করণকৌশল: ‘দ্য ডিভাইন ফেমিনিন’ প্রদর্শনীর একটি কাজ
দুই কন্যা দু’রকম রঙিন পৃথিবী গড়েছেন তাঁদের শিল্পকর্মের মাধ্যমে। সুমনা রায়চৌধুরীর পেন্টিং, সুস্মিতা চক্রবর্তীর বস্ত্রশিল্পে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা— এমনই বেশ কিছু কাজ নিয়ে গ্যালারি গোল্ডের তিন দিনের এই প্রদর্শনী ছিল যথার্থই উজ্জ্বল। শিল্পীরা তাঁদের কাজের মাধ্যমে চার জন ইউরোপীয় ও ভারতীয় শিল্পীকে স্মরণ করেছেন। গুস্তভ ক্লিম্ত, ফ্রিডা কালহো, যামিনী রায় ও নন্দলাল বসু তাঁদের শিল্পকলায় নারীদের নিয়ে যে সব কাজ করেছিলেন, তা মনে রেখেই সেই প্রয়াসকে নিজেদের উপলব্ধি ও সৃষ্টির মধ্যে প্রকাশের চেষ্টা করেছেন। এখানেই একটু তাল কেটেছে। বিশেষ করে সুমনার চিত্রকলা বেশ কিছুটা মার খেয়েছে সেই স্টাইল বজায় রাখতে গিয়ে। তবুও তাঁদের দ্বৈত পরিবেশনা ‘দ্য ডিভাইন ফেমিনিন’কে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
সুমনা সুইৎজ়ারল্যান্ড প্রবাসী। ওঁর সব কাজই নারীকেন্দ্রিক। শিল্পশিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ না থাকলেও বিভিন্ন জনের কাছে কাজ শেখা ও নিয়মিত চর্চার মধ্যে থাকার ফলে এবং নিজে প্রবাসে শিল্পশিক্ষাদানে নিযুক্ত থাকায় নিজস্ব একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পেরেছেন। সুমনার ছবিতে রঙের অতি উজ্জ্বল উপস্থিতি একটু চোখে লাগে। আলঙ্কারিক রকমের স্টাইলাইজ়েশনে তাঁর পক্ষপাত অনেক সময়েই ছবির ভারসাম্য ও রচনার গতিপথকে রুদ্ধ করেছে। এটুকু তাঁকে ভাবতে হবে। ক্লিম্তের প্যাটার্ন ও ডিজ়াইন নির্ভরতা এবং ফ্রিডা কালহোর পেন্টিংয়ের আলঙ্কারিক অনুপুঙ্খকে অত বেশি প্রত্যক্ষ ভাবে নিজের কম্পোজ়িশনে না মেশালেই ভাল হত। ভাবনাচিন্তায় সামঞ্জস্য আছে ঠিকই, কিন্তু একটি ছবি তৈরির ক্ষেত্রে তাকে সঠিক ভাবে লালন করার মধ্য দিয়ে শিল্পী নিজেই যেন কখন আত্মসমর্পণ করে বসে আছেন অন্য শিল্পের অন্তর্নিহিত সত্তায়। ফুল-লতাপাতা-পাখি এবং ভিন্ন নকশাধর্মী অলঙ্কারের টুকরো রূপবন্ধের ব্যবহার চমৎকার। তবে নন্দলাল, যামিনী রায় বা ফ্রিডার কাজের হুবহু অনুকরণকে স্রেফ নিজের মতো করে একটু বদলে নিলেই শিল্পকর্ম দাঁড়ায় না। রং চাপানো, প্রিন্টের প্রতিচ্ছায়া, চড়া রং তাঁর অন্যতম করণকৌশল। বিন্দুবাদী শিল্পীদের টেকনিকে করা ‘দ্য স্টাডি’ টুকরো ম্যুরালের বিভ্রম জাগায়। ভাল কাজ। আলোছায়াও চমৎকার। তাঁর অন্যান্য কিছু কাজে অবশ্য আলোছায়া ও ছায়াতপের ব্যবহার নেই।
সুস্মিতার পৃথিবী শুধুই সুতো বাঁধুনি, সেলাই-ফোঁড়াই কিংবা শাড়ি-ব্লাউজ়-টিউনিক, স্টোল কুর্তা-কুর্তি এথনিক জ্যাকেট, স্কার্ফ জুয়েলারির। মেয়েদের সাজগোজের নানা উপকরণকে শিল্পী নিজের মতো তৈরি করেছেন বিভিন্ন মাধ্যমে।
শিল্পকলা শুধুই চিত্র-ভাস্কর্য, ছাপাই ছবি, ম্যুরাল ও অন্যান্যতে সীমাবদ্ধ নয়। অনেক রকম ভাবনাই শিল্পী ফুটিয়ে তুলতে পারেন নিত্য ব্যবহার্য় যে কোনও সামগ্রীতে এক এক রকম পরিসরে। এই ভাবনা থেকে বস্ত্রশিল্পে খুব সুচারু দক্ষতায় সুস্মিতা হ্যান্ডলুমে নতুন দিগন্তের রূপরেখা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন।
আধুনিক বিশ্বের চূড়ান্ত ফ্যাশননির্ভর জীবনে অভ্যস্ত মানুষের চাহিদা অফুরান। এই জায়গাটিকেই ধরতে পেরেছেন সুস্মিতা। ব্যাগ, কুশন কভার, শাড়ির আঁচলে বিশ্বের কয়েকটি বিখ্যাত পেন্টিংয়ের মোটিফ ব্যবহার করেছেন। কখনও প্রত্যক্ষ ভাবে শিল্পীর প্রতিকৃতিও। পরিধেয় বস্ত্রেও তুলির ছোঁয়া। বিভিন্ন কারুকাজ, বাটিকের আধুনিক রূপারোপকে নানা অনুষঙ্গের আদলে ফেলে, তাকে সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখানো। এতে তিনি শুধু বিশ্বাসই করেন না— নিজের সৃষ্টিকর্মে করেও দেখিয়েছেন।