চটি একটা পাণ্ডুলিপি হাতে ধরিয়ে প্রকাশক নারায়ণ দেবনাথকে বললেন, ‘‘এটা কিন্তু থ্রিলার। প্রচ্ছদটা তাই অ্যাকশন-প্যাকড্ রাখবেন।’’ গল্পের নীচে লেখকের নাম লেখা শ্রীস্বপনকুমার।
বইপাড়া থেকে পাণ্ডুলিপি নিয়ে শিবপুরের বাড়িতে এসে সেদিন রাতেই পড়তে বসলেন নারায়ণবাবু।
প্রচ্ছদ আঁকার আগে পুরো গল্পটা খুঁটিয়ে পড়া তাঁর স্বভাব। এমনকী পড়তে গিয়ে যে জায়গাগুলো ছবি করার মতো মনে হয়, সেখানে লাল কালিতে দাগও দিয়ে রাখেন।
কিন্তু সে বারে নারায়ণবাবু পড়লেন মহা বিপদে। পুরো পাণ্ডুলিপি লাল কালির অসংখ্য দাগে ভরে উঠল। ছত্রে ছত্রে মারপিটের দৃশ্য, রোমাঞ্চ। কোনটা ছেড়ে কোনটা আঁকবেন! ভাবতে ভাবতেই রাত কাবার।
এমন একটা লেখা শেষ করে লেখককে দেখার খুব ইচ্ছা হয়েছিল তাঁর। শিবপুর মন্দিরতলায় নিজের বাড়িতে লেখার ঘরে বসে বলছিলেন নব্বই বছরের নারায়ণবাবু। লেখকের আবির্ভাব ঘটল কয়েক দিনের মধ্যেই। শান্ত। ধীর স্থির। —‘‘লম্বা, রোগা, পাজামা পাঞ্জাবি পরা যুবক। এলেন আমাদের শিবপুরের বাড়িতে। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল। নমস্কার করে বললেন, ‘আমার নাম স্বপনকুমার। শুনলাম আপনি আমার বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকছেন। তাই আলাপ করতে এলাম।’ আলাপ হল, গল্প হল। কিন্তু তাঁর লেখা রহস্য গল্প নিয়ে খুব একটা কথা হল না। এমনকী গল্পের গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জি বা সহকারী রতনলালের চেহারা কেমন হবে, তা নিয়েও কোনও আলোচনা করলেন না। শুধু বললেন, ‘আপনার ওপর পুরো ভরসা আছে। আপনি যেটা ভাল মনে করবেন তেমন আঁকবেন।’”
সে ষাটের দশকের কথা। তত দিনে বাঁটুল ও হাঁদা ভোঁদার জন্ম হয়ে গিয়েছে। নিজে তৈরি দুই কমিকসের চরিত্রকে কীভাবে আরও মজাদার করা যায় তা নিয়ে বিভোর হয়েছিলেন তিনি। সেই সময় এই একের পর এক স্বপনকুমারের থ্রিলার তাঁকে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল।
অ্যাকশন প্যাক়ড থ্রিলার। মারপিট, গোলাগুলি তো থাকবেই। সেটা সামলে দেওয়া যায়। মুশকিলটা অন্য জায়গায়। এই সব কাহিনির ভিলেনরা পরে অদ্ভুত সব পোশাক। গল্পে নায়কের তুলনায় ছবিতে ভিলেনের প্রাধান্য বেশি। যখন তখন আঁকতে হচ্ছে এরোপ্লেন, স্পিডবোট, রকেট। কখনও বা জলের তলায় ডুবুরির পোশাক পরে যুদ্ধ। আঁকতে হচ্ছে তাও।
এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে নারায়ণবাবুর কাজে লাগল হলিউডের অ্যাকশনধর্মী থ্রিলার দেখার অভিজ্ঞতা। সেই সঙ্গে রিপ কার্বি কমিকস পড়াটাও কাজে এল। বলছিলেন, ‘‘অ্যালেক্স রেমন্ড-এর কমিকস রিপ কার্বি-র ছবি করতেন জন প্রেন্টিস। মডেলদের দাঁড় করিয়ে হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে অ্যাকশনের লাইভ ছবি আঁকতেন। আর এই লাইভ আঁকতেন বলেই রিপ কার্বির ছবি অত নিখুঁত হত। আমি রিপ কার্বির ছবিতে কিছুটা প্রভাবিত ছিলাম। সেই ছাপটা স্বপনকুমারের ছবিগুলো আঁকতে গিয়ে পড়েছে। তাই আমার ডিটেলিংও খুব নিখুঁত হত।”
নিখুঁত ডিটেলিং তো বটেই, তার সঙ্গে কোথাও বোধ হয়, অন্য ধরনের উত্তেজনার কারণ হত স্বপনকুমারের প্রচ্ছদ।
যেমন?
ক্রাইম ওয়ার্ল্ড সিরিজের ‘অপরাধী’ বইটার কথাই ধরা যাক। সেখানে দেখা যাচ্ছে দু’জন যুবক মুখোমুখি বন্দুক নিয়ে লড়াই করছেন, তাদের সামনে মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে লাল রংয়ের স্কিন টাইট জামা পরা যুবতী। তাঁর স্তনযুগল স্পষ্ট।
ওই সিরিজের আরেকটি বই ‘কে তুমি’-তে নারায়ণবাবুকে আঁকতে হয়েছিল এক জিন্স ও স্কিন টাইট গেঞ্জি পরা যুবতী। সে লাথি ছুড়ে মারছে একজনকে। তখনও যুবতীর শরীরী আবেদন লক্ষ করার মতো।
নারায়ণবাবুর কথায়, ‘‘সময়ের তুলনায় এই সব প্রচ্ছদ ছিল খুবই সাহসী। ফলে বই-এর সঙ্গে প্রচ্ছদও জনপ্রিয় হয়েছিল খুব। তাই প্রচ্ছদের জন্যও অনেকে স্বপনকুমারের বই সংগ্রহ করে রাখতেন।’’
তবে স্বপনকুমারের প্রথম বই থেকেই কিন্তু নারায়ণবাবু প্রচ্ছদ আঁকার কাজে ছিলেন না। স্বপনকুমারের বই-এর প্রথম কাজ শুরু করেছিলেন শৈলেশ পাল। এর পর ষাটের দশকে তুষার চট্টোপাধ্যায়, প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়, সমর দে, বলাইবন্ধু রায়রা স্বপনকুমারের রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের ছবি আঁকেন। এঁদের থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট ছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। অভিজ্ঞতাও কম। নারায়ণবাবু বলছিলেন, “দেখলাম, সিনিয়রদের মধ্যেই আমায় জায়গা করে নিতে হবে। তাই বইয়ের প্রচ্ছদে নতুন কিছু করার জন্য খুব চেষ্টা করতাম। হিরো বা ভিলেনের পোশাক থেকে চুলের স্টাইল, মোটরবাইক, দামি গাড়ি, রকেট, স্পিড বোট, সবেতেই নতুন কিছু করার কথা ভাবতাম। আমার এই ভাবনাটা কাজেও লেগে গেল।”
কী রকম?
বলছিলেন, ‘‘ওঁর বাজপাখি সিরিজের বই প্রথমে ষাটের দশকে বেরোয়। তারপর সেই বইগুলো আবার সত্তরের গোড়ায় নতুন প্রচ্ছদ করে ছাপানো হয়। নতুনটা পুরনোর জনপ্রিয়তাকে ছাপিয়ে যায়। এর সবগুলোই আমার করা। এরপর ড্রাগন সিরিজ থেকে শুরু করে অপরাধী সিরিজ, প্রায় সব ক’টি সিরিজের ছবিই আমি করেছি।’’
কী রকম জনপ্রিয় হয়েছিল সে সব?
নমুনা দিলেন নারায়ণবাবু, ‘‘এক বারের কথা বলতে পারি। তখন সবে ড্রাগন সিরিজের দশটি বইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় বইটি বেরিয়েছে। ছাপাখানা থেকে দশ হাজার বই ঝুড়ি করে ক্যানিং স্ট্রিটের একটি বইয়ের দোকানে নিয়ে আসা হল। বই দোকান পর্যন্ত পৌঁছতে পারল না। দোকানের সামনে ঝুড়ি নামাতেই সব বই শেষ।’’
নব্বই বছর বয়সে এখনও সজীব নারায়ণবাবু। এখনও বাঁটুল, নন্টে ফন্টে, হাঁদাভোদা লেখা-আঁকা চলছে। তবে স্বপনকুমার বন্ধ হয়ে গিয়েছে সেই আশির দশকের গোড়ায়।
কিন্তু সেই সব রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ ভুলতে পারেননি তিনি। তাঁর লেখাপড়ার ঘরের টেবিলের ড্রয়ারের ভেতর আজও রাখা আছে বহু বইয়ের প্রচ্ছদের ছবি। দেরাজ ঘাঁটলে এখনও উঁকি মারে নীল সমুদ্রের বাজপাখি, অদৃশ্য সঙ্কেত, মৃত্যুমুখী কালো নেকড়ে, ফাঁসির মঞ্চে ড্রাগন, মহাশূন্যে ড্রাগন...! আর মনের মধ্যে ধরা আছে এক যুবকের ছবি— লম্বা রোগা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, ঘাড় পর্যন্ত চুল। প্রথম দিন শিবপুরের বাড়িতে এসে যে প্রণাম করে পরিচয় দিয়ে ছিল, ‘‘আমিই স্বপনকুমার।’’