পথচলা: অ্যাকাডেমিতে ‘সালঁ দ্য বেঙ্গল’ আয়োজিত প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
কলকাতার শিল্পাঙ্গনে ২০১৭ সালে কিছু তরুণ-তরুণীর মধ্যে শুরু হয়েছিল এক আন্তরিক আলাপচারিতা। মূল পথপ্রদর্শক ছিলেন চিত্রশিল্পী শেখর কর। তাঁরই তত্ত্বাবধানে ছবি দেখা ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে জন্ম হয় ‘সালঁ দ্য বেঙ্গল’ শিল্পীগোষ্ঠীর। নামের উৎস, ফরাসি ‘সালঁ দি অটাম’-এর ঐতিহ্য, যার সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির আড্ডাপ্রিয় সংস্কৃতির ধারাও। শিল্পচর্চা যে শুধু একক নয়, তা এক সামাজিক সংলাপও বটে— এই বিশ্বাসে শুরু হয় তাঁদের পথচলা।
গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য শুধু শিল্পচর্চা নয়, মানুষকে শিল্পমুখী করে তোলা। যদিও এই ভাবনার কথা অনেক শিল্পীই বলে এসেছেন। সে ক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতিতে আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীরা যে ভাবে ভেবেছেন, সেটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কারণ পরম্পরা বা উত্তরসূরির প্রতি আগ্রহ আজ কমে এসেছে। ছবি আঁকার প্রকৃত মর্ম না বুঝে সমাজমাধ্যমে দিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বড়ই প্রকট। আজ সামাজিক মাধ্যমে ছবি ভাগ করে নেওয়াই যেন অনেকের কাছে শিল্পচর্চার শেষ কথা। সে দিক থেকে এই তরুণদের উদ্দেশ্য প্রশংসনীয়। আর্ট কলেজের বাইরেও এমন মানুষ রয়েছেন, যাঁরা শুধুই ভালবাসার টানে নিজের শিল্পভুবন গড়ে তুলেছেন। একই গুরুর ছত্রচ্ছায়ায় থেকেও, নিজস্ব রং-ভাষায় একে অপরের থেকে আলাদা। কী ভাবে এক ভাবনা অন্য আকারে রূপান্তরিত হতে পারে, সেই চেষ্টাই এখানে চলমান।
কর্মসূচি অনুযায়ী এই প্রদর্শনী তাঁদের সপ্তম আয়োজন। স্থান, অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের নিউ সাউথ গ্যালারি। অংশ নিয়েছিলেন ১১জন শিল্পী। একদম শুরুতেই নজর কাড়ে সৈকত দে-র “ইকোস অব কনক্রিট”। ইটকাঠের রূঢ় পটভূমিতে তাঁর ব্রাশের লেপন বুঝিয়ে দেয়, কংক্রিট কাঠামোর ভিতরে আদৌ কোনও প্রাণ আছে কি? কাগজের উপরে কফি কালার ও চাইনিজ় ইঙ্কে প্রভাব পড়ে গ্রাফিক্স স্টাইলের টান। তাপসী বসুর সিল্কে ওয়াশ টেকনিকে বিষয় ছিল কাক। ব্যাকগ্রাউন্ডে গ্রে ও র’ সায়ানের আনুপাতিক ভারসাম্যের আড়াল। সামনে কাটা গুঁড়ির উপরে বসা একটি কাক। শুধু কাক নিয়ে ওয়াশ খুব একটা চোখে পড়ে না। সে ক্ষেত্রে শিল্পীর ভাবনা ব্যতিক্রমী।
প্রদর্শনীর অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল সোমনাথ চোংদারের ‘বারাণসী’ সিরিজ়টি। নতুন ভঙ্গিতে ভেসে উঠেছে স্থাপত্যের স্তর, নদীর স্রোত এবং সময়ের গভীর ছায়া। ইয়ালো অকারের উষ্ণতায় ইতিহাসের স্পন্দন জেগে ওঠে। একাধিক বৃত্তাকার ও কিউবিক ফর্মে রঙের টোন যে ভাবে ছুঁয়ে যায়, তার সঞ্চালনা এককথায় ক্লাসিক। প্রতিটি ছবির আনাচকানাচে শিল্পীর পার্সপেক্টিভ জ্ঞানকে কুর্নিশ জানাতে হয়। বোঝাই যায়, এই বিশেষ শহরটির অবিরাম খোঁজে শিল্পী বেশ বশীভূত। এবং ক্রমাগত চর্চায় বেরিয়েও গিয়েছেন পূর্বসূরির ধারা থেকে। ফলে, একই বারাণসী নতুন দিশার আলো দেখায়। অনীক বেরার নৌকাভিত্তিক জলচিত্র মূলতই নয়নাভিরাম কাজ। কোবাল্ট ব্লু ও স্যাপ গ্রিনের কোমল ইম্প্রেশনে ছবির প্রতি ভালবাসা বাড়িয়ে দেয়।
রিমা দেবনাথের বিষয় ‘হ্যারিকেন ল্যাম্প’। একসময় আমাদের রাত্রিসঙ্গী। হ্যারিকেনের আলোছায়া নিয়ে কাজ করার মধ্যে একটা অদ্ভুত আনন্দ পাওয়া যায়। খানিকটা যেন নিজের সঙ্গে থাকা। শিল্পী এরই মৃদু আলোয় অস্তিত্বকে ধরতে চেয়েছেন। ওয়াশ পদ্ধতির সুন্দর প্রচেষ্টা। স্টাডিমূলক কাজ হিসেবে উল্লেখ্য শ্রাবণী কাঁড়ারের ‘স্টিল লাইফ’-এর আলোছায়া। আয়রন ওয়্যারের ‘বুলস আই’ রূপকটির নির্মাতা স্নিগ্ধা দাড়ি যথেষ্ট প্রতিশ্রুতিময়ী। রেখা আর ছায়াকে জড়িয়ে ভাস্কর্যের নতুন ব্যাকরণ তৈরি করেছেন তিনি। তিয়াসা পালের ‘এডিফিস-২’ মিশ্র মাধ্যমের বুদ্ধিদীপ্ত স্থাপনা। রেখা, ব্লক প্রিন্টের মতো ছাপ আর সূক্ষ্ম দাগে ব্যালান্স করে গড়ে তুলেছেন গথিক স্ট্রাকচারাল বিল্ডিং। এ বিষয়ে শিল্পীর পড়াশোনা ও দেখার নিষ্ঠা ছবিকে বিশেষ মাত্রা দেয়।
চারকোলের মাধ্যমে নেপালি হ্যান্ডমেডে ‘ব্ল্যাক হর্স’ ছিল অপাবৃতা হাজরার একটি নিখুঁত ড্রয়িং। ঘোড়ার কালো শেডে ধরা পড়ে অন্তর্লীন গতি ও স্বাধীনতার ঘোষণা। পল্লবী রানার ‘স্থানচিত্র’র (জলরং) আকাশের রঙে যথেষ্ট দক্ষ চালনা। তুলনায় জমির সবুজ ও বাদামির ব্যবহারে আর একটু অনুশীলন দরকার ছিল। সুমনা মাইতির আরবান দৃশ্যরচনায় রঙের আধিক্য কিছুটা জটিল। তবে ভিতরের গঠনশৈলী বেশ নজর কাড়ে। বিশেষত বাসভূমির জমাট রং ও ফর্ম। মনে পড়ে কোলাজ-শিল্পী বি আর পানেসরের কথা। এই তুলনা থেকেই বোঝা যায়, শিল্পীর রং ও গঠনের বোধ বেশ আশাপ্রদ।
প্রদর্শনীর সামগ্রিক গঠন থেকে উঠে আসে শিল্পীদের নির্বিশেষ ভূমিকা। প্রতিটি কাজে উদাহরণ থাকে শিল্পের প্রতি নিগূঢ় ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা। এ ছাড়া পারস্পরিক বিকাশের এক অনন্ত যাত্রা। কিছু অসম্পূর্ণতা থাকলেও নিষ্ঠার যোগ আগামীতে আরও উজ্জ্বল পথ দেখাবেই। এই তরুণদের সৎ প্রয়াসই প্রমাণ করে, শিল্পচর্চা এখনও জীবন্ত। এবং সেটিই ‘সালঁ দ্য বেঙ্গল’-এর বড় সাফল্য।
অনুষ্ঠান
মঞ্চে শিল্পীবৃন্দ।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে