পরভিন সুলতানা
স্বনামধন্য সরোদবাদক উস্তাদ আলি আকবর খানের স্মৃতিতে উদ্যাপিত স্বর সম্রাট ফেস্টিভ্যাল এ বার সপ্তম বর্ষে পদার্পণ করল। বিদগ্ধ সঙ্গীতবেত্তাদের সম্মেলনে নজরুল মঞ্চে জমে উঠেছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর।
হিন্দুস্থানি স্লাইড গিটারে রাগ চারুকেশী বাজিয়ে শোনালেন দেবাশিস ভট্টাচার্য। দক্ষিণী এই রাগটি অত্যন্ত শ্রুতিমধুর। দেবাশিস রাগটিকে সযত্ন পরিবেশন করেছেন। আলাপ-জোড়-ঝালার পরে চমৎকার দু’টি গৎ শোনালেন শিল্পী। তাঁর তন্ত্রকারী বাজ খুব উপভোগ্য ছিল। দ্রুত গতিতে এই ধরনের বাদ্যযন্ত্রের মেলোডি বজায় রাখার কাজটি খুব সহজ নয়। তাঁর জন্য প্রয়োজন সুকৌশলী সুরসঞ্চালনা। দেবাশিসের বাদন সেই পারঙ্গমতার স্তর স্পর্শ করেছে। তবলায় শিল্পীকে যথাযোগ্য সহযোগিতা করেছেন তন্ময় বসু।
কিরানা ঘরানার শিল্পী জয়তীর্থ মেভুন্ডি শোনালেন বৃন্দাবনী সারং রাগে বিলম্বিত এবং দ্রুত বন্দিশ। তবলায় সৌমেন সরকার এবং হারমোনিয়ামে সনাতন গোস্বামী তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন। শিল্পীর কণ্ঠস্বর ব্যাপ্ত এবং সুনিয়ন্ত্রিত। রাগরূপটি খুব সুন্দর ফুটে উঠেছিল সংক্ষিপ্ত সুরবিস্তারে। দ্রুত লয়ে অলঙ্কারবহুল তানগুলিও শুনতে মন্দ লাগেনি। তিনতালে বাঁধা দ্রুত বন্দিশটি চলমানতা পেয়েছে শিল্পীর উপস্থাপনায়। তাঁর দ্বিতীয় নিবেদন ছিল রাগ মুলতানি। তিনতাল এবং একতালের দু’টি জনপ্রিয় দ্রুত বন্দিশ পরিবেশন করলেন জয়তীর্থ। একতালের বন্দিশটি অপেক্ষাকৃত ভাল গেয়েছেন শিল্পী। তবলার বর্ধিত গতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ গায়ন শ্রোতারা উপভোগ করেছেন। তাঁর সর্বশেষ পরিবেশনা ছিল জনপ্রিয় ভজন ‘জয় দুর্গে দুর্গতিহারিণী’। ভজনটি অধিকশ্রুত হলেও জয়তীর্থ তাঁর বলিষ্ঠ গায়নশৈলীর দ্বারা উপস্থাপনাকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছেন।
জনসম্বোধনী রাগ দিয়ে শুরু করলেন ইমদাদখানি ঘরানার সেতারবাদক সুজাত খান। আলাপ-জোড়-ঝালার পরে শোনালেন ফৈয়জ খানের একটি বন্দিশ। আলাপটি ভাল লাগলেও, জোড় এবং ঝালা অংশে তাঁর বাদন তেমন মন ছোঁয়নি। লয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সেতারবাদন বেশ অস্পষ্ট লেগেছে। ‘রঙ্গি সারি গুলাবি চুনরিয়া’ গানটি বাজানোর পাশাপাশি খানিক গেয়েও শোনালেন শিল্পী। তবে বাজনা আর-একটু শোনা গেলে ভাল লাগত। তবলায় ছিলেন সাবির খান এবং তাঁর পুত্র আসিফ খান।
প্রথম দিনের অনুষ্ঠানের শেষ কণ্ঠসঙ্গীতশিল্পী পরভিন সুলতানা শোনালেন পুরিয়া ধানেশ্রী। বিলম্বিত একতালের বন্দিশটিকে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ গায়নভঙ্গিতে পরিপূর্ণতা দিয়েছেন শিল্পী। তবে তারসপ্তকের সুরবিস্তারে তাঁর কণ্ঠ বিশেষ সঙ্গ দেয়নি। অধিক সময় উচ্চ স্বরগ্রামে বিচরণের ফলেই হয়তো তাঁর কণ্ঠে একটা ক্লান্তির ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তবে হংসধ্বনি রাগে তারানাটি তিনি চমৎকার গেয়েছেন। পরভিন সুলতানা অনুষ্ঠান শেষ করলেন মীরার ভজন ‘সখিরি ম্যায় গিরধর কি রং’ শুনিয়ে। শিল্পীর সঙ্গে তবলায় ছিলেন স্বপন চৌধুরী, হারমোনিয়ামে জ্যোতি গোহো।
মঞ্জু মেহতার সেতারবাদন দিয়ে দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান শুরু হল। বাজালেন রাগ মধুমন্তী। আলাপটি ভালই শুরু করেছিলেন শিল্পী। মধ্যলয় এবং দ্রুত গৎ দুটিই ভাল বাজিয়েছেন। শিল্পীর সঙ্গে তবলা বাজিয়েছেন উজ্জ্বল ভারতী।
বেশ অন্য রকম একটা প্রাপ্তি ছিল প্রবীণ গোড়কিন্ডি এবং শশাঙ্ক সুব্রহ্মণ্যমের যৌথ বংশীবাদন। উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীতরীতির সুসমন্বয় ঘটেছিল তাঁদের বাদনে। রাগ ভীমপলশ্রীতে আলাপ-জোড়ের পরে আদিতাল এবং তিনতালের কম্পোজিশন শোনালেন। দুই শিল্পীর বাদনই বেশ উপভোগ্য। ভীমপলশ্রীর শুদ্ধ মধ্যমটিকে তাঁরা যে-পারদর্শিতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন, তা প্রশংসনীয়। তাঁদের সহযোগী শিল্পী হিসেবে তবলায় ছিলেন শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মৃদঙ্গমে সতীশ পত্রী। চার জনের সম্মিলিত বাদন অনুষ্ঠানটিতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিল।
তাঁর দরাজ কণ্ঠের গায়ন বরাবর শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে। এ বারও তার অন্যথা ঘটেনি। ভেঙ্কটেশ কুমারের পরিবেশনায় ছিল মারোয়া এবং হাম্বীর রাগ। দু’টি রাগকেই তিনি অনায়াস ভঙ্গিতে সম্পূর্ণতা দিয়েছেন। মারোয়া রাগের বিলম্বিতটি বিস্তার, তানকারির বর্ণময় বিন্যাসে উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। ধৈবত, কড়ি মধ্যম, গান্ধার ছুঁয়ে কোমল ঋষভের ক্ষণিক স্থিতি খুবই রমণীয় হয়ে উঠেছিল তাঁর উপস্থাপনায়। হাম্বীর রাগের দ্রুত বন্দিশটিও চমৎকার গেয়েছেন শিল্পী। তাঁর শেষ নিবেদন ছিল জনপ্রিয় ভজন ‘পায়ো জি ম্যায়নে’। সমর সাহার তবলা এবং রূপশ্রী ভট্টাচার্যের হারমোনিয়াম যোগ্য সঙ্গত করেছে।
পরবর্তী উপস্থাপনা ছিল রাজীব তারানাথের সরোদবাদন। আলি আকবর খানের শিষ্যদের মধ্যে তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ। শোনালেন রাগ মদন মঞ্জরী। রাগটি সৃষ্টি করেছিলেন উস্তাদ আলাউদ্দিন খান। এ ছাড়াও শোনালেন মিশ্র গারা রাগে তিনটি গৎ। তবলায় সঙ্গত করেছেন যোগেশ শামসি।
উস্তাদ জ়াকির হুসেনের তবলাবাদন ছিল অনুষ্ঠানের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি। তাঁর নান্দনিক উপস্থাপনা সকলের মন ছুঁয়ে গিয়েছে। নানা ধরনের বাদনশৈলীর সম্মিলিত উপচারে পরিবেশনাটিকে সাজিয়েছিলেন তিনি। তাঁর তবলায় কখনও মূর্ত হল ‘দিল্লি কা কায়দা’, কখনও বা ‘পঞ্জাব কা কায়দা’। সহযোগী শিল্পী হিসেবে ছিলেন নবীন শর্মা (ঢোলক), অনন্ত কৃষ্ণন (মৃদঙ্গম) এবং সাবির খান (সারেঙ্গি)। এই যৌথ পরিবেশনার আবহ তৈরির ক্ষেত্রে সাবির খানের সারেঙ্গি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। ঢোলক এবং মৃদঙ্গমের সঙ্গে সওয়াল-জবাব অংশটিও শ্রোতারা উপভোগ করেছেন।