সে দিনের মহলায় ঋদ্ধি, কৌশিক, রেশমী ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
ঠিক পাঁচ-সাড়ে পাঁচ মিনিট!
তার মধ্যেই মনে হল, পায়ের নীচে রাঙামাটির খড়বড়ে কাঁকুড়ে জমিটা জড়ো হয়ে গেছে।
জয়চণ্ডী পাহাড়টা নেই। নেই শালের জঙ্গল, মহুয়ার গন্ধ, মাদল-ধামসার দ্রিমি দ্রিমিও। তবু!
পর্দা ওঠার আগেই ধরতাইটা দিয়ে গেল পুরুলাইয়া বা়ংলা টানে ভাষণ—
নমস্কার, নমস্কার। আপনাদের সক্কলে নমস্কার। এই সভায় আসার জইন্য ধইন্যবাদ। বিশেষ কইর্যা ধইন্যবাদ ম্যাক্স ইন্ডিয়ার সিইও ম্যাথু আলেপ্পনকে। আইজ আমাদের খুব আনন্দের দিন। এই পুণ্যতোয়া প্রকল্পটিকে বাস্তবত রূপ দেওয়ার জইন্য ঝরনাটি আমাদের ইখানে আছে... তাকে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলার কাজ শুরু হইল...
পর্দা সরলে ওলটপালট শরীরে ছৌ-নাচ। তার একটু পরেই রুখা মাটির কান্না হয়ে বেজে উঠল গান—
দংশিলা কালিয়া ফণি/ বিষ নামে না প্রাণসজনী/ উপায় কী করি...
থার্ড বেলের রেশ কান থেকে মুছে যাবার আগেই একের পর এক এমন মাস্টার স্ট্রোক শরীরটাকে এক ঝটকায় অবশ করে থিয়েটার নামের এক জীবনে যুতে দিল!
•
পাক্কা ১৩৪ বছর আগে লেখা একটা নাটক। হেনরিক ইবসেনের ‘অ্যান এনিমি অব দ্য পিপ্ল’।
৬৬টি বছর আগে যাকে ভাবান্তর করলেন আর্থার মিলার।
ব্রডহার্স্ট থিয়েটার থেকে বিবিসি হয়ে এই বাংলাতেও যার ছায়া গড়িয়েছে। শম্ভু মিত্র করেছেন ‘দশচক্র’, সত্যজিৎ রায় ‘গণশত্রু’।
তাকেই এ বার কৌশিক সেনের ‘স্বপ্নসন্ধানী’ মঞ্চে আনছে ‘দ্রোহকাল’ নামে, এক্কেবার রাঢ় বাংলার মোড়কে। লিখেছেন উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়।
যার প্রথম শো আগামীকাল। ৮মে, সন্ধে সাড়ে ৬টা। তপন থিয়েটার।
•
মেশিনের ঠাং ঠাং ঠাং ঠাং শব্দ। ছলবল করে বয়ে চলে ঝরনার আওয়াজ। সেই শব্দ-আওয়াজ গায়ে মেখেই টলটলে জল আলো হয়ে লুটোপুটি খাচ্ছে মঞ্চে।
শুরু থেকে এতক্ষণ পিছনের নীলসাদা ডোরা কাটা ঝোলানো জালটার সামনে খাড়াই একটা জলের পাইপ ছিল শুধু। এ বার তার ঠিক গা ঘেঁষে ওপর থেকে নেমে এল যেটা, তাকে চওড়া আখাম্বা একটা আস্ত পাম্প ঘরই বলা চলে! আড়াআড়ি, কোনাকুনি, এলোমেলো পাইপে-পাইপে বাঁধা। স্বচ্ছ পাইপের পেটে নীল জলের ধারা।
দেখতে দেখতে মঞ্চটাকে প্রায় গিলে ফেলল আরও কয়েকটা খাড়াই পাইপ। ডানধারের কোনাটায় শুধু ডাক্তারি বইয়ে ঠাসা একটা ঘরাঞ্চি। মেডিকেল চার্ট। ওটাই হয়ে উঠল ডা. সত্যবতী সেনের (রেশমী সেন) বাড়ির চেম্বার।
এক দিকে পাইপ-রাজের দখলদারি, অন্য দিকে ছোট্ট পরিসরে ডাক্তারি চেম্বারের জেগে থাকা।
স্থান সংকুলানের অসম ভাগাভাগিটা স্পষ্ট হয়ে আবার করে যেন নাটকের টিউনটাকে বেঁধে দিয়ে গেল।
•
বিহার-পুরুলিয়া সীমান্তে ছোট্ট মফস্সল শহর। অজয়পুর।
ম্যাক্সইন্ডিয়া যেখানে রিসর্টের জমি নিয়েছে। ঝরনার জল বোতলে ভরে পানীয় জলের কারখানা করবে তারা।
সুইমিং পুল হবে।
গরম জল সাপ্লাই দিয়ে বলবে ‘উষ্ণ প্রস্রবণ’।
তাতে স্নান করলে ব্যথা মরবে।
এই ‘পুণ্যতোয়া প্রকল্প’ নাকি ভোল বদলে দেবে এই অজ অজয়পুরের!
মিউসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান গগন চক্রবর্তী (কৌশিক সেন)। সত্যবতীর কেমন-যেন দাদা।
তিনি মাইক বাজিয়ে সভায় বলেছেন, সাহেবরা স্নান করতে আসবে। পাঁচ বছরের মধ্যে সক্কলের আয় দশ গুণ বেড়ে যাবে। বড় বড় ইস্কুল হবে। বড় বড় গাড়ি চলবে। প্রকল্পের পর প্রকল্প। উন্নয়নের পর উন্নয়ন। চাকরির পর চাকরি। এলাকায় স্বর্ণযুগ এনে দেবে পূণ্যতোয়া!
অথচ তার যে গোড়াতেই গলদ!
এলাকার বাসিন্দাদের চর্মরোগ দেখে সন্দিগ্ধ সত্যবতীডাক্তার দু-দু’বার জল পরীক্ষা করিয়ে তার মধ্যে আর্সেনিক, অ্যাসিড, কার্বন, সোরার মতো ‘বিষ’ পেলেন।
‘পুণ্যতোয়া’ হলে এই মারণ বিষে ভরে যাবে এলাকা। জেনে শুনে কী করে তিনি এমন বিষপানের দিকে ঠেলে দেবেন এই অজয়পুরকে!
রুখে দাঁড়ান সত্যডাক্তার।
শুরু হয়ে যায় টক্কর।
ডাক্তারের পয়লা নম্বর প্রতিপক্ষ তখন গগন। যিনি এক দিকে চোরা শাসানিতে টুঁটি চিপে ধরতে চান বোন সত্যবতীর।
অন্য দিকে হয়ে যান অজয়পুরে ‘উন্নয়ন’-এর স্বপ্নবেচা ফেরিওয়ালা।
আবার তারই সঙ্গে প্রায় ‘দেশদ্রোহী’ ছাপ্পা মেরে সত্যকে একঘরে করার খেলাও তাঁর থামে না।
সত্য ধীরে ধীরে দেখতে পান অসংখ্য মুখ আর মুখোশের সারি।
যাদের এক দল না-বুঝে, না-জেনে উন্নয়নের বড়ি গিলে ধীরে ধীরে মৃত্যুসড়কে পা রাখে।
অন্য দল জেনে বুঝে ‘উন্নয়ন’-এর দোহাই পেড়ে, আদপে সেই মৃত্যুকেই সওদা করে আখের গোছায়। কেউ ভোটে লড়ে। কেউ খবর ছাপে। কেউ পক্ষে গলা ফাটায়। কেউ বিরোধী সাজার ভান করে।
এমনকী ‘বৃহত্তর’ স্বার্থের নামে নির্জলা মিথ্যেকেও চেপে দিয়ে নিজের, সম্পূর্ণ নিজের সিঁড়ি ভাঙার অঙ্কর হিসেব কষতে কষতে কখনও পালিয়ে যাওয়ার, কখনও লেলিয়ে দেওয়ার, কখনও’বা লাগিয়ে দেওয়ার নেশায় খ্যাপা ষাঁড়ের চেয়েও হিংস্র ওরা। শান্ত খুনে মেজাজে এরা আবার আত্মপক্ষ সমর্থনের দর্শনও আওড়ায়।
সংখ্যাগুরু ‘উন্নয়ন’পন্থীদের ভিড়ে ধীরে ধীরে সত্যডাক্তার আক্রান্ত হতে হতে ক্রমেই একা, আরও একা হতে থাকেন।
এক সময় চিৎকার করে তিনি বলতে থাকেন, এই বস্তাপচা ধারণা তিনি মানেন না যে, মেজরিটিই সব সময় ঠিক।
•
আর্থার মিলারের যে-ভাবান্তর তা ছোট্ট ছোট্ট টানে বদলে গিয়েছে ‘দ্রোহকাল’-এ। স্থান, কালের ফারাকে তো বটেই। আবার চরিত্রেও।
মিলারের পুরুষ নায়ক মিস্টার স্টকম্যান যেমন এখানে মহিলা। ডাক্তার সত্যবতী সেন। তাঁর এক মেয়ে ঊর্মী (মোনালিসা পাল), এক ছেলে বাবুলাল (ঋদ্ধি সেন)।
বাবুলালকে অতি সূক্ষ্ণ বুননে অনবদ্য ‘টাচ’ দিয়েছেন নাট্যকার। যেখানে ‘বাবুলাল’ আর ‘একক’ নেই, হয়ে উঠেছে অসংখ্য ‘বাবুলাল’-এর যোগফল। আত্মসুখেই যাদের মোক্ষ। লুঠতরাজ যাদের কাছে অনিবার্য নিয়ম। স্বজনের লাশের পাহাড়েও যাদের সৌধ গড়ার স্বপ্ন বেঁচে থাকে। বাধা দেওয়ার চেয়ে পালিয়ে যাওয়াকেই যারা শ্রেয় মনে করে। হত্যাকারীর হাত ধরতেও যারা পিছপা নয়।
ছোট্ট চরিত্র। কিন্তু ক্যানভাসটি বড়। সেই ক্যানভাসে যে পাগলপারা রং ধরাবেন ঋদ্ধি, মহলা দেখেই তা বোঝা যায়।
আর ক্রূঢ়তায়, ধূর্ততায় গগনদের চালগুলো যে কতটা দগদগে নৃশংসতায় দানা বাঁধে, তার প্রতিটি অক্ষর যেন লেপটে থাকছে কৌশিকের বাচনে।
লাঠি হাতে টেনে টেনে তাঁর হাঁটায়-চলায়। শীতল চাহনিতে। ভ্রু, ঠোঁটের বঙ্কিম ভঙ্গিমায়। হাতের মুদ্রায়।
তুলনায় সত্যবতীর চরিত্রটি কিছুটা যেন একমাত্রিক। সরলরৈখিক। প্রেডিক্টেবল। বিশেষ করে সদ্য ‘আন্তিগোনে’ করে ওঠা রেশমী সেনের কাছে।
হয়তো’বা তারই কারণে এই সত্যডাক্তার তাঁর মতো দড় অভিনেত্রীর কাছে বড় বেশি মাত্রায় চ্যালেঞ্জিং হতে চলেছে।
•
‘থানা থেকে আসছি’-র পর আবার সোশ্যাল ড্রামার পরিচালনায় কৌশিক।
মাঝে যা করেছেন তা পিরিয়ড পিস নয়তো লিরিকাল থিয়েটার। ম্যাকবেথ, কর্কটক্রান্তির দেশ, আন্তিগোনে...।
সোশ্যাল ড্রামায় এলেই কৌশিককে যেন বেশি করে ‘সোশ্যাল স্টেটমেন্ট’-এর ছটফটানিতে পায়। সমকালীন হয়ে ওঠার রোখে ধরে।
এ বারের মহলা দেখতে দেখতে মনে হল, পুরনো সেই ‘হ্যাংওভার’ থেকে বেরিয়ে কৌশিক সেন অনেকটাই পরিণত। অনেকটাই তীক্ষ্ণ। পরিশীলিত। কম্পোজড।
অভিনয়, স্ক্রিপ্ট পরিমার্জনা, আবহ নির্মাণে তো বটেই, এমনকী মঞ্চে ছোট্টখাট্ট প্রপস্ ব্যবহারেও ওঁর পরিণতবোধ এ নাটকে চেয়ে দেখার মতো।
একটা ঘরাঞ্চিকে দরজা করে দেখিয়ে গোটা থিয়েটারের লুকোছাপা, উঁকিমারা, কানপাতা, সন্দেহর চোরা হাওয়াটাকে এমন ভাবে জিইয়ে রাখছেন তিনি, অনবদ্য লাগে!
সত্তর দশকের গোড়ায় ‘যদুবংশ’ নাটকে কৌশিকেরই বাবা পরিচালক শ্যামল সেনের এমন ঘরাঞ্চির ব্যবহার ছিল।
এক কথায়, দ্রোহকাল-এর কৌশিক যেন তাঁরই পুরনো থিয়েটারি গ্রামারকে ভেঙেচুরে ‘রিক্রিয়েট’ করা অন্য একজন পরিচালক, যিনি সহজে টেক্কাটা ছাড়েন না, তার আগেই দানটা জিততে চান।
এই প্রথম বার জন্মদিনে নতুন নাটক না নামিয়ে ভরা ভোটের বাজারেই তাঁর দল নেমে পড়ছে ‘দ্রোহকাল’ নিয়ে।
সেখানেও সেই ব্যাকরণ-ভাঙা বইকী!
‘রিক্রিয়েট’ করার গল্প আছে বইকী!
তবে এ-ভাঙা, এ-গল্প ধরতে পাঁচ-সাড়ে পাঁচ মিনিট কেন, আধ সেকেন্ডও সময় লাগার কথা নয়।
লাগে কি?