পশমিনার ফোঁড়ে জোড়ে ভাঙা মন, শত প্রজন্ম...

পশমের জমিনে কখনও চিনার পাতা, কখনও শিল্পীর রক্ত। সিন্ধু সভ্যতায় রাজপুরোহিতের আবক্ষ মূর্তির কাঁধে ছিল একটি ফুলকাটা শীতবস্ত্র। দেখলেই চেনা যায়— ‘এ যে কাশ্মীরি শাল!’ এর তিনটি ভাগ: শাহতুষ, পশমিনা, রাফল।

Advertisement

ঈপ্সিতা বসু ও চিরশ্রী মজুমদার

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০১
Share:

শাহজ়াদা দারা শিকো প্রেয়সী রানাদিলকে হিরের আংটি পরাতে গেলে তিনি নাকি তা ফিরিয়ে দেন। তখন এক জাদু দেখান শাহজ়াদা। ওই আংটির মধ্য দিয়েই অক্লেশে গলিয়ে দিলেন এক বহুমূল্য শাল। সেটাই ছিল পশমিনা।

Advertisement

মহেঞ্জোদড়ো থেকে মহাভারত

Advertisement

সিন্ধু সভ্যতায় রাজপুরোহিতের আবক্ষ মূর্তির কাঁধে ছিল একটি ফুলকাটা শীতবস্ত্র। দেখলেই চেনা যায়— ‘এ যে কাশ্মীরি শাল!’ এর তিনটি ভাগ: শাহতুষ, পশমিনা, রাফল। পশমিনারই বিশ্বভরা নাম। তার চয়ন ও বয়ন রীতিটিও বেশ আকর্ষক। হিমালয়ের উঁচুতে মাইনাস তিরিশ ডিগ্রিতে তুরতুর করে ঘোরে ক্যাশমিয়ার ছাগল। চ্যাংপা যাযাবররা চিরুনি দিয়ে তাদের বাড়তি লোম ঝরিয়ে আনেন। রিফুকার চরকা কেটে তৈরি করেন পশমিনা উল। যা সাধারণ সুতোর থেকে ছয় গুণ পাতলা, তিন গুণ গরম! যত ভাল পশমিনা, তত মিহি ও উষ্ণ। মহাভারতেও ছাগলোমে প্রস্তুত এই শীতবস্ত্রের খবর আছে। শকদেরও প্রিয় ছিল কারুকার্যে নিখুঁত এই শাল। পশমিনা আদর করে নিয়ে গিয়েছেন হিউ-এন-সাঙ। পশমিনার প্রতি আকবর বাদশার অনুরাগের নজির মেলে ‘আইন-ই-আকবরি’তে।

পশমের রাজা

পঞ্চদশ শতাব্দীতে পশমিনা প্রথম রাজানুগ্রহ পায়। আন্দিজান থেকে কারিগর আনিয়ে সুলতান জয়েন-উল-আবিদিন কাশ্মীরে পশমিনাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। ‘দ্বিতীয় রাজতরঙ্গিণী’তে তিনি এই শিল্পের প্রতিষ্ঠাতা রূপেই প্রশংসিত।

যত্ন-আত্তি

• ঠিকঠাক রাখলে পশমিনার যৌবন একশো বছর পার করে। আয়ু বাড়াতে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রাখবেন।
• বর্ষায় প্রায় দশ দিন পনেরো মিনিট করে পশমিনায় জোলো হাওয়া খাওয়ান।
• একরঙা পশমিনা ঠান্ডা জলে ধোবেন। নিংড়াবেন না আর ছায়ায় শুকোবেন। কারুকাজ করা শাল হলে পালিশ করিয়ে নেওয়াই ভাল।

অন্য ব্যবহার

• শীত ছাড়াও অন্য সময়ে পশমিনায় স্টাইল স্টেটমেন্ট তৈরি করুন। পশ্চিমি পোশাকের সঙ্গে মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ করে পরা যায় পশমিনার স্টোল বা স্কার্ফ। তবে জড়ানোর কায়দা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
• পশমিনা খুব হালকা। এটিকে পেঁচিয়ে গলার হার করে পরলেও নজর কাড়বেন।
• বেল্ট হিসেবে পশমিনা তো মুঘল যুগ থেকেই পছন্দের তালিকায়।

সময়ের রক্ত

দু’ভাবে তৈরি হয় পশমিনা। হাতের তাঁতের বুনটে কাঠের সুচের ফোঁড় তুলে তৈরি হয় কানি পশমিনা। আর উনিশ শতক থেকে এমব্রয়ডারি করে বোনা হচ্ছে আমিলকর শাল। কাশ্মীরের ইতিহাসের পটপরিবর্তন ধরা পড়ে কানি পশমিনার জমিতে। প্রথমে বিখ্যাত ছিল একরঙা শালের কেন্দ্রে বৃত্তাকারে ঘন নকশা করা চাঁদ পশমিনা। রং হত সাদা-কালো। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি এক জন কারিগর দেড় মাস ধরে এমনই সাদামাঠা শাল বুনছিলেন। হঠাৎ তাঁর নাক দিয়ে বেরোল উত্তপ্ত রক্ত। ছিটিয়ে গেল শালময়। ওই ছোপ ধরা পশমিনাই চোখে ধরল কাশ্মীরের উজিরের। তাঁর আদেশে শালে উল্টে-পাল্টে লাল, সবুজ রং ব্যবহার শুরু হল। মুঘল বাদশারা চোগার কোমরবন্ধে পরলেন সরষে রঙের পশমিনা। একে একে এল জরি পশমিনা, পাড় দেওয়া বুটিতে সাজানো শাল, নানা রঙের ছায়া মেশানো অঙ্গবস্ত্র। পশমিনায় ফুটে উঠল গোলাপবাগ, লিলির কুঁড়ি, পপি। জাহাঙ্গিরের পছন্দ ছিল রাজকীয় নীল পশমিনা। পরে মুঘল বংশের আয়েশ, সাম্রাজ্য ভাঙনের প্রভাবেও পশমিনার নকশায় ধরা পড়েছে দাবার ছক, হাতির হাওদা, বর্শা, শিকার করা জন্তুর মাথা।

ইংরেজরাও পশমিনার প্রেমে পড়ে। স্কটল্যান্ডে শালের কারখানা বসল। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পাটমহিষী জোসেফিন তিনশোটা পশমিনার অর্ডার দিয়েছিলেন। ইউরোপের আবদারে কাশ্মীরি শালকররা কাপড়ের কোনায় নার্গিস ফুল, কল্কা, লতাপাতা, জ্যামিতির ছাঁদ তুলতে লাগলেন। বিখ্যাত হল নিম জামেয়ার, বেলদার পাড়। সে শাল মন ভোলাল মহারানি ভিক্টোরিয়ার। পরে পঞ্জাব শাসকদের আগ্রহে আগমন দোশালা (কাপড়ের টুকরো জুড়ে) ও কারুময় দোরঙার। হাল আমলে স্ট্রাইপ, চেকও বনেদি ডিজ়াইনের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে।

আমিলকর শালগুলির মধ্যে সিকন্দরনামা, ম্যাপশাল খুব নাম করেছিল। কিন্তু বেশির ভাগই আজ জাদুঘরে। ইদানীং দু’মিটার চওড়া, এক মিটার লম্বা কানি জামেয়ার পশমিনাই মহার্ঘতম। একটি বুনতে কমপক্ষে সাত মাস! এখন শালে লেখা থাকে রেট্রো কায়দায় আরবি অক্ষর কিংবা জল এমব্রয়ডারিতে নয়া যুগের বিমূর্ত চিত্ররেখা। নিকোল কিডম্যান, সালমা হায়েক, হেলেন হান্টদের বারবার দেখা যায় বেবি পিঙ্ক পশমিনা স্টোল গায়ে। পাশাপাশি তাই স্টোল, স্কার্ফে এর কদর ক্রমশ বেড়েই চলেছে। শিল্পী এখানেও ফুটিয়ে তোলেন মনমোহিনী নকশা।

ফিরানে জাজিমে উপহারে

মুঘলপুরুষরা পরতেন পশমিনার চোগা, আচকান, জামা। অন্তঃপুরিকারা চাপাতেন ফিরান। উনিশ শতক থেকে জামা, ফিরানের পিছনেও ডিজ়াইন থাকে। সম্ভ্রান্ত ঘরের মেঝেয় পাতা হয় পশমিনা জাজিম। যার অলঙ্করণে ভ্রম হয়। একরাশ চিনার পাতা ছড়িয়ে বুঝি!

পশমিনার সেই আভিজাত্য ও স্টাইলের আশ্চর্য মেলবন্ধন আজও অম্লান। কারিগরি সূক্ষ্মতার জন্য এখনও আকাশছোঁয়া তার দাম। তবুও যদি একটি রাখতে পারেন সংগ্রহে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ঐতিহ্য হয়ে রয়ে যাবে আপনার রুচি।

মডেল: সৌরসেনী; ছবি: সুপ্রতিম চট্টোপাধ্যায়; মেকআপ: সৈকত নন্দী; স্টাইলিং: পূজা চট্টোপাধ্যায়; শাল ও শাড়ি ড্রেপিং: নিশা দেশাই; লোকেশন ও ফুড পার্টনার: দ্য বেঙ্গল লাউঞ্জ; শাড়ি: সারঙ্গ, ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক (গ্রে সিল্ক), রেশমি চৌধুরী (টিস্যু শাড়ি); ব্লাউজ়, জুয়েলারি ও ব্যাগ: অরণ্য, দক্ষিণাপণ; জাম্প স্যুট: একরু, ভবানীপুর; জুয়েলারি: পূজা আগরওয়াল; পশমিনা: নুর শালস, নুর-দিন-শাহ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন