পঞ্চকোটের ক্যানভাসে

প্রকৃতি ও ইতিহাসের মিশ্রণে পুরুলিয়ার গড়পঞ্চকোট এক কথায় অনবদ্য প্রকৃতি ও ইতিহাসের মিশ্রণে পুরুলিয়ার গড়পঞ্চকোট এক কথায় অনবদ্য

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৮ ০০:১০
Share:

পঞ্চরত্ন মন্দির

ঘন জঙ্গল। বর্যার জলে ধুয়ে যাচ্ছে চারপাশের সবুজ, গাছের পাতায় বৃষ্টির জলের কনসার্ট — মন চাইছিল এমন একটা অভিজ্ঞতা হোক। এ দিকে হাতে সময় কম।

Advertisement

ইচ্ছে পূরণ হল। তাও আবার ঘরের কাছেই। জায়গাটা পুরুলিয়ার গড়পঞ্চকোট। আদ্রা, আসানসোল বা বরাকর স্টেশনে নেমে সেখান থেকে গাড়ি বা অটো করে যাওয়া যায়। স্টেশনেই পাওয়া যায় গা়ড়ি বা অটো। কিন্তু আমি নেমেছিলাম কুমারডুবি স্টেশনে। সেখান থেকে মাইথন ৭ কিমি। আর মাইথন থেকে ২৩ কিলোমিটার গড়পঞ্চকোট। শুনেছিলাম, মাইথন থেকে গড়পঞ্চকোট যাওয়ার রাস্তাটি বর্ষায় মন ভরিয়ে দেবে। মাইথন থেকে অটোতে ওঠার সময়ই কালো মেঘ করে অকালসন্ধ্যা নেমে এল। জ্বলে উঠল মাইথন বাঁধের উপর আলোগুলো। বাঁধের জলে ছোট ছোট ঢেউ। চারিদিকে মাথা উঁচু করে শাল-মহুয়া-বয়রা-আমলকী। হাওয়ায় তারা একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ছে। হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছিল আমাদের অটো। কখনও কালো মেঘের, কখনও বা সবুজ-কমলা ল্যান্ডস্কেপের ছবি তোলার জন্য অটোর গতিতে রাশ টানা হচ্ছিল।

বৃষ্টিকে সঙ্গী করে গড়পঞ্চকোট পৌঁছনোর পর সে বিরতি নিল। সূর্যদেবও মেঘ সরিয়ে উঁকি দিলেন। চারিদিকে মায়াবী আলো। বৃষ্টির সঙ্গে রেস খেলতে খেলতে গন্তব্যে পৌঁছে বুঝলাম বেশ তেষ্টা পেয়েছে। জলের নয়, চায়ের! গড়পঞ্চকোটে ঢুকেই প্রথম চোখে পড়ে সম্প্রতি সংস্কার করা পঞ্চরত্ন মন্দির। তার সামনেই কয়েকটি ছোট ছোট চায়ের দোকান। সেখানে চা-বিস্কুটের সঙ্গে ছৌ মুখোশও বিক্রি হচ্ছে। চায়ে চুমুক দিয়ে চোখ চলে গেল পাঞ্চেত পাহাড়ের দিকে। ঘন জঙ্গলের মোড়কে এই পাহাড়ের হাতছানি এড়ানো মুশকিল। কিন্তু বাধ সাধল চায়ের দোকানের বাচ্চা ছেলেটি, ‘‘ও দিকে এখন যাবেন না। জঙ্গলে প্রচুর সাপ, বিষাক্ত পোকামাকড়। অজগরও বার হয়। শীতকালে আসবেন, আমিই নিয়ে যাব আপনাকে। পাহাড়ের মাথার উপর থেকে দেখবেন গোটা অঞ্চল। পাঞ্চেত বাঁধ। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। উপর থেকে ভিউটা খুব সুন্দর।’’ বাধ্য মেয়ের মতো কথা শুনতে ছেলেটি পুরস্কারস্বরূপ ঘুরিয়ে দেখাল গড়পঞ্চকোটের গেট, জোড় বাংলা, ওয়াচ টাওয়ার, রানি মহল— পঞ্চকোট রাজত্বের ভগ্নাবশেষ। যা এক সময় রাজা, প্রজা, সৈন্য নিয়ে গমগম করত।

Advertisement

রাজা দামোদর শেখর ছিলেন পঞ্চকোটের প্রথম রাজা। সময়টা ৯০ খ্রিস্টাব্দ। পুরুলিয়ার ঝালদা অঞ্চলের পাঁচ আদিবাসী সর্দারের সাহায্যে এখানে তিনি রাজত্ব গড়ে তোলেন। আর সেই থেকেই নাম গড়পঞ্চকোট। ‘গড়’ মানে দুর্গ, ‘পঞ্চ’ মানে পাঁচ এবং ‘কোট’ মানে গোষ্ঠী। শোনা যায়, এই রাজার উত্তরসূরিরাই পঞ্চকোটে ছোট বড় মিলে প্রায় চল্লিশটি মন্দির তৈরি করেছিলেন। কোনওটা পোড়ামাটির, আবার কোনওটা পাথরের। যার মধ্যে এখন দু’-একটির ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। অবশ্য কিছু ঐতিহাসিকের বক্তব্য রাজারা নন, ধনী বণিকদের তৈরি এই মন্দিরগুলি। সে সময় দামোদর অববাহিকা জুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের রমরমা। বাংলায় বর্গিদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় এই রাজত্ব। জনশ্রুতি, শেষ রাজার ১৭ জন রানি সম্মান বাঁচাতে আত্মহত্যা করেছিলেন।

প্রকৃতির রূপ দেখে চোখ জুড়োনোর জন্য আদর্শ জায়গা গড়পঞ্চকোট। এখানে জঙ্গলে ঘেরা বনদফতরের বাংলোগুলিতে থাকার ও খাওয়ার ব্যবস্থা এই জায়গাটির আকর্ষণ বাড়িয়ে দেয়। গড়পঞ্চকোট আসার আগে একদিন ছিলাম মাইথনে। অন্ধকার হতেই বাঁধের উপর আলোগুলোকে দূর থেকে দেখে মনে হত, তারারা নেমে এসেছে। মাইথন থেকে অটো ভাড়া করে গিয়েছিলাম পাঞ্চেত বাঁধ ও শক্তিপীঠ কল্যাণেশ্বরী মন্দিরে। প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো এই দেবীর মন্দির আগে ছিল পঞ্চকোটে। বর্গি হামলার সময় দেবীকে নিয়ে চলে আসা হয় এখানে।

সপ্তাহান্তে মনটাকে একটু সতেজ করার জন্য গড়পঞ্চকোট ভায়া মাইথন এক কথায় অনবদ্য। তবে অবশ্যই এই সময় সঙ্গে নিতে ভুলবেন না মসকুইটো রেপেলেন্ট।

ঊর্মি নাথ

ছবি: লেখক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন