আমার সকাল ফুরিয়ে গেল

তবু আজও কাকভোরেই যে আঁধার ফিকে হয়। কিন্তু খঞ্জনি আর বাজে কই! ঘোলা জলের ঝরনায় ভিজে ওঠে না তো পথঘাট। সাতসকালের উলটপুরাণের গল্প বলছেন সমরেশ মজুমদারতবু আজও কাকভোরেই যে আঁধার ফিকে হয়। কিন্তু খঞ্জনি আর বাজে কই! ঘোলা জলের ঝরনায় ভিজে ওঠে না তো পথঘাট। সাতসকালের উলটপুরাণের গল্প বলছেন সমরেশ মজুমদার

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০৮
Share:

ভোরের বেলা কখন এসে

Advertisement

পরশ করে গেছে হেসে

সেই চার বছর বয়স থেকে শুরু হয়েছিল। শীত গ্রীষ্ম অথবা বর্ষা, ঋতু যাই হোক না কেন, ঠাকুর্দা শেষ রাত সাড়ে চারটেতে বিছানা থেকে তুলতেন আমাকে। তৈরি হয়ে পৌনে পাঁচটায় ওঁর পেছন পেছন মর্নিং ওয়াকে যেতে হত। শীতের সময় অন্ধকার, তার মধ্যেই হেঁটে তিস্তার পাশ দিয়ে যত ক্ষণ না সূর্য দেখা দিচ্ছে তত ক্ষণ চলা। কান্নাকাটি করেও নিস্তার নেই। ‘ওঁ জবা কুসুম’ ঠাকুর্দার মুখে উচ্চারিত হলে মনে হত এখন বাড়িতে ফিরতে পারব। স্কুলে ভর্তি হলাম। তিন দিনের মাথায় একটা শব্দ শিখলাম। সেই ভোরের আলো আঁধারিতে ঠাকুর্দার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে শব্দটাকে চিবিয়ে উচ্চারণ করেছিলাম, ‘শা-লা’। ঠাকুর্দা মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পায়ে ব্যথা করছে নাকি! কী একটা যেন বললে!’ আমি ঝটপট দু’দিকে মাথা নেড়েছিলাম, না!

Advertisement

আমার ঘুমের দুয়ার ঠেলে

কে সেই খবর দিল মেলে

বাড়ি ফিরেছি কচি আলো গায়ে মেখে। এখনও মাটি সেই আলো স্পর্শ করার সুযোগ পায়নি গাছেদের জন্যে। হঠাৎ খঞ্জনি বেজে উঠত। সঙ্গে সঙ্গে চনমনিয়ে উঠতাম। ছুটে যেতাম বাড়ির সামনে। জনা পাঁচেক প্রবীণ মানুষ খঞ্জনি বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে আসছেন। রাইকে জাগতে বলছেন শুকসারির হয়ে। সেই সুর কানে আসা মাত্র ভোরের ওই সময়টায় পৃথিবীটাকে কী মায়াময় মনে হত! ওরা কারা তা আমি জানতাম না। কিন্তু ওই বালক বয়সে মনে হত অন্ধকারের ডিম ফেটে যেমন আলো বের হয়, ঘুম ভাঙা পাখিরা একটু হকচকিয়ে উঠেই আনন্দে চিৎকার শুরু করে পৃথিবীটাকে দেখতে পেয়ে, ঠিক তেমনি এঁদের খঞ্জনি বাজানো গান ওদের সঙ্গে সঙ্গত করে। পরে, অনেক পরে মনে হত, ওঁরা কেন রাইদের জাগতে বলতেন? মেয়েরা তো ছেলেদের অনেক আগে ঘুম থেকে ওঠেন। মা-পিসিমাদের তো তাই দেখেছি।

জেগে দেখি আমার আঁখি

আঁখির জলে গেছে ভেসে

কলকাতায় পড়তে এসে যে হস্টেলে জায়গা পেয়েছি, তার সামনে চওড়া রাজপথ। প্রথম ভোরে ঘুম ভাঙল জলের শব্দে। তাড়াতাড়ি জানলায় গিয়ে দেখি চারধার ঘন ছায়ায় মোড়া। মনে হল বাড়িগুলোও ঘুমোচ্ছে। কিন্তু কিছু মানুষ রাস্তায় পাশের গঙ্গাজলের কল খুলে পাইপ লাগিয়ে ফোয়ারার মতো জল ফেলছে। ওই শব্দ তার। জলপাইগুড়িতে আমি কখনও রাস্তা ধুতে কাউকে দেখিনি। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল শিশুকে যেমন তার মা স্নান করিয়ে দেন এরাও তেমনি রাস্তাকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। রোদ কড়া হলে ওদের এই যত্নের কথা কেউ জানতে পারবে না। আমাদের জীবনের ভোরবেলার কথা যেমন অনেকেই জানি না।

বেরিয়ে আসি রাজপথে। একটা দু’টো বাস যাচ্ছে, যার যাত্রিসংখ্যা রাস্তা থেকেই গোনা যায়। কয়েকজন প্রৌঢ় এমন ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছেন, যে দেখলে মনে হবে কোনও যুদ্ধ জয় করতে যাচ্ছেন। কোথায় যাচ্ছেন এঁরা? পিছু নিলাম। হাঁটতে হাঁটতে দেশবন্ধু পার্ক। তখন নামটা অজানা ছিল। গিয়ে দেখি প্রচুর মানুষ। কেউ হাফ প্যান্ট পরে দৌড়াচ্ছেন, কেউ ধুতি সামলে হাঁটছেন, একা একা শরীর চর্চা করছেন অনেকে।

পাশ দিয়ে দ্রুত যেতে যেতে এক বৃদ্ধ বলে গেলেন, ‘এখনই সূর্য উঠবে, সময় বেশি নেই ভাই, হাঁটো হাঁটো, বেস্ট মেডিসিন উইদাউট প্রেসক্রিপশন।’

সূর্য ওঠার আগের সময়টাকে বলা হয় কাকভোর। বড় স্বল্প কাল। তাকে উপভোগ করে যাও। ঠাকুর্দার কথা মনে পড়ল। ‘শালা’ বলেছিলাম বলে আচমকা চোখে জল এল। চোখ ভেসে গেল চোখের জলে।

মনে হল আকাশ যেন

কইল কথা কানে কানে

কয়েকটা দিন নেশা ছিল। কাকভোরে চলে যেতাম দেশবন্ধু পার্ক। সমস্ত কলকাতা যখন ঘুমের শেষ আমেজে তখন কিছু মানুষ স্বাস্থ্যচর্চা করছেন। কিন্তু তৃতীয় দিনে ওদের দেখতে পেলাম। একটা গাছের আড়াল থেকে আধ হাত দূরত্ব রেখে ওরা বসেছিল। বড়জোর একুশ থেকে তেইশ ওদের বয়স। প্রথম পাক দেওয়ার সময় ওদের কথা বলতে দেখিনি, দ্বিতীয় পাকেও নয়। কিন্তু মেয়েটিকে আড়চোখে তাকাতে দেখেছি।

এই সময়ে ওদের অভিভাবকরা বিছানায়। প্রতিবেশীরাও সম্ভবত বাড়ির ভেতরে। দেখা করার এত ভাল সময় আর কী হতে পারে। কথা না বলেও তো অনেক কথা বলা যায়। সেই অনেক কথা বলার জন্যে মর্নিং ওয়াকের অছিলায় ওরা বেরিয়ে এসেছে। ওদের পরিণতি যা হওয়ার তা নিশ্চয়ই হয়েছে। কিন্তু আমার মনে দু’জনের ছবিটা যে এখনও রয়ে গেছে। কাকভোর এমন একটা সময় যখন শুধু মনে মনে কথা বলতে ইচ্ছে করে! মনের কানে।

মনে হল সকল দেহ

পূর্ণ হল গানে গানে

ফার‌্স্ট ট্রাম দেখিনি কখনও। এক আবাসিক বন্ধু সঙ্গী হতে চাইল। সে খবর আনল দিনের প্রথম ট্রাম ডিপো থেকে ভোর চারটেয় ছাড়ে। ঘড়িতে অ্যালার্ম লাগিয়ে পৌঁছে গেলাম ট্রাম স্টপেজে। চারধার অন্ধকার। রাস্তায় লাইটপোস্টের আলো ডাইনির হলদে চোখের মতো। গাড়ি বা রিকশা দূরের কথা, কুকুরগুলো নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে ফুটপাথে। হঠাৎ বিকট শব্দ। যেন রক্তচোখ মেলে ছুটে আসছে দৈত্য। হাত দেখাতে সেটা থামতে হয় বলে থামল। লাফিয়ে উঠে দেখলাম দশ বারো জন যাত্রী। কারও কারও কাঁধে গামছা। ট্রাম চলেছে তীব্র গতিতে। ধর্মতলায় পৌঁছাতে বেশির ভাগ আসন ভর্তি। বুঝে গেছি ওঁরা স্নান করতে চলেছেন। গঙ্গাস্নান। তখন আঁধারে আলোয় মিশেল চলছে। ট্রাম থেকে নেমে শেষে ওঁদের অনুসরণ করে গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে দেখলাম স্নানের তোড়জোড় চলছে, কিছু মালিশওয়ালার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন কয়েক জন। তারপর পূর্বদিগন্তে আলোর ছায়া লাগতেই জলে ঝাঁপ, ‘গঙ্গা মাইকি জয়’। এরই মধ্যে কেউ চেঁচিয়ে বলে গেলেন উত্তমকুমার হাঁটছেন রেড রোডের পাশ দিয়ে। ছুট, ছুট, ছুট।

জীবননদী কূল ছাপিয়ে

ছড়িয়ে গেল অসীম দেশে

এখন ছায়া পূর্বগামিনী। কিন্তু এখনও কাকভোরে আঁধার ফিকে হয়। এখনও পাখি ডাকে। কিন্তু এখন খঞ্জনি বাজে না, গঙ্গাস্নানে ক’জন যায়! এখন গভীর রাতে কাজ শেষ করে ফিরেই রোদ্দুর কড়া হলে আধা ঘুম চোখে অফিস ছোটা। পায়ে অদৃশ্য সোনার শেকল বাঁধা, আর সকাল রয়েছে স্থির, আমরাই তাকে ছেড়ে হেঁটে চলেছি। বুকের ঘরে এখন শুধুই শূন্যতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন