কী লিখি তোমায়

শুধু চিঠিতেই ভালবাসার অলি-গলি। কলামন্দিরে দেবশঙ্কর হালদার ও রায়া ভট্টাচার্যের শ্রুতিনাটক শুনলেন সৌমিত্র মিত্র। চৈত্র শেষের দাবদাহের ঘনঘটার মধ্যে এক নরম আর স্নিগ্ধ বাতাসে মনটা ভরে গেল কলামন্দিরে অতি সম্প্রতি। উপাসকের আয়োজনে একটি শ্রুতিনাটক ‘কী লিখি তোমায়’। এ আর গুর্নের লাভ লেটার্স অবলম্বনে শ্রীজাত’র রচনা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৬ ০০:০০
Share:

চৈত্র শেষের দাবদাহের ঘনঘটার মধ্যে এক নরম আর স্নিগ্ধ বাতাসে মনটা ভরে গেল কলামন্দিরে অতি সম্প্রতি। উপাসকের আয়োজনে একটি শ্রুতিনাটক ‘কী লিখি তোমায়’। এ আর গুর্নের লাভ লেটার্স অবলম্বনে শ্রীজাত’র রচনা। কিন্তু গুর্ন এখানে ছায়া মাত্র। পরতে পরতে শ্রীজাত তৈরি করেছেন যে কাহিনি তাতে দুটি চরিত্র নীল আর মিঠি। সেই কৈশোর থেকে যৌবনের দ্রাঘিমায় দুটি মানুষের ভালোবাসা নানা অলি গলি অতিক্রম করেছে যেন, যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের এই ভেবে। মধ্যবিত্ত পরিবারের নীল আর উচ্চবিত্ত পরিবারের মিঠি দুজনের পথ পৃথক কিন্তু ভালোবাসার মুঠিতে নানান মিঠিতে সেই ... রঙিন আর অনির্বচনীয় হয়ে উঠেছে। দেবশঙ্কর হালদার ও রায়া ভট্টাচার্যের অভিনয়ে। এখন আমাদের জীবন থেকে চিঠি কোথায় হারিয়ে গেছে। আধুনিকতার ইমেল আর হোয়াটসঅ্যাপের যুগে কলামন্দিরে সেই সন্ধ্যায় চিঠিগুলির অভিঘাত শুনতে শুনতে আমরাও কখনও ক্ষত বিক্ষত হয়েছি, কখনও দুর্নিবার প্রেমের জগতে ভেসে গেছি। চিঠিরও বয়স বেড়েছে। স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে উত্তরোত্তর আরও নতুন পথে। শ্রীজাত’র এই রচনার আগে বাংলা সাহিত্যে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, নীললোহিত, বুদ্ধদেব গুহ পত্রসাহিত্য রচনা করেছেন— সেই চিঠিগুলি দীর্ঘ এবং প্রায় উপন্যাসসম। কিন্তু শ্রীজাত’র লেখায় নাটকীয়তা বারবার উথলে উঠেছে, প্রতিভাত হয়েছে দুটি মানুষের প্রণয় সিক্ত অভিযাত্রা, কাব্যসুষমায় এক নির্মেদ বুনন। আর এই নতুন পথে মিঠি পাড়ি দিয়েছে কলকাতা শহর থেকে দূরে ইউরোপের দেশ ছাড়িয়ে আমেরিকায়। আর নীল মিঠির অমোঘ আকর্ষণে কলকাতা ছেড়ে শ্রীনগরের চাকরি ফেলে ছুটে যায় ফ্লোরেন্স মিঠির কাছে। মিঠি তার পরিবারের নানা ঝড় ঝাপটায় ক্ষত বিক্ষত। আর নীল যেন শালপ্রাংশু। নীল তার ভাললাগার কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পদ্য পাঠিয়ে দেয় মিঠিকে। মিঠির প্রবাসের দূরত্ব তাকে উন্মনা করে তোলে। শ্রীনগরের ছোট্ট বাংলোয় রুকসানা আর ফুটফুটে ছেলেকে নিয়ে নীলের সংসার। মিঠি বিদেশে অনীককে বিবাহ করে কিন্তু তার স্থায়িত্ব স্বল্প।

Advertisement

কখনও এক লাইন, কখনও বা দুলাইন অনতিসর চিঠিতে নীল মিঠির কথোপকথন যেন সরোদের মূর্ছনা। মিঠির ভূমিকায় রায়া ভট্টাচার্য এক অনায়াস দক্ষতায় তাঁর কণ্ঠস্বরের বিবর্তন ঘটিয়েছেন। চঞ্চলা বালিকা থেকে নারী-স্বরক্ষেপণের বৈচিত্রে রায়া রচনা করেছেন এক অনিন্দ্যসুন্দর মায়াজাল। আর দেবশঙ্কর হালদার, মঞ্চের এই সময়ের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, শান্ত, সমাহিত। দেবশঙ্করের কণ্ঠস্বরের পরতে পরতে সময় থেকে সময়ান্তরে প্রতিভাত হয়েছে নীল। এক নিটোল ছোট গল্পের মতো শ্রীজাত’র কী লিখি তোমায় এক অতি আধুনিকতার স্পর্শে ভরিয়ে দেয় মনকে। পাশাপাশি বোধ ও মননে দেবশঙ্কর – রায়া জুটির অভিনয় আবেগ, ক্রোধ, ভালবাসা, অস্থিরতা আর এক অপ্রাপ্তির মিশ্রণে শিখরে পৌঁছে যায়।

বাংলা মঞ্চের দুই তরুণ শিল্পী সৌমিক-পিয়ালী এবং সুদীপ সান্যাল যোগ্য সঙ্গত করেছেন। সৌমিক-পিয়ালীর সেট মঞ্চের দু কোণে দুটি চরিত্রকে ধরে রাখে। মাঝখানে দুটি রঙিন কাপড় একটি বৃত্ত প্রস্তুত করে। চরিত্র দুটির সংলাপের মধ্যে দিয়ে আমরা যেন ছুঁয়ে যাই ওই সময়কে তার বৃত্তের মধ্যে। সুদীপের আলো চরিত্রের বুননের সঙ্গে নানাভাবে বদলেছে। সংলাপের মুডের মধ্যে তৈরি হয়েছে আলোকমায়া। সূক্ষ্ম এবং মধুর। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত’র আবহ নাটকীয় মুহূর্তগুলিকে উন্মেষ করে – কথা যেখানে পায়ে হেঁটে পৌঁছোয় না, সুর সেখানে অবলীলায় পৌঁছে যায়। সমগ্র বিষয়টি এক সূত্রে বেঁধেছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।

Advertisement

শেষে ফিরে আসে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পদ্য। মেঘ ডাকছে ডাকুক ... এক পলকহীন নীরবতা। এক অনন্য বাচিক অভিনয়ের পর মিঠি ও নীল পরস্পর তাকায় দুজনের দিকে। গড়ে ওঠে এক ঘনপিনবিদ্ধ নাট্য মুহূর্ত। যেন অনেক কিছু বলা হল আবার কিছু কথা বলা হল না।

আমরা অপেক্ষা করে থাকব এই বলা আর না বলা কথার পরবর্তী মঞ্চায়নের জন্যে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন