নিঃশব্দ চাহনিতে অতীতের বেদনা

দক্ষিণ ভারতে চিত্রকলায় আধুনিকতার বিবর্তন উত্তর ভারতের থেকে একটু ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। ১৯৬০-এর দশকে সারা ভারতে আধুনিকতাবাদের যখন নতুন নির্মাণ চলেছে, সেখানে দক্ষিণী শিল্পীরা ঐতিহ্যের স্বতন্ত্র স্বর বজায় রাখতে পেরেছেন প্রজ্ঞাদীপ্তভাবে।

Advertisement

মৃণাল ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share:

পরম্পরা: এমামি চিজেল আর্ট-এ শিল্পী এস জি বাসুদেব এর একটি ছবি

দক্ষিণ ভারতে চিত্রকলায় আধুনিকতার বিবর্তন উত্তর ভারতের থেকে একটু ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। ১৯৬০-এর দশকে সারা ভারতে আধুনিকতাবাদের যখন নতুন নির্মাণ চলেছে, সেখানে দক্ষিণী শিল্পীরা ঐতিহ্যের স্বতন্ত্র স্বর বজায় রাখতে পেরেছেন প্রজ্ঞাদীপ্তভাবে। এস জি বাসুদেব দক্ষিণ ভারতের ষাটের দশকের একজন খ্যাতিমান শিল্পী। সম্প্রতি এমামি চিজেল আর্ট-এ তাঁর তেলরঙের ছবি, ট্যাপেস্ট্রি ও তামার পাতের উপর নতোন্নত বা রিলিফ পদ্ধতির কাজ নিয়ে এক সমৃদ্ধ প্রদর্শনী হল।

Advertisement

তাঁর জন্ম কর্ণাটকে। ছাত্র অবস্থাতেই পেয়েছিলেন ললিতকলা অ্যাকাডেমির জাতীয় পুরস্কার। তাঁর ছবিতে ও অন্য শিল্পকাজে দক্ষিণ ভারতীয় লৌকিকের প্রতিফলন বিশেষ এক অলঙ্করণ-সম্পৃক্ত আত্মপরিচয় তৈরি করেছে, যার পরিচয় আমরা পেয়েছি এই প্রদর্শনীর রচনায়। ১৯৭০-এর দশকে তিনি করেছিলেন ‘মৈথুন’ চিত্রমালা। ১৯৮০-র দশকে ‘বৃক্ষিকা’ চিত্রমালা, নব্বইয়ের দশকে ‘থিয়েটার অব লাইফ’। প্রত্নতার আদিরূপকে তিনি উন্নীত করেছেন আধুনিকতায়।

তাঁর তেলরঙের চিত্রমালায় যেন সম্পৃক্ত হয়ে আছে এক বিপন্ন প্রেম। ডিম্বাকৃতিতে গড়া একটি মেয়ের মুখ বিষাদমিশ্রিত বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। বৃক্ষের তলায় পাশাপাশি দাঁড়ায় ছেলে ও মেয়ে। কখনও বা দুই নারী। শুধু নিঃশব্দ চাহনিতে ঝরে পড়ে অতীতের বেদনা, আধুনিকতাও।

Advertisement

বস্ত্র বয়নে থাকে সুতোর টানা ও পড়েনের সমাহৃত বিন্যাস। ট্যাপেস্ট্রিতে টানা-র সুতোগুলো লুকানো থাকে। পড়েনের সুতোর বিন্যাসেই গড়ে ওঠে প্রতিমাকল্প। রঙের কাজের মতো বিশদ ও নিপুণতা হয়তো আসে না।

তবু ত্রিমাত্রিকতার বিভ্রম ফুটিয়ে তোলা যায়। বাসুদেব অবশ্য লৌকিকের আবহে দ্বিমাত্রিকতাতেই সংস্থিত থাকতে চেয়েছেন। যে ছবিটি আমরা দেখছি এই লেখার সঙ্গে তাতে সেই মেয়েটি রয়েছে। চোখ দুটিতে কী নিষ্পাপ আকুতি! আর পরিবৃত প্রান্তরে শিশুরা খেলছে। উড়ছে পাখি। যে সৌন্দর্য আজ হারিয়ে যাচ্ছে, তারই স্মৃতি যেন ছড়িয়ে দিতে চাইছেন শিল্পী।

তাঁর তামার পাতের নতোন্নত রচনাগুলিতে ছবি ও ভাস্কর্য নিবিড় একাত্মতায় সম্পৃক্ত হয়ে থাকে। ‘ম্যান-ট্রি’ রচনাটিতে সেই পিপুল গাছটিকে আমরা দেখি, বুদ্ধের স্মৃতি বহন করে যে আজও আমাদের কাছে উত্তরণের বার্তা নিয়ে আসে। আজ উন্নয়ন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার দাপটে সেই বার্তা হারিয়ে গেছে। বাসুদেবের সৃজন সেই ধারারই।

অন্তর্লোকে মগ্ন হয়েও

শিল্পী: অর্জুন দাস

বিড়লা অ্যাকাডেমির পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল। সেই উপলক্ষে হয়ে গেল বার্ষিক প্রদর্শনীও। ‘স্বর্ণালী শাখা’ শিরোনামে জনি এম এল পরিকল্পিত শিল্প-সম্ভারে দেখানো হয়েছে ভারতের ৬৬ জন শিল্পীর কাজ। দ্বিতীয় পর্বে তরুণ শিল্পীদের প্রতিযোগিতামূলক প্রদর্শনী। ভারতীয় দৃশ্যকলায় আধুনিকতাবাদী চেতনার বিকাশ শুরু হয়েছিল ১৯৪০-এর দশক থেকে। রবীন্দ্রনাথকে বলা যেতে পারে প্রথম আধুনিকতাবাদী চিত্রী। রবীন্দ্রনাথের ছবি এই ক্ষয়কে অস্তিময় আলো-আঁধারিতে অভিব্যক্ত করেছে।

‘স্বর্ণালী শাখা’ প্রদর্শনীতে রয়েছে ধীরেন্দ্রনাথ ব্রহ্ম, অমিত সরকার, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়, গণেশ হালুই, এ রামচন্দ্রন, দেবব্রত চক্রবর্তী প্রমুখ শিল্পীর কাজ। আবার স্বাভাবিকতাবাদী ঐতিহ্যের বিবর্তিত রূপ দেখা যায় সুধীর পটবর্ধন, অনুপম সুদ, শুভাপ্রসন্ন প্রমুখ শিল্পীর প্রতিবাদী রচনায়। আধুনিকতাবাদ থেকে পোস্ট-মর্ডান ভাবনার দিকে অগ্রগমনের দৃষ্টান্ত অতুল দোদিয়া, আদিত্য বসাক, পঙ্কজ পওয়ার, জয়শ্রী চক্রবর্তী, জয়া গঙ্গোপাধ্যায়, পার্থপ্রতিম দেব, জনক ঝংকার নার্জারি, রবীন্দ্র রেড্ডি প্রমুখ শিল্পীর ছবি ও ভাস্কর্য। মনু পারেখের ‘ফ্লাওয়ার্স ফ্রম হেভেন’ ও মাধবী পারেখের ‘দ্য ক্রাইস্ট’ যথাক্রমে পাশ্চাত্য অভিব্যক্তিবাদ ও দেশীয় লৌকিককে সাম্প্রতিক মূল্যমানে অভিষিক্ত করার অনবদ্য দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয় পর্যায়ে তরুণ শিল্পীদের কাজে অর্জুন দাসের কাঠের কাজটি ভাবনা ও দক্ষতায় অনবদ্য।

বাংলার নিসর্গ

ক্রিয়েটিফ পেইন্টার্স গ্রুপ দলের দশ জন শিল্পীর ছবি ও আলোকচিত্র নিয়ে সম্মেলক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি ইলোরা আর্ট গ্যালারিতে। শুভেন্দু পালিতের নদীর নিসর্গে বাংলার ঐতিহ্যের প্রতিফলন ছিল। চন্দনা চক্রবর্তীর নদীতে জাল ফেলার দৃশ্যটি অসামান্য ব্যঞ্জনাময়। অজস্র বিড়ালের সমাবেশে লৌকিক আঙ্গিকে মন্ময় ছবি এঁকেছেন মধুবন্তী পাল। কল্পরূপাত্মক অবয়বী ছবি ছিল রতন সিংহ, সুভাষ সরকার, মহুয়া রায় ও অর্কশিখা-র। নিসর্গ এঁকেছেন দীনেশ আগরওয়াল ও শিশুশিল্পী অরিত্র আদক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন