Art exhibition

art exhibition: ‘সমস্ত জীবন আমি তোমাদের মুখ দেখি, স্বদেশের বিষাদপ্রতিমা’

চিত্রকর যোগেন চৌধুরী নিজেই একজন কবি। বহু আগে তাঁর কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। বেশ কিছু কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এক সময়ে প্রকাশিতও হয়েছে।

Advertisement

অতনু বসু 

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২১ ০৮:৩৫
Share:

কাব্যিক: দেবভাষা আয়োজিত এক প্রদর্শনীতে যোগেন চৌধুরীর চিত্রকর্ম।

প্রদর্শনী ‘ডিফারেন্ট স্ট্রোকস ইন ব্ল্যাক অ্যান্ড ব্লু’। তাঁর ১০১টি কাজে রঙেরও বৈচিত্র আছে। কালো তাঁকে বারবার আহ্বান করে— ‘আমাকে গ্রহণ করো’— তাঁর প্রিয় কালোবরণকে তিনি ক্যানভাস, কাগজের আসন পেতে দেন। বর্ণের উপবেশন তখন বিভিন্ন চরিত্রের রেখায় বিবর্তিত হয়ে সেই ক্যানভাস, কাগজকে ভাষা দেয়। সে ভাষা উচ্চকিত, কখনও বড্ড নীরব, নিঃসঙ্গও। অভিঘাতময়, ভীষণ রকম সচকিতও। যে সব নৈঃশব্দ্যের অন্তরালে থাকে কোনও গহন স্মৃতির বিবিধ অধ্যায়, উপস্থাপনের গুণে তাদের ভাস্বর রূপ, রূপকল্প, আলো, অজানা অন্ধকারের আখ্যান, এমনকি নিঃসঙ্গ যন্ত্রণার করুণ একটি সুরও মনকে আচ্ছন্ন করে। কারণ, চিত্রকর যোগেন চৌধুরী নিজেই একজন কবি। বহু আগে তাঁর কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। বেশ কিছু কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এক সময়ে প্রকাশিতও হয়েছে।

Advertisement

‘দেবভাষা’ আয়োজিত এই প্রথম তাঁর সাক্ষাৎকারকেন্দ্রিক একটি বই প্রকাশ উপলক্ষে ৩৭টি পোস্টকার্ডে ড্রয়িং-সহ প্রদর্শনীটি সম্প্রতি শেষ হল। মিশ্র মাধ্যম, ড্রাই প্যাস্টেল, জলরং, লিটল ক্রস হ্যাচিং, ব্রাশ অ্যান্ড ইঙ্ক, পেন, পেন-ইঙ্ক, চারকোল, অয়েল প্যাস্টেল মাধ্যমের কাজ।

তাঁর ছবির ‘রেখা যে কবিতার মতো হয়’, নিজের ‘ছবিতে একটা রিদমিক লিরিক্যাল মাত্রা আছে, যা কবিতার মতো’— এ কথা নিজেই কিছুকাল আগে জানিয়েছিলেন এক আলোচনায়। পাশাপাশি থাকা সামাজিক বিষয় ও স্যাটায়ারের কথাও তিনি বলেছিলেন। ঠিকই বলেছিলেন যে স্বপ্ন, সুররিয়ালিজ়ম তাঁর নিজের কাজে নিজের মতো করেই এসেছে, কারও অনুগামী হয়ে নয়।

Advertisement

সমস্ত কাজই আগে কখনও কোথাও দেখানো হয়নি। কাজগুলি প্রধানত ড্রয়িংভিত্তিক। রেখার বৈচিত্রময় সত্তার গভীরে ‘নিহিত পাতাল ছায়া’র মতো উঠে আসা সব মুহূর্তের অনুরণন, যা সর্বক্ষণ জানান দিচ্ছে— সামাজিক ব্যাধি থেকে স্যাটায়ার, যন্ত্রণা থেকে যান্ত্রিকতার টানাপড়েন। দ্বন্দ্ব থেকে লালসা, সারল্য থেকে অবিশ্বাস, দৈন্য থেকে লিপ্সা, চিন্তাচ্ছন্নতা থেকে দুর্দশা... এমন আরও নানান ভঙ্গি, অভিব্যক্তির অন্তর্নিহিত সত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকা তাঁর বেড়ে ওঠা, অভিজ্ঞতার সাতকাহন, রাজনৈতিক ভাবনা, অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের দোলাচলে মানুষেরই এক আত্মকেন্দ্রিক চেতনার আভাস। তাদের দুর্দশা ও দুর্বিষহ জীবনের টুকরো অনুসন্ধান— তাঁর দীর্ঘ ষাট বছরের বেশি অভিজ্ঞতার ফসলের একখেত জ্বলন্ত উদাহরণ, সতেজ সাবলীল প্রাণবন্ত। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানো ভাল লাগা।

যোগেন চৌধুরীর এই ধরনের ড্রয়িংভিত্তিক ছবি, পেন্টিং বা অন্যান্য ধরনের কাজ সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। সুদীর্ঘ কাল দেশ-বিদেশে বহু বিদগ্ধ শিল্পবিদ, সমালোচক, শিল্পী, লেখক প্রমুখ যে ভাবে তাঁর কাজ বিশ্লেষণ করেছেন, অনেকের ক্ষেত্রেই এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা পাওয়া দুষ্কর। ঠিক কোন কোন জায়গা অধরা থেকে গিয়েছে, সামগ্রিক আলোচনায় তা খোঁজাও কষ্টসাধ্য। কেননা কৈশোরকাল থেকে তিনি নিজেই সেই শিল্পকলাকে যে ভাবে পোস্টমর্টেম করে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছেন, সেই গহন পর্বটির কিছু জায়গা আজও অজ্ঞাত। শিল্পী নিজে বেশিটাই বলে ফেলেছেন। সবটা বললেই কি তাঁকে সম্পূর্ণ ভাবে বোঝা যাবে? কিছুটা রাখতেই হয় অজ্ঞাতসারে। এই প্যাশন ও প্যাথোলজি, মনোবিজ্ঞান ও মননজাত বোধ, ফিলোজ়ফি ও ফিলিং, রিপ্রেজ়েন্টেশন ও রিসার্চ, রিদম ও রিফর্মেশন, মেথড ও মেলোডি... এই সবই তাঁর একান্ত একটি অন্তরাল। এই সব এলাকাগুলিই যোগেন চৌধুরীকে পরিচালিত করে। যা থেকে সৃষ্টি ও নির্মাণের যাবতীয় রহস্যের সমাধান ওই কাগজে, ক্যানভাসে, নানা মাধ্যমে। তবে সবটা নয় কিন্তু। কিছু থেকে যায় ওই অজ্ঞাতেই। যেন ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’।

তিনি ক্ষত দেখেছেন অনেক রকম। শরীরের, সমাজেরও। তাঁর সৃষ্টিতে এ সবই বড্ড জ্বলন্ত। যা একান্তই অনুভবের।

টেক্সচারের ব্যবহার থেকে কালো বা অন্য বর্ণের ডেনসিটি সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন তিনি। যেমন রেখার সূক্ষ্মতা থেকে স্থূলত্ব, প্রখর চাপ ও একটি লাইনের শুরু থেকে শেষের যাত্রাপথের জ্যামিতিক কাঠিন্য বা সরলীকরণে। টোনের গাঢ়ত্ব বা অপস্রিয়মাণতা, বিলীন করা শূন্যতা থেকে আর এক রকম রৈখিক আকস্মিকতা। সরলীকরণের মধ্যেও ডিজ়াইন ও আলঙ্কারিক বিন্যাস। রূপের সাধারণীকরণের মধ্যে মিশিয়ে দেওয়া নব্য নকশার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। সচিত্রকরণ থেকে ঢের দূরে এই ড্রয়িংভিত্তিক কাজগুলি, বিশেষত লিটল ক্রস হ্যাচিংয়ের অবিশ্বাস্য রূপ ও টেকনিক প্রণিধানযোগ্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন