটেছে জীবনের শেষ কয়েকটি মাস। কথা বলা, গান গাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল চিরতরে। তবু তাঁর গানে, কবিতায় অশেষ সমর্পণ আর শরণাগতি। ২৬ জুলাই ছিল রজনীকান্ত সেনের জন্মদিন। লিখছেন শিশির রায়।ডোভার লেনের এই শান্ত, চুপচাপ, একতলা বাড়িটা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে কাজফেরতা সান্ধ্য বিনোদন, পানভোজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে আর একটা কলকাতা। আর এই ঘরে, চেয়ারে বসে আছেন যে মানুষটা, তাঁর বয়স একশো এক পেরিয়ে দুই। রজনীকান্ত সেনের সার্ধশতবর্ষ পেরিয়েছে গত বছর, আর আমার চোখের সামনে এক জীবন্ত শতবর্ষ!

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share:

রজনীকান্ত সেন

‘‘কী লিখবেন রজনীকান্ত সেন সম্পর্কে?’’

Advertisement

আপনিই বলে দিন, কী লিখব আপনার দাদুকে নিয়ে। কী লেখা উচিত, বলুন।

‘‘রজনী সেনের মতো এক জন মানুষ কী খেতেন, কী পরতেন, এই সব লেখার জিনিস নয়। লিখলে ওঁর গান নিয়ে লিখতে হয়। ওঁর ভাব নিয়ে, ওঁর গানের কথায় সমর্পণ, ভক্তি নিয়ে লিখতে হয়। ওঁর সুরে বৈচিত্র নেই, রামপ্রসাদ থেকে কাঙাল হরিনাথ, প্রচলিত সবার সুর নিয়েছেন। নিয়ে মিশিয়েছেন নিজের সারল্য, শরণাগতি। এগুলো ধরতে পারলেই রজনী সেনকে ধরা যাবে।’’

Advertisement

জুলাইয়ের সন্ধে নেমে এসেছে তখন। ডোভার লেনের এই শান্ত, চুপচাপ, একতলা বাড়িটা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে কাজফেরতা সান্ধ্য বিনোদন, পানভোজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে আর একটা কলকাতা। আর এই ঘরে, চেয়ারে বসে আছেন যে মানুষটা, তাঁর বয়স একশো এক পেরিয়ে দুই। রজনীকান্ত সেনের সার্ধশতবর্ষ পেরিয়েছে গত বছর, আর আমার চোখের সামনে এক জীবন্ত শতবর্ষ! তাঁর বসার ভঙ্গি ঋজু, কণ্ঠস্বর অকম্প্র, আর স্মৃতিশক্তি? নিখুঁত, নির্ভুল, অবিরল কান্তকবিতা বলে চলেছেন, ‘‘ওরে, ওয়াশীল কিছু দেখিনে জীবনে, সুধু ভূরি ভূরি বাকি রে;/ সত্য সাধুতা সরলতা নাই, যা আছে কেবলি ফাঁকি রে।/... কত যে মিথ্যা, কত অসঙ্গত স্বার্থের তরে ব’লেছি নিয়ত;/ (আজ) পরম পিতার দেখিয়া বিচার, অবাক্‌ হইয়া থাকি রে!’’ আজকের প্রজন্ম ‘ওয়াশীল’ শব্দের অর্থ জানে?

‘‘জানবে কী করে? একটা বড় মানুষকে, প্রতিভাকে সংরক্ষণ করে প্রথমত তার পরিবার। তাঁদের মধ্য দিয়েই তো ভবিষ্যৎ দেশ-কাল জানবে তাঁকে। উই আর ভেরি ব্যাড প্রিজ়ার্ভার্স। আমার মামারা, এমনকি দিদিমাও তেমন বলতেন না পরে, দাদুর কথা। দিদিমা বলতেন, মেডিক্যাল কলেজে যে রাতে উনি চলে গেলেন, ওই শোকের মধ্যে শুধু এটাই মনে হয়েছে, কাল সকালে আমার এতগুলো ছেলেমেয়েকে আমি কী খাওয়াব?’’

রজনীকান্তের স্ত্রী হিরণ্ময়ী দেবী, প্রৌঢ় বয়সে

শুনে মনে হচ্ছে তো, বাঙালি প্রতিভা আর মনীষার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলে যে, সেই আদি ও অকৃত্রিম দারিদ্রের আর একটা উদাহরণের গল্প শুনতে বসেছি? আদৌ তা নয়। রজনীকান্তের গলায় ক্যানসার হয়েছিল, ১৯১০ সালের কলকাতায় ক্যানসারের চিকিৎসা কোথায়? তাঁর ডায়েরিতে পাওয়া যায়: ‘‘...গলায় একটা ছিদ্র করে দিয়েছে। সেইখান দিয়ে নিশ্বাস চলছে। গলার ক্যান্সার যেমন, তেমনি গলার মধ্যে বসে রয়েছে। তার তো কোনও চিকিৎসাই হচ্ছে না।...’’ তবু কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ১২ নম্বর কটেজ ওয়ার্ডে রজনীকান্ত সেন যে মাস সাতেকের চিকিৎসা পেয়েছিলেন, তা কিন্তু রীতিমতো খরচসাপেক্ষ ছিল। দোতলা কটেজে অনেক ঘরে পরিবারের সবাই এমনকি দর্শনার্থীরাও থাকতে পারতেন ভাল ভাবে, সর্বক্ষণ ডাক্তার, নার্স, প্রয়োজনীয় ও জরুরি পরিষেবা সবই পাওয়া যেত— কিন্তু এই সব কিছুতেই তো প্রয়োজন অর্থের। রজনীকান্ত অতুলপ্রসাদের মতো পসারওয়ালা উকিল ছিলেন না ঠিকই, তবে রাজশাহীতে তাঁর অর্থাভাব ছিল না। কিন্তু তিনি সঞ্চয় করেননি, ও জিনিসটা তাঁর ধাতে ছিল না। চিকিৎসার বিপুল খরচ জোগাতে তাঁর ঋণ হয়েছিল, তিনি বন্ধু-পরিজনদের ‘দান’ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অর্থসাহায্য করেছিলেন দীঘাপতিয়ার কুমার শরৎকুমার রায়, কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, বিচারপতি সারদাচরণ মিত্র, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, অশ্বিনীকুমার দত্ত-সহ বহু শুভার্থী গুণিজন। এর পাশাপাশিই পড়া যেতে পারে রজনীকান্তের মেয়ে শান্তিবালার (শান্তিলতা রায়) লেখা: ‘‘বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পরে আমার মা মহারাজার কাছ থেকে মাসিক সাহায্য ও বাবার ঋণ শোধের জন্য পাওনা সমস্ত টাকাই মহারাজের অনুরোধে মহারাজার কাছেই শোধ করে দিয়েছিলেন। দেশবাসী সকলের ধারণা হয়েছিল যে বাবা কপর্দকহীন দরিদ্র ছিলেন। কিন্তু তাঁরা ভিতরকার কথা কিছু জানতেন না। সেই জন্য এই কথা কয়টি আমায় বলতে হল।...’’

মেয়ে শান্তিবালা দেবী (শান্তিলতা রায়)

এই শান্তিবালার কথা উঠতেই সামনে বসা মানুষটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ‘‘আমার মা-ই তো গলায় তুলে নিয়েছিলেন দাদুর অনেক গান!’’ রজনীকান্তের এক ছেলে (ভূপেন্দ্র) ও এক মেয়ে (শতদলবাসিনী) অসুখে ভুগে মারা যাওয়ার পরে বাকি ছেলেমেয়েদের চোখের আড়াল করতে চাইতেন না গায়ক-কবি। তাঁদের মধ্যেও ছেলে ক্ষিতীন্দ্র ও মেয়ে শান্তিবালার কথা বলতে হয় আলাদা করে। এঁরাই তাঁদের বাবার অধিকাংশ গান শিখে নিয়ে গাইতেন— উৎসব-অনুষ্ঠানে বা বাড়িতে। একটু বলুন না, মায়ের কাছে শোনা কোনও বিখ্যাত গান তোলার ঘটনা, বা অন্য কোনও গানের গল্প?— সাংবাদিকসুলভ কৌতূহলকে মুহূর্তে দমিয়ে দেন গম্ভীর বরিষ্ঠ মানুষটি: ‘‘ঘটনা আবার কী? বাবার কাছে মেয়ে গান শিখছে, যেমন শেখে— চলতে-ফিরতে। হয়তো নতুন গান লিখেছেন একটা, মেয়ে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ডেকে তুলিয়ে দিলেন। এ ভাবেই মায়ের শেখা। পরে ওঁর কাছ থেকে আমার।’’

রজনীকান্তের গানের গল্প লিখে গিয়েছেন অন্যেরা। যেমন জলধর সেন। রাজশাহী লাইব্রেরিতে সাহিত্যসভা, সেখানে যাওয়ার পথে বন্ধু অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র বাড়িতে এসেছেন রজনীকান্ত। বন্ধুই বললেন, খালি হাতে কেন সভায় যাবে, একটা গান বেঁধে নাও। জলধর সেন শুনে অবাক, সভা শুরু হতে বাকি এক ঘণ্টা, এখন গান বাঁধা হবে? তার পরে সুর দেওয়া, তারও পরে গাওয়া? রজনীকান্ত কিন্তু এক কোণে টেবিলের পাশে চেয়ার টেনে বসলেন। খানিক ক্ষণ চুপচাপ, তার পর একটা কাগজ টেনে খসখস লেখা। সেই গানই ছিল ‘তব চরণ-নিম্নে, উৎসবময়ী শ্যাম-ধরণী সরসা’। আর ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’, যে গানের মধ্য দিয়ে রজনীকান্ত হয়ে উঠেছিলেন সারা বাংলার ‘কান্তকবি’, তার জন্মকাহিনিও তো চমৎকার। বঙ্গভঙ্গের সময়ে স্বদেশি আন্দোলনে উত্তাল কলকাতায় অক্ষয়কুমার সরকারের মেসে এসেছেন রজনীকান্ত। মেসের ছেলেরা ধরে বসল, একটা গান লিখে দিতে হবে। স্থায়ী আর অন্তরাটুকু লিখে রচয়িতা নিজেই যারপরনাই উত্তেজিত, ‘‘চল জল’দার ওখানে যাই।’’ কী না, ওখানে ‘আদ্ধেক’ গান কম্পোজ় হতে হতে বাকিটা লেখা হয়ে যাবে। জল’দা মানে জলধর সেন, ‘ওখানে’ মানে ‘বসুমতী’র দফতরে। সত্যিই তাই হল! এক দিকে কম্পোজ় চলছে, অন্য দিকে বাকি গান লেখা হচ্ছে। তার পর গানের সুর হল, কাগজে ছাপা গান নিয়ে চলে গেল মেসের ছেলেরা। সন্ধেয় জলধর সেন বিডন স্ট্রিটের এক বাড়ির দোতলার বারান্দায় বসে আছেন। হঠাৎ শুনলেন, দূর থেকে এক দল ছেলে গান গাইতে গাইতে আসছে। কয়েক ঘণ্টা আগে বসুমতীর প্রেসে ছাপা গান— ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’। আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর লেখাতেও আছে, বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার কয়েক দিন পর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে তরুণ-যুবার দল খালি পায়ে হাঁটছে আর ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গাইছে। শুনে রোমাঞ্চ হয়েছিল তাঁর।

রাজশাহীর বাড়ি। ২০১৪ সালের ছবি

বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জের ভাঙাবাড়ি গ্রামের ছেলে জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন আর এক শহর রাজশাহীতে। জ্যাঠামশাই ও বাবার পথে গিয়ে নিজেও আইন পড়ে ওকালতি পেশায় এসেছেন। কিন্তু মন ছিল সাহিত্যেই। বৈষ্ণব ভক্তিতে বিবশ তাঁর মুন্সেফ বাবা ব্রজবুলিতে রচনা করেছিলেন ‘পদচিন্তামণিমালা’। ও দিকে জ্যাঠামশাই পরম শাক্ত, বাড়িতে দুর্গাপূজা করেন, বলি দেন। রজনীকান্ত এই দুই ধারা থেকেই ছেঁকে নিয়েছিলেন বিশুদ্ধ ভক্তিটুকু। মায়ের মুখে রামায়ণ-মহাভারত থেকে শুরু করে সে কালের নাটকগুলির পাঠ শুনতেন, আর তা বসে যেত মাথায়, মনে। অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল। নিজেই বলেছেন সে কথা: ‘‘বই একবার পড়্‌লে প্রায় মুখস্থ হ’ত... একটা পরখ এখনও দিতে পারি। যে কোন একটা চারি লাইনের সংস্কৃত শ্লোক (যা আমি জানি না) তুমি একবার ব’লবে, আমি immediately reproduce কর্‌ব। একটুও দেরী হবে না।’’

রজনীকান্ত সংস্কৃত জানতেন দুর্দান্ত। রাজশাহী কলেজে তাঁর সহপাঠীরা সাক্ষী, মাস্টারমশাইয়ের ক্লাসে আসতে দেরি হলে তিনি মুখে মুখে সংস্কৃত কবিতা বানাতেন, ব্ল্যাকবোর্ডে সংস্কৃত ধাঁধা লিখতেন। মাস্টারমশাইদের নকল করে ছড়া কাটতেন সংস্কৃতে, কখনও ব্যাকরণে সুপণ্ডিত কিন্তু জনসমক্ষে বক্তৃতায় অপটু মাস্টারমশাইকে নিয়ে, কখনও বৃহদ্বপু শিক্ষকের মোটা পেটটি নিয়েও: অজরো(অ)মরঃ প্রাজ্ঞঃ হরগোবিন্দশিক্ষকঃ।/ বেতনেনোদরস্ফীতঃ বাগ্‌দেবী উদরস্থিতা।। (মাস্টারমশাই হরগোবিন্দবাবু অজর, অমর,
প্রাজ্ঞ। মাসমাইনে পেয়ে পেটটি মোটা, বিদ্যেও সমস্তটাই পেটে (মুখে সরে না)।

এই ছেলে যে পরে হাসির গান-কবিতায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে পাল্লা দেবেন, আশ্চর্য কী! ‘সাধনা’ পত্রিকায় দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির কবিতা ‘আমরা ও তোমরা’ বেরিয়েছে (যা আবার রবীন্দ্রনাথের করুণরসাশ্রিত কবিতা ‘তোমরা এবং আমরা’র দ্বিজেন্দ্র-প্রতিক্রিয়া), রজনীকান্ত সমান হেসে ও হাসিয়ে লিখলেন ‘তোমরা ও আমরা’— ‘উৎসাহ’ পত্রিকায়। জীবনের শেষ দিকে যখন গলার ক্যানসারে বাক্‌রুদ্ধ, হৃতকণ্ঠ, তখনও ডায়েরিতে লিখে গিয়েছেন ‘জোক’: ‘‘একটা রাখাল দুটো গরু নিয়ে যাচ্ছিল— তার একটা খুব মোটা, আর একটা খুব রোগা। একজন উকীল সেই পথে যান। তিনি রাখালকে জিজ্ঞাসা কর্‌লেন,— তোর ও গরুটা অত মোটা কেন, আর এটা এত হাল্‌কা কেন? এটাকে খেতে দিস্‌নে না কি? রাখাল উকীলকে চিন্‌ত; ব’ল্লে— আজ্ঞে না। মোটাটা উকীল, আর রোগাটা মক্কেল,— রাগ কর্‌বেন না।’’

এ রকমই মানুষটা। সমাজের অবক্ষয় দেখে— ডাক্তার, মোক্তার, উকিলের সমাজ-শোষণ দেখে— কবিতা লিখে গিয়েছেন। আমরা রজনীকান্তকে ‘পঞ্চকবি’র মধ্যে পুরে দিয়েই খালাস, ওঁর গান যদিও বা একটু শুনি-জানি, ওঁর কবিতা (অনেক কবিতা যদিও গানই) নিয়ে চর্চা হয় না বললেই চলে। অথচ মানুষটা উঠতে-বসতে লিখেছেন। টুকরো কাগজে গান বা কবিতা লিখে টেবিলে রেখে দিতেন বা জামার পকেটে। সেই কাগজের টুকরো হয়তো উড়ে গিয়েছে টেবিল থেকে। ওঁর স্ত্রী হিরণ্ময়ী দেবী উদ্ধার করেছেন পরে। কত গান, কবিতা হারিয়েও গিয়েছে এই ভাবে। ওকালতি পেশা ছিল বলেই করতেন। কুমার শরৎকুমার রায়কে চিঠিতে লিখেছেন: ‘‘আমি আইনব্যবসায়ী, কিন্তু আমি ব্যবসায় করিতে পারি নাই। কোন্‌ দুর্লঙ্ঘ্য অদৃষ্ট আমাকে ঐ ব্যবসায়ের সহিত বাঁধিয়া দিয়াছিল, কিন্তু আমার চিত্ত উহাতে প্রবেশ লাভ করিতে পারে নাই। আমি শিশুকাল হইতে সাহিত্য ভালবাসিতাম; কবিতাকে পূজা করিতাম; কল্পনার আরাধনা করিতাম; আমার চিত্ত তাই লইয়া জীবিত ছিল।’’ বেঁচে থাকতে তিনটে বই বেরিয়েছিল ওঁর, ‘বাণী’, ‘কল্যাণী’, ‘অমৃত’। ওঁর কবিতা এমন সাড়া ফেলেছিল, কয়েক মাসের মধ্যেই একটা বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়। ছোটদের নীতিশিক্ষার জন্য লিখেছেন ‘সদ্ভাব-কুসুম’। হাসপাতালে দুঃসহ রোগযন্ত্রণার মধ্যেও লিখেছেন উমার আগমনী ও বিজয়া সঙ্গীতকাব্য ‘আনন্দময়ী’। আরও আছে— কাব্যগ্রন্থ ‘অভয়া’, ‘বিশ্রাম’, একেবারে শেষের দিকের লেখাগুলি নিয়ে ‘শেষ দান’। চিকিৎসার খরচ জোগাতে ‘বাণী’ ও ‘কল্যাণী’র গ্রন্থস্বত্ব আর কিছু বিক্রি না হওয়া বই বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন মাত্র চারশো টাকায়। স্ত্রী কেঁদে আকুল। তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আমাকে যদি দয়াল আর কিছু দিন বাঁচিয়ে রাখে তবে শত সহস্র বাণী, কল্যাণী লিখে তোমার পায়ে অঞ্জলি দেব, তুমি আর কেঁদো না।’’ রোজনামচায় লিখে গিয়েছেন, ‘‘আমার এমন অবস্থা হ’ল যে, আর চিকিৎসা চলে না, তাইতে বড় আদরের জিনিষ বিক্রয় ক’রেছি। হরিশ্চন্দ্র যেমন শৈব্যা ও রোহিতাশ্বকে বিক্রয় ক’রেছিলেন। হাতে টাকা নিয়ে আমার চক্ষু দিয়া জল পড়িতেছিল।...’’

রজনীকান্তের ডায়েরি পড়লে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। এই রোজনামচা বিখ্যাত মানুষের অন্তরকাব্য নয়, পাশের মানুষটির সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন থেকে তার জন্ম। নিজের রোগের কথা নিজেই লিখছেন: ‘‘গলনালী আর শ্বাসনালী দুটো জিনিষ আছে। আমার ভাত খাবার নালীর মধ্যে ঘা নয়, নিঃশ্বাসের নালীর মধ্যে ঘা, সেখানে কোনও ঔষধ লাগানো যায় না।’’ গান গাওয়ার সময় সময়ের হিসেব থাকত না রজনীকান্তের। রংপুরে গিয়ে সন্ধে থেকে রাত একটা-দেড়টা পর্যন্ত টানা গান গাইছেন, আবার পরের দিন অবিশ্রান্ত। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সাহেব ডাক্তার দেখে জানিয়েছিলেন, ‘ওভারস্ট্রেনিং অব ভয়েস’ই সম্ভবত অসুখের কারণ। ধুম জ্বর, খেতে যন্ত্রণা, গলা ফুলে ওঠা, কাশিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ট্রাকিয়োটমি অপারেশন করে গলায় শ্বাসপ্রশ্বাস চলাচলের জন্য ছিদ্র করে বসিয়ে দেওয়া হল রবারের নল। বন্ধ হয়ে গেল গান, কথা বলা— পরে খাওয়াও। বিছানার পাশে কাগজ-পেনসিল থাকত, সেখানেই লিখে দিতেন দরকারি কথা, মনের কথাও। সেই সব টুকরো টুকরো লেখা পড়ে মানুষটার শেষের ক’মাসের প্রতিটি দিন অনুমান করা যায় মাত্র, তল পাওয়া যায় না।

‘‘তোমাদের মতন যদি আমার আগেকার মত Loud Logic থাক্‌তো তবে তর্ক করতেম। তোমরা চট করে বলে ফেল, উত্তর লিখ্‌তে আমার প্রাণান্ত।’’

‘‘আমার শ্রাদ্ধে বেশি খরচ ক’র না। কিন্তু যেমন পিপাসা তেমনি খুব জল দিও। আম উৎসর্গ করিও। জল দিতে কৃপণতা ক’র না। বড় পিপাসায় ম’লাম, জল দিও।’’

‘‘আমি একটু বাঙ্গালা সাহিত্যের আলোচনা করেছিলাম ব’লে বাঙ্গালা দেশ আমার যা কর্‌লে তা unique in the annals of Bengali Literature. এই সাহিত্য-প্রিয় বাঙ্গালা দেশ, মানে— Literature-loving section of Bengalis bearing the major portion of my expenses. Is it not unprecedented in a poor country like mine?’’

সমাজের সব শ্রেণির মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন কান্তকবির সাহায্যে। কুমার শরৎকুমার রায় টাকা পাঠাতেন। মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ওঁর সংসারের, ছেলেদের পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। হাসপাতালে কত যে মানুষ রোজ আসতেন, তার ইয়ত্তা নেই। মেডিক্যাল কলেজের ছেলেরা পালা করে ওঁর শুশ্রূষা করতেন, কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র হেমেন্দ্রনাথ বক্সী তো ছায়ার মতো থাকতেন ওঁর পাশে। স্কুল-কলেজের ছেলেরা রজনীকান্তের ‘অমৃত’ নিজেরাই দায়িত্ব নিয়ে বিক্রি করে সেই টাকা তুলে দিয়েছিল কবির হাতে। মিনার্ভা থিয়েটারে ‘রাণাপ্রতাপ’ ও ‘ভগীরথ’ নাটকের স্পেশ্যাল শো হয়েছিল সারদাচরণ মিত্রের উদ্যোগে, রজনীকান্ত সম্পর্কে গিরিশ ঘোষের লেখা পাঠ করা হয়েছিল অভিনয়ের আগে। সেই সন্ধ্যার টিকিট-বিক্রির বারোশো টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল ওঁকে। বরিশাল থেকে উকিলরা টাকা তুলে পাঠিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় হাসপাতালে তাঁকে দেখতে এসে বলেছিলেন, ‘‘আমার আয়ু নিয়ে আপনি আরোগ্য লাভ করুন!’’

এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রোগযন্ত্রণা ভুলে রজনীকান্ত সে দিন হেঁটে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে। সে দিনের করুণ বর্ণনা ধরা আছে মেয়ে শান্তিবালার লেখায়। ‘‘কাকে দেখতে এসেছি, কাকে দেখছি,’’ বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রজনীকান্ত তো কথা বলতে পারেন না, কাগজে লিখেই জানিয়েছিলেন তাঁর মনের ভিতরের তোলপাড়। রাজশাহীতে নাটকের মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা ও রাণী’তে রাজার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, সেই কথা। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে রজনীকান্তের গান শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই স্মৃতি। ছেলেমেয়েদের ডেকে গান শোনাতে বললেন— ‘বেলা যে ফুরায়ে যায় খেলা কি ভাঙে না হায়...’ নিজে অর্গান বাজিয়েছিলেন সঙ্গে। চলে যাওয়ার সময় রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন, ‘‘আমায় আশীর্বাদ করুন, দয়াল শীঘ্র আমাকে তার কোলে নিয়ে যান।’’ সে দিন রাতেই গান লিখে বোলপুরে পাঠালেন— ‘আমায় সকল রকমে কাঙ্গাল করিয়া গর্ব করেছ দূর’। আর বোলপুর থেকে রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিটা তো ইতিহাস: ‘‘শরীর হার মানিয়াছে কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাই। কণ্ঠ বিদীর্ণ হইয়াছে কিন্তু সঙ্গীতকে নিবৃত্ত করিতে পারে নাই। পৃথিবীর সমস্ত আরাম ও আশা ধূলিসাৎ হইয়াছে কিন্তু ভূমার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসকে ম্লান করিতে পারে নাই।...আত্মার এই মুক্ত স্বরূপ দেখিবার সুযোগ কি সহজে ঘটে।’’

বন্ধু যাদব গোবিন্দ সেনকে কথা দেওয়া আছে, তাই হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থাতেও বড় ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। খুব ইচ্ছে ছিল নিজে রাজশাহী গিয়ে ছেলের বিয়ে দেবেন, তা হয়নি। নববধূ হাসপাতালে এসে শ্বশুরমশাইকে প্রণাম করতে, তার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘‘মা তুমি আনন্দময়ী হয়ে ঘরে থাকো। বড় কষ্ট পাচ্ছি মা। আমার একটু আরামের জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করিস। লক্ষ্মীরূপিণী মা, তোর প্রার্থনা সেই দয়াল শুনবেন।’’

মৃত্যু ক্রমশ এগিয়ে আসছে দেখতে পাওয়া একটা মানুষ কেমন আচরণ করে? সাহিত্যে-সিনেমায় উদাহরণ ভূরি ভূরি। রোজকার বাস্তবে, মুমূর্ষু প্রিয়জনদের মধ্যেও কি দেখিনি? তীব্র অবিশ্বাস। অতল হতাশা। আকুল কান্না। যে আসছে, বসছে পাশে, তাকেই আঁকড়ে ধরা, ভেঙে পড়া। রজনীকান্তও রোগমুক্তির আশায় ছুটে গিয়েছেন কাশী, বালাজি মহারাজের নিদান মেনে গঙ্গাস্নান করেছেন, প্রলেপ লাগিয়েছেন গলায়। তাঁর বৃদ্ধা মা ছুটে গিয়েছেন তারকেশ্বরে, হত্যে দিয়েছেন। ইউনানি, কবিরাজি চিকিৎসা, কাঁচরাপাড়ার পাগলাবাবা— সব দেখানো হয়েছে। এ দিকে মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসা, গলার ভিতরে এক্স-রে, ক্রমাগত ইঞ্জেকশন। কাজ হয়নি কিছুতেই। হওয়ারও ছিল না। এক দিন সবাইকে ডেকে বললেন, ‘‘আমার ছোট ছেলেটার মাত্র দু’বছর বয়স, ওকে আমার কোলে দিয়ে একটা ফটো তুলে রাখ। বড় হয়ে ও দেখবে ওরও বাবা ছিল।’’

সামনে খাবার, খেতে পারেন না। অসম্ভব পিপাসা, কিন্তু জল দিলে সব পড়ে যায় বুক বেয়ে। মুখ দিয়ে কখনও বেরিয়ে আসে দুর্গন্ধময় পুঁজ-রক্ত। রাতের পর রাত ঘুম হয় না। তাই কাগজ টেনে রজনীকান্ত সেন লিখে যান একের পর এক লেখা— গান। কবিতা। মনের কথা। কখনও মাকে, কখনও দয়ালকে। সেই গানে যন্ত্রণা কোথায়, বরং অশেষ কৃতজ্ঞতা। ছত্রে ছত্রে নিঃশেষ সমর্পণ, শান্ত শরণাগতি। এক দিন গেয়েছিলেন ‘আমি অকৃতী অধম ব’লেও তো মোরে কম ক’রে কিছু দাওনি’, সেই তিনিই হাসপাতালে বসে লেখেন ‘সেখানে সে দয়াল আমার বসে আছে সিংহাসনে’ বা ‘ওগো, মা আমার আনন্দময়ী, পিতা চিদানন্দময়’। অন্তরে কোন সাধন থাকলে এমন লেখা যায়? এক দিন কাগজের টুকরোয় লেখা ‘কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব’ গানখানি দেখে স্ত্রী উদ্বেগে বলেছিলেন, কথা দাও, এ গান তুমি আর গাইবে না। রজনীকান্তও গাননি আর। তবে হাসপাতালে বলে গিয়েছিলেন, তাঁর শেষযাত্রায় যেন এই গানই গাওয়া হয়। শান্তিবালার লেখায় আছে রজনীকান্তের মৃত্যুর অনেক বছর পরের এক স্মৃতি। সিলেটে শ্রীহট্ট মহিলা সমিতির সভা, রবীন্দ্রনাথ এসেছেন। মেয়েরা রবীন্দ্রনাথকে তাঁরই গান শোনালেন, তার পর কবিকে অনুরোধ করলেন একটা গান গাইতে। রবীন্দ্রনাথ সে দিন গেয়েছিলেন রজনীকান্তের গান, ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিনমর্ম মুছায়ে...।’

রাত গড়াচ্ছে। উঠতে হবে এ বার। উসখুস মন তবু ‘শেষ কথা’ শুনতে চায়। রাজশাহীতে গিয়েছেন? ওঁর বাড়িটা এখন... উত্তর এল, বাড়িটা আছে। জরাজীর্ণ দশা। এক পাশে কয়েকটা ঘর নিয়ে একটা ব্যাঙ্কের অফিস। রজনীকান্তের স্মৃতি কিছু নেই। ‘কান্তকবির বাড়ি’ জাতীয় একটা ফলকও চোখে পড়েনি।

গড়িয়াহাটে রাস্তা পেরোতে কানে বাজছিল শতায়ুর কণ্ঠস্বর, ‘‘উই আর ভেরি ব্যাড প্রিজ়ার্ভার্স...’’

কৃতজ্ঞতা:
দিলীপকুমার রায়, অর্চনা ভৌমিক, আশীষ সেনগুপ্ত, মধুমিতা ঘোষ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন