‘দঙ্গল’ একটা উৎসাহ, একটা প্রতিবাদ

অবিশ্বাস্য লাগে আমির খানকে। লিখছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়অবিশ্বাস্য লাগে আমির খানকে। লিখছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

প্রায় সব কাগজে সমালোচনা বেরোবার পর এই লেখার পালা যখন এল, তখন নতুন কিছু লেখা বলতে ‘দঙ্গল’‌য়ের বাপান্ত করা ছাড়া আর কিছু বাকি নেই!

Advertisement

কিন্তু দু’টো ‘এ’ দিয়ে যে আমির আছেন মুম্বইতে, তিনি কোনও দিন তাঁর ছবিতে সেই সুযোগ দেননি নিন্দুকদের।

বাণিজ্যিক ছবির পরিচালকদের নামের তালিকায় শুধু মাত্র অ্যালফাবেটিকাল অর্ডারেই তাঁর নাম প্রথমে আসে না, ভাবনা ও অধ্যবসায়ের দৌড়েও ফার্স্ট তিনি।

Advertisement

ছায়াছবিকে নিছক ব্যবসা ভাবার মধ্যে যে দারিদ্র্য আছে, তাকে একটা চিরায়ত নির্যাতন বা অবহেলার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দিতে পারলেই কিন্তু তা উত্তীর্ণ হয়ে যায় পুরনো চলচ্চিত্রে।

আমির অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মতো সাধারণ বিষয়কে চিরকালীন আবেদন দিতে পারেন অনায়াসে। তা সে টিভি শো হোক বা সিনেমা। তাই খান-নামায় ইতিহাস তাঁকেই সিংহাসনটা দেবে আগামীতে।

বাবার না হওয়া স্বপ্নের ভার যখন সন্তান পূরণ করে, তখন সেই অতীতের না-পারাগুলো মুছে যায়। সত্যি ঘটনা অবলম্বনে খেলা বা খেলোয়াড় নিয়ে ছবির চল বহু দিনের।

আমিরের প্রোডাকশন হাউজ নাকি ফুটবল নিয়ে বাংলা ছবি ‘এগারো’ কিনে রেখেছেন। আগে ক্রিকেট নিয়ে ‘লগান’ বানিয়েছেন। এ বার কুস্তি নিয়ে ‘দঙ্গল’।

খেলতে খেলতে হাসতে হাসতে কখন যে একটা জটিল সামাজিক সমস্যার দোরগোড়ায় আপনি এসে দাঁড়াবেন, টেরও পাবেন না।

একজন চিত্রপরিচালক হিসেবে তখন আমারও গর্ব হয় যে, সিনেমা ব্যবসাটা আর বুদ্ধিহীন নাচাগানায় আটকে থাকছে না। ‘দঙ্গল’‌য়ের মতো ছবি তাই বারবার সফল। আর ‘গান-ধাতা’ আমলের ঘরানা ডুবছে।

কুস্তি নিয়ে অধিকাংশ বাঙালি কোনও দিনই বিশেষ আগ্রহী ছিল না। ভাল করে যা শিখল তা এই ছবি দেখেই। ‘সুলতান’ মাথায় রেখেও বলছি, আজকে বাংলার দর্শক কুস্তি নিয়ে যা শিখল তা প্রথম এই ছবি দেখেই। কুস্তি শিখল, নিয়ম জানল, কোন রাউন্ডে কী হয় সব শেখালেন পরিচালক... তার পর কুস্তির আখড়া হল ভারতের পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থা বনাম মহাবীর সিংহ ফোগত। আজ কিন্তু বাংলা এই কুস্তি দেখছে ভারতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।

কন্যাসন্তানের ভবিষ্যৎ কেন পূর্ব নির্ধারিত ভাবনার উপর তৈরি হবে? কেন একজন মেয়েকে আটকে থাকতে হবে চুড়ি আর চুড়িদারের জেলখানায়?

নারীমুক্তি নিয়ে আন্দোলনের নামে বেশ কিছু মানুষ এত বাণিজ্যিক কারণে মাত্রাহীন আস্ফালন করেছেন ও বিরক্তি উদ্রেক করেছেন, অথচ তাঁরা এই সত্যটা বোঝেননি যে, তিক্ত ওষুধ মিষ্টির সঙ্গে না মিশিয়ে দিলে রোগী তা গ্রহণ করবে না। তাই বাপ-মায়ের মান-অভিমানের চোখ ভেজানো সামাজিক নাটকের নীচে ম্যাজিকের মতো পাঁচন গিলল, গিলছে ও গিলবে মানুষ। সাবাস পরিচালক নীতেশ তেওয়ারি।

অভিনয়ে সবাই ফুল মার্কস। এমনকী লোকেশন বাছাই, তা সাজানো এবং তাতেও সেথুর ক্যামেরা ফুল মার্কস পেল।

সম্পাদক বাল্লু শাউজা দারুণ। প্রীতম চক্রবর্তীকে আলোচনার বাইরে রাখি, কারণ কুস্তি ও সঙ্গীত দুটোরই আখড়া থাকলেও তা এতটাই আলাদা যে মিলমিশের কোনও অবকাশ মাথায় আসার কথা নয়। প্রীতম জানেন, পারেন। সুরের ও তালের মধ্যে শিরা-উপশিরা বুনে কুস্তিগিরের দেহ নির্মাণ করলেন প্রীতম। একটা শক্ত আলিঙ্গন তোমার জন্য তুলে রাখলাম প্রীতম।

আমার মন কেড়েছে ছোট গীতা, জায়রা ওয়াসিম। বড় ববিতা, সানিয়া মলহোত্র। গীতা ফোগত হিসেবে ফতিমা সানা শেখ যতটা পরিশ্রমী, দয়ার চরিত্রে সাক্ষী তনওয়ার ততটাই মা।

দয়া ভারতীয় নারী বন্দিনীদের এক প্রতিনিধি। মহাবীর তাঁর কোনও মুক্তি ঘটাননি। কিন্তু মেয়েদের মধ্য দিয়ে দয়াও পূরণ করেন তাঁর ওড়ার স্বপ্ন।

সতর্কবার্তা: বাপ-মা-দের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ করাটাই যদি ছেলেমেয়েদের কাজ হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে কিন্তু মহা বিপদ উপস্থিত হবে।

ফিল্ম সমালোচনা

দঙ্গল

আমির, সাক্ষী,
ফতিমা, সানিয়া

মনে আছে নিশ্চয়ই বাঁশদ্রোণীর সেই ঘটনা? এক বাবা তার পুত্রকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল। বেচারি খেলার অনুশীলনে একটু ফাঁকি দিয়েছিল, তাই! বাপের স্বপ্ন বলে কথা!

পাঠক ও ‘দঙ্গল’য়ের দর্শক বাবারা নিজের স্বপ্ন নিজেই পূরণ করুন বা বুঝে নিন, ও আপনার কম্মো নয়। কচিকাঁচাগুলোকে ওদের মতো করে বাড়তে দিন। ঠিক যেমন করে উদ্ভিদ বড় হয়। জল দিন, কিন্তু টানাহ্যাঁচড়া একদম নয়।

দেখুন, বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার মেয়েকে কিন্তু ক্রিকেটার বানাচ্ছে না। এবং সেটা ঘটছে আপনার শহরেই।

সন্তানকে শিগগিরি ‘দঙ্গল’ দেখান। কিন্তু আপনি মহাবীর হয়ে যাবেন না। ‘দঙ্গল’ একটা উৎসাহ। একটা প্রতিবাদ।

চিরকাল ডিমের কুসুমটা আমি সরিয়ে রাখি শেষে খাব বলে। সে ভাবেই এই ছবির ‘কুসুম’ আমিরকে দিয়ে লেখা শেষ করব। আমির অবশ্য জোড়়া ‘কুসুম’ — অ্যাক্টর ও প্রোডিউসর দুটি ভূমিকাতেই তার জুড়ি নেই।

অভিনেতা আমির বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রোজ রোজ বিবর্তিত হয়েছেন। দেহের ওজন ওই পরিমাণে বাড়ানো, আবার মাত্র এক মিনিটের একটা শটের জন্য পরিশ্রম করে অতটা কমানো! অবিশ্বাস্য!

আমিও অনুপ্রাণিত। আমিও ওই রকম আবার আগের মতো আমার পুরনো মেদহীন শরীরে ফিরতে চাই। তার জন্য রোজ ‘সুভা পাঁচ বাজে’ উঠতেও রাজি। কিন্তু আমার ঘুম ভাঙানোর জন্য কোনও মহাবীর চেনা নেই, তাই হচ্ছে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন