চিরন্তন ট্র্যাজেডি

দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের ‘তুঘলক’ নাটকটি দেখলেন আশিস পাঠকসংসৃতি-র ‘তুঘলক’। বিভিন্ন ভাষায় বহু বার অভিনীত হয়েছে গিরীশ কারনাডের এই নাটকটি। বস্তুত, ভারতনাট্যের ইতিহাসে ‘তুঘলক’ একাই একটি অধ্যায়ের দাবি করতে পারে। গত অর্ধশতকের ভারতমঞ্চ এই নাটকটির বেশ কয়েকটি স্মরণীয় প্রযোজনার সাক্ষী হয়ে থেকেছে। ন্যাশানাল স্কুল অব ড্রামার জন্য ইব্রাহিম আলকাজি দিল্লির পুরনো কেল্লায় অভিনয় করিয়েছিলেন এই নাটকের। পরে আলেক পদমজি, ওম শিবপুরী থেকে ভানু ভারতী... নাটকটির উজ্জ্বল প্রযোজনা ইতিহাসে নাম থাকবে অনেকেরই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share:

সংসৃতি-র ‘তুঘলক’। বিভিন্ন ভাষায় বহু বার অভিনীত হয়েছে গিরীশ কারনাডের এই নাটকটি। বস্তুত, ভারতনাট্যের ইতিহাসে ‘তুঘলক’ একাই একটি অধ্যায়ের দাবি করতে পারে। গত অর্ধশতকের ভারতমঞ্চ এই নাটকটির বেশ কয়েকটি স্মরণীয় প্রযোজনার সাক্ষী হয়ে থেকেছে। ন্যাশানাল স্কুল অব ড্রামার জন্য ইব্রাহিম আলকাজি দিল্লির পুরনো কেল্লায় অভিনয় করিয়েছিলেন এই নাটকের। পরে আলেক পদমজি, ওম শিবপুরী থেকে ভানু ভারতী... নাটকটির উজ্জ্বল প্রযোজনা ইতিহাসে নাম থাকবে অনেকেরই।

Advertisement

বাংলা ভাষায় ‘তুঘলক’-এর প্রথম অভিনয় শ্যামানন্দ জালানের নির্দেশনায়। নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন শম্ভু মিত্র। ১৯৭১-এর সেই অভিনয় আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। পরে শেখর চট্টোপাধ্যায়ের এবং সলিল বন্দ্যোপাধ্যায়ও অভিনয় করেছেন এ নাটক। সংসৃতি-র এই সাম্প্রতিক প্রযোজনায় তাই প্রত্যাশার মাত্রাটা ছিল যথেষ্ট। বস্তুত ধ্রুপদী হয়ে থাকা কোনও নাটককে সাম্প্রতিকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রত্যাশাটা থাকেই। তার উপরে যে নাটক ও নাট্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে এত বহুমুখী উজ্জ্বলতা, তার নতুন প্রযোজনায় অকিঞ্চিৎকর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। নির্দেশক দেবেশ চট্টোপাধ্যায় অত্যন্ত পরিণত বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন চিত্তরঞ্জন ঘোষ ও স্বপন মজুমদারের অনুবাদটিকেই নাটক হিসেবে ব্যবহার করে। ইসলাম আর রাজ্যপাট, ধর্ম আর ধর্মনিরপেক্ষ প্রশাসন এ নাটকে এক চিরন্তন ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়েছে। সেই ট্র্যাজেডির আবহ আগাগোড়া বজায় রেখেছে এ নাটকের ভাষা।

‘তুঘলক’ নাটকের সমস্যার মূল বিন্দুগুলিও শাশ্বত। নতুন ভাবনা আর স্বপ্ন দেখার সাহস ভিন্ন ভিন্ন দেশকালের পরিপ্রেক্ষিতে তর্জনী তুলেছে ধর্মীয় আর আমলা তান্ত্রিক বেড়াজালের বিরুদ্ধে। সেই সংঘাত চিরকালীন। তাকে সাম্প্রতিকতার মেক-আপ দিতে গিয়ে সংলাপে বা ঘটনার বিন্যাসে সাম্প্রতিক কোনও তুচ্ছ রাজনৈতিক প্রসঙ্গের অবতারণা করেননি দেবেশ, সেই সংযম এ নাট্যের সবচেয়ে বড় গুণ। তবু, যে এককেন্দ্রিকতা সাম্প্রতিক ক্ষমতার সবচেয়ে বড় বিপজ্জনক প্রবণতা তার সঙ্গে তুঘলককে মিলিয়ে নিতে অসুবিধা হয় না সচেতন দর্শকের, সমসময়ের সঙ্গে এ ভাবে সহজ যোগাযোগ ঘটায় এ নাট্য। নামভূমিকায় রজতাভ যথাযথ। অসহায়তা আর সঙ্কল্পে, ক্রূরতা আর ঔদার্যে জটিল তাঁর চরিত্রটির প্রতি সুবিচার করতে পেরেছেন তিনি। যে অর্ধস্ফুট অট্টহাসিটি তাঁর বাচনমুদ্রায় ফিরে ফিরে আসে তা তাঁর চরিত্রের দশচক্রে দমবন্ধ অবস্থাটিকে স্পষ্ট করে। স্মরণীয় হয়ে থাকবে তাঁর অভিনয়। সৎ মা-র ভূমিকায় কস্তুরী চট্টোপাধ্যায় এবং আজিজ আর আজমের ভূমিকায় গম্ভীরা ভট্টাচার্য ও কোরক সামন্তের জুটিও মনে রাখার মতো। সঞ্চয়ন ঘোষ মঞ্চসজ্জায় এ বারও তাঁর কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। সঙ্গীতে দ্রোণ আচার্য সম্ভাবনাময়।

Advertisement

সেই কাবুলিওয়ালা

কাবুলিওয়ালা একই সঙ্গে অনেকগুলো দিক খুলে দেয়। মানবিক দিকটি হল প্রবাসী পিতার কন্যার প্রতি যে ভালবাসা। সে তার প্রতিরূপ খুঁজে পায় ভিনদেশি বালিকার মধ্যে। রবীন্দ্রনাথের এই ছোট গল্পটিতে বাৎসল্যের ছবি দেশকালের সীমানা ছাপিয়ে যায়। দ্বিভাষিক সিনেমা তো বটেই, মঞ্চেও এর অভিনয় হয়েছে বেশ কয়েকবার। সম্প্রতি প্রয়াস-এর কাবুলিওয়ালা মঞ্চস্থ হল। শুরুতেই স্বরাজ ঘোষ, সমর মিত্র, সঙ্গীত পরিচালক কালিদাস নন্দী বাংলা চলচ্চিত্রের চরিত্রাভিনেতা ছবি বিশ্বাসকে নাটকটি উৎসর্গ করলেন।

ভদ্রা বসুর নাট্যরূপ এগিয়েছে মূল গল্পের সূত্র মেনেই। স্বামী-স্ত্রী ও শিশুকন্যা মিনিকে নিয়ে একটি মধ্যবিত্ত পরিবার। কাবুল আগত এই ভ্রাম্যমান বিক্রেতা রহমতের সংস্পর্শে আসা এই শিশুকন্যাটিকে দেখে তার মেয়ের কথাই মনে পড়ে। একটা অসম সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর পর নাটক ঝুঁকে পড়ে বিয়োগান্ত মোচড়ের দিকে। অনিচ্ছুক হত্যার দায়ে কারাবাস হয় কাবুলিওয়ালা রহমতের। মুক্তি পেয়ে সে তার পুরনো মিনিকে খুঁজে পায় না। সে তখন বিয়ের কনে। রহমতের মনে পড়ে যায় তার নিজের মেয়েটিও তো এত দিনে এত বড়ই হয়েছে। কিন্তু মিনি তাকে চিনতেই পারে না। এক আবেগঘন মুহূর্তের মধ্য দিয়ে সে দেশে ফিরে যাওয়া মনস্থ করে। কাহিনি আটোসাঁটো বেঁধে রেখেছে সুঠাম নাট্যরূপ এবং নির্ভার নির্দেশনা। নামভূমিকায় সুদীপ মুখোপাধ্যায়ের আঙ্গিক ও বাচিক অভিনয় ভাল। কিছু সংলাপ বিশেষত্ব রহমতের নিজস্ব ভাষায় বলা শ্রোতার কাছে অবোধ্য ঠেকেছে। মিনি-র ভূমিকায় সৃজা সকলের মন ছুঁয়ে যায়। অনুরূপ শিশু শিল্পী মেঘাদ্রিও। বাবার ভূমিকায় জয়ন্ত ভট্টাচার্য মার্জিত ও সাবলীল। মিনির মা সুদক্ষিণা চৌধুরী ও অন্য মহিলা চরিত্র, উর্মিলা সুতপা রায়-র কাছ থেকে আরও একটু সচেতনতার আশা ছিল। যেমন আরও কিছু স্পেসের অবকাশ ছিল সঙ্গীত পরিচালনা ও আবহ নির্মাণে। কালিদাস নন্দী নিজের নামের সুবিচার বজায় রেখেছেন। আলোর প্রক্ষেপণে সমতা ছিল না। রহমত ও অন্যদের পোশাক পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে হবে। টিমওয়ার্কটি সফল করতে সহায়তা করেছেন দেবকান্তি মাহাদানি, ইন্দ্রজিৎ মিদ্দে, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, অরূপ আচার্য, বিষ্ণু ঘোষ প্রমুখ।

বর্ণময় জীবন কুন্তীর

পিনাকী চৌধুরী

সম্প্রতি তপন থিয়েটারে অনুষ্ঠিত হল ‘দমদম শব্দমুগ্ধ’ প্রযোজিত নাটক ‘রাজকুলগাথা’। মহাভারতের চরিত্র কুন্তীর জীবনের নানা কাহিনি উঠে এসেছে নাটকে। কুন্তীর বর্ণময় জীবন পথে এসেছে রাজনীতি। কৃষ্ণকুলজাতা এক অতি সাধারণ রাজকন্যা পৃথা ক্রমে ক্রমে কীভাবে প্রখর রাজনৈতিক বুদ্ধিসম্পন্না নারী কুন্তী হয়ে উঠলেন এবং পরবর্তী কালে মহাভারতের যুদ্ধকে কীভাবে তিনি নিয়ন্ত্রণ করলেন, তা নিয়েই নাটক। কিন্তু শুধুমাত্র রাজনীতি করলেই কি জীবনে সফলতা আসে? নাটকের শেষ দিকে ছিল চমক। কুন্তী তাঁর জীবনের সব কিছু হারান এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র কর্ণ যুদ্ধে নিহত হন। এক সময়ে কুন্তী উপলব্ধি করেন ক্ষমতা জীবনের প্রধান লক্ষ্য নয়। শেষে তাঁর রাজত্ব ছেড়ে বনবাসী হবার জন্য প্রস্তুত হন।

নাটকের বিষয়বস্তু ভাল হলেও নাট্যমুহূর্ত সেইভাবে সৃষ্টি হয়নি। সর্বোপরি বাংলা নাটকে মাঝে মধ্যেই ইংরেজি সংলাপ বড়ই বেমানান, শ্রুতিকটু লাগে। তবে কুশীলবরা কিন্তু নিজ নিজ অভিনয়ে স-সম্মানে উত্তীর্ণ। সূত্রধরের ভূমিকায় রাকেশ ঘোষ প্রাণবন্ত। ভাল লাগে কুন্তীর চরিত্রে বর্ণালী রায়চৌধুরী এবং স্বাতী চক্রবর্তীকে। হিড়িম্বা এবং গান্ধারীর চরিত্রে প্রশংসনীয় প্রিয়াংকা রায়। এছাড়াও রঞ্জন বোসের অভিনয় মন্দ লাগে না। মঞ্চে বাবলু সরকারের আলোর ব্যবহার মানানসই। নাট্য নির্দেশনায় রাকেশ ঘোষ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন