মৃত্যুর পর টানা দু’দিন তাঁর লাশ পড়ে পড়ে পচেছিল মর্গে।
হিন্দু ধর্মত্যাগীকে দাহ করতে পারেনি তাঁর বন্ধু-পরিজন। আর তাঁকে গোর দেওয়ার একখণ্ড জমিরও অনুমতি মেলেনি ওই আটচল্লিশ ঘণ্টায়!
শেষে এক যাজক সমস্ত বাধা অগ্রাহ্য করে তাঁকে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করেন। শোকযাত্রায় পা মেলান সে-কালের কলকাতার এক হাজার নাগরিক!
তিনি আর কেউ নন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত!
যাঁর বাঁধভাঙা জীবনের উল্লাস, রোদন, সমস্ত অচলায়তনের বিরুদ্ধাচরণ, তাঁর বিলাসিতা, নির্মম দারিদ্র, শত ছিন্ন সংসারযাপন নিয়ে যে স্বপ্নজীবন— তাকে নিয়েই নাট্যরঙ্গ-র নতুন নাটক ‘শ্রীমধুসূদন’।
চারটি সূত্র— বিধায়ক ভট্টাচার্যর মাইকেলকে নিয়ে নাটক, জীবনীকার গোলাম মুরশিদের ‘আশার ছলনে ভুলি’ গ্রন্থ ও বনফুলের ‘শ্রীমধুসূদন, উৎপল দত্তর ‘দাঁড়াও পথিকবর’ নাটক— এই চারটি রচনা থেকে এই নাটক গ্রন্থনার কাজটি সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। নির্দেশনা স্বপন সেনগুপ্ত। প্রথম শো ২ অগস্ট, একাডেমি, সন্ধে সাড়ে ছ’টা।
উৎপল দত্ত বলতেন, সময়টা যখন ছোট হয়ে আসে, মানুষগুলো যখন ক্ষুদ্রাকার হয়ে যায়, তখন অতীত থেকে খুঁজে খুঁজে আনতে হয় বিশালাকায় মনুষ্যজীবন।
অনেকটা এই ভাবনা থেকেই তিনি এক এক সময় তাঁর থিয়েটারে এনেছেন রামমোহন রায়, বাহাদুর শাহ, মধুসূদন দত্ত থেকে তিতুমিরকে। ভ্রষ্ট, মতিচ্ছন্ন জাতিকে ঘাড় ধরে ঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে। তার ইতিহাস, তার গৌরবের কথা শোনাতে।
নাট্যরঙ্গ-র ‘শ্রীমধুসূদন’ মহলায় অনেকটা যেন তারই সুর কানে এল। সংকটাকীর্ণ আশপাশে দমবন্ধ হয়ে যেমন সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে খাদের পাড়ে পাহাড়ের সামনে বসা করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় একরাশ হাহাকার হয়ে বেজে ওঠে ‘কে রবে পরবাসে’— অনেকটা তেমন।
নাটকটি যখন শুরু হয় তখন মাইকেল (সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রান্ত-যুবক। স্ত্রী রেবেকা তাঁকে ত্যাগ করেছেন। সহবাস করছেন ইংরেজ দুহিতা হেনরিয়েটার সঙ্গে (অনিন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়)। কিন্তু কখনও স্বপ্নে, কখনও জাগরণে অতীত তাঁকে আক্রান্ত করে।
তিনি স্পষ্ট শোনেন মা’কে লক্ষ করে বাবা রাজনারায়ণের অভিশাপ, ‘‘জাহ্নবী, ওকে যেতে দাও। ও ধর্মত্যাগ করেছে। তার মানে ও আমাকে ত্যাগ করেছে।’’
মাইকেল দেখেন, একটা আগুনের বেড়াজালের মধ্যে পড়ে গিয়েছেন তাঁর মা, ডাকছেন, ‘‘মধু মধু।’’
হাত বাড়িয়েছেন মা’কে উদ্ধার করতে, কিন্তু মা কিছুতেই পারছেন না তাঁর মধুর হাত স্পর্শ করতে!
কখনও আবার এই স্বপ্নালু ঘোর নয়, জাম্প-কাট করে সময়টা ফিরে যায় ফেলে আসা আস্ত জীবনটায়। কখনও টুকরো টুকরো কোলাজে গাঁথা টাটকা সময়ে ঘুরপাক খেয়ে কাহিনি গড়ায়।
মাদ্রাজ শহর। ভার্সাই নগরী। কলকাতা। আলিপুর হাসপাতাল।
এই কাহিনির কোলাজেই একে একে দেখা দেন প্রেমিকা দেবকী (রোকেয়া রায়)। তাঁর বাবা রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বন্ধুকুল গৌরদাস, যতীন্দ্রমোহন, ভূদেব। জেমস লং। আর বারে বারে ফিরে আসেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (অমিয়শঙ্কর হালদার)।
শুধু কথাও কাহিনি শোনায়। তাঁর বিশপ কলেজের ভাঙচুর। একই সঙ্গে তাঁর অসংখ্য ভাষাচর্চা। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে দেশকে মুক্ত করার আগে মিত্রাক্ষরের থেকে ভাষাকে মুক্ত করার আকণ্ঠ ইচ্ছে। থিয়েটারে বারাঙ্গনাদের আনতে চাওয়া। ঈশ্বরচন্দ্রকে বিদ্রুপ। তাঁর ‘ক্যাপটিভ লেডি’ পড়ে শেলি-কিটস-বায়রনের প্রসঙ্গ টেনে বেথুন সাহেবের উচ্ছ্বাস। এক রাতে দুশো পৃষ্ঠার নাটক দীনবন্ধু মিত্র্রের ‘নীলদর্পণ’-এর অনুবাদ। চরম অর্থকষ্টের মধ্যেও তাঁর আগলভাঙা দানধ্যান। চূড়ান্ত নেশাড়ু হয়ে নিজেকে একটু একটু করে মৃত্যুগহ্বরের দিকে নিয়ে চলা।
সেট (বিলু দত্ত) একেবারেই বাহুল্যবর্জিত। ছ’-আটটা প্লাইবোর্ড। মাইকেলেরই কবিতা বুকে করে। কখনও খাড়াই দাঁড়ানো। কখনও হাতে হাতে ঘুরে ফিরে এ পাশ ও পাশে যায়। তাতেই আদালত হয়। ঘর হয়। কখনও আবার শুয়ে থেকে সমাধিবেদীও।
পিছন দিকে মাঝামাঝি আলোয় (জয়ন্ত দাস) ধরা থাক-থাক গ্রন্থ। নানা রঙের আলোয় ভাসে গোটা কাহিনি। যার মধ্যে পীত হলুদের আধিক্য যেন ধরে থাকে জ্বলজ্বলে জীবনের এক বর্ণময় উদ্যাপনকে!
’৫২-’৫৩ সালে মাইকেলের একটি গানের সুর করেছিলেন সলিল চৌধুরী। গেয়েছিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। ‘রেখো মা দাসেরে মনে/ এ মিনতি করি পদে’।
আগাগোড়া এই গানেরই রেশ যেন খণ্ড খণ্ড হয়ে জুড়ে থাকে আবহে (গৌতম সোম)।
এসেছে আরও একটি বহুশ্রুত সঙ্গীত। সেটিও মাইকেলেরই লেখা। টিনের তলোয়ার নাটকে উৎপল দত্তর ব্যবহার করা প্রশান্ত ভট্টাচার্যর গান, ‘শুনো হে ভারতভূমি’। নির্বাপিত জীবনের ঘণ্টাধ্বনি যখন শুনতে পাচ্ছেন মাইকেল, ভগ্ন সময়ের অবহেলায় যখন ক্রমশ অপমানিত হয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছেন, তখন তাঁর নিরুচ্চারিত ক্রোধ, হতাশা আর ক্রন্দনকে যেন বয়ে নিয়ে বেড়ায় এই আর্ত গান।
সেট-আলো-সংগীত এ-নাটকে মনে হয় একে অন্যের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের এক কবরক্ষেত্রর ছবি আঁকতে থাকে। নির্দেশক স্বপনের এই ভাবনা নিঃসন্দেহে নজরে পড়ার মতো।
বায়োপিক থিয়েটার সুরজিতের নতুন নয়। এর আগে অন্তত তিনটি পূর্ণাঙ্গ নাটকে তিনি হয়েছেন সিরাজ, ডিরোজিও, শম্ভু মিত্র।
সুরজিতের অভিনয়ে স্বরক্ষেপণে, ওঁর শরীরী ভঙ্গিতে, ওঁর হাতের মুদ্রায় এমনই কিছু বিশিষ্টতা আছে যে, একটি চরিত্র থেকে অন্য একটি চরিত্রে যাওয়ার ধরনটা বেশ অনায়াস। নিজস্ব ঘরানা বজায় রেখেও চলনে কোথায় যে ফারাকটি গড়ে দেন চট করে ধরা যায় না, কিন্তু ফারাকটা স্পষ্ট হয়।
‘মেফিস্টো’র ডিরেক্টর থেকে ‘বিকেলে ভোরের সর্ষে ফুল’-এর অনিরুদ্ধ থেকে শ্রী শম্ভু মিত্রর শম্ভু মিত্র— সবই ওঁর গড়া। কিন্তু বিভেদরেখা নিয়ে সংশয় নেই।
এই ‘মাইকেল’ও তাই। আগের যে কোনও চরিত্র-বুনন থেকে আলাদা।
সেই বুননে কোথায় যেন মাইকেল উনবিংশ শতাব্দী পেরিয়ে যেতে যেতে সমকালে দাঁড়িয়ে এই সময়েরও ক্ষরণের গদ্য নির্মাণ করেন।
আর তখনই বোধহয় ‘শ্রীমধুসূদন’ ঠিক এক জীবনের আখ্যান না থেকে হয়ে পড়ে কালান্তরের আর্তনাদ। চাপা পড়া সময়ের কান্না। তার হাহাকার। আকাশ বিদীর্ণ করা অযুত স্বরের চিৎকারও বটে!