তেরো নদীর পারে

কখনও স্টকহোম, তো কখনও ওহাইও, আবার পরের মাসেই লন্ডন। বাংলা নাটক নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার গল্প। বললেন দেবশঙ্কর হালদার। শুনলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়থিয়েটার অনেকটা সাগরের মতো, যা নেয় তা ফিরিয়েও দেয়। বাবা-মায়ের দেওয়া নাম ত্যাগ করে আমি তখন রেজাউদ্দিন। মঞ্চ নয়, জীবনের কথাই বলছি। সে প্রায় তিন দশক আগে কলেজবেলার কথা। পার্টি করি। পার্টিরই দেওয়া ‘টেক নেম’ ওই রেজাউদ্দিন। সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখি। মিছিল, মিটিঙে যাই। বিমানদাকে তখন থেকেই চিনি। শিবপুর, বিই কলেজ। মেটালার্জির অধ্যাপক। তুখড় বক্তা। অসম্ভব প্রাজ্ঞ। আমাদের নেতা শুধু নয়, আইডল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৪ ০০:১০
Share:

জার্মানিতে, ‘বিঅ্যানালে বন্’ উৎসবের সময়

থিয়েটার অনেকটা সাগরের মতো, যা নেয় তা ফিরিয়েও দেয়।

Advertisement

বাবা-মায়ের দেওয়া নাম ত্যাগ করে আমি তখন রেজাউদ্দিন। মঞ্চ নয়, জীবনের কথাই বলছি।

সে প্রায় তিন দশক আগে কলেজবেলার কথা। পার্টি করি। পার্টিরই দেওয়া ‘টেক নেম’ ওই রেজাউদ্দিন। সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখি। মিছিল, মিটিঙে যাই।

Advertisement

বিমানদাকে তখন থেকেই চিনি। শিবপুর, বিই কলেজ। মেটালার্জির অধ্যাপক। তুখড় বক্তা। অসম্ভব প্রাজ্ঞ। আমাদের নেতা শুধু নয়, আইডল। কলেজবেলার পর আর যোগাযোগ নেই বহু কাল। মাঝে শুনেছিলাম বিমানদা না কী আমেরিকায়। আমি তত দিনে নান্দীকার-এ।

বছরখানেক আগে নিউ ইয়র্কে থিয়েটার করতে গেছি। এয়ারপোর্টে যে ভদ্রলোক আমায় নিতে এসেছেন তিনি আবার সরাসরি দেবব্রত বিশ্বাসের ছাত্র। তাঁর বাড়িতে আমায় তুলবেন, শুধু একটাই কারণে, আমি জর্জ বিশ্বাসের ভূমিকায় অভিনয় করেছি, তাই!

এমন অবশ্য আমার প্রায়ই হয়। এ বছরই যেমন। ভদ্রলোক পেশায় অঙ্কোলজিস্ট। অসম্ভব ব্যস্ত। কাজের ফাঁকে ‘দেশ’ পত্রিকায় মাঝে মাঝেই লেখেন। সব কাজ তুলে রেখে লস এঞ্জেলেস্ এয়ারপোর্টে আমায় নিতে এসেছিলেন, ওঁর বাড়ি নিয়ে যাবেন বলে। কারণ কী জানেন? উনি আমার মধ্যে দিয়ে শিশির ভাদুড়ি থেকে দেবব্রত বিশ্বাসের সান্নিধ্য খুঁজে পেতে চান, তাই।

নিউইয়র্কের কথায় ফিরি। যেতে যেতে আলাপ চলছে। হঠাৎ ভদ্রলোক বললেন, তিনি এক জনকে চেনেন, এখন এদেশে। আগে কলকাতায় থাকতেন। অধ্যাপক। নাম, বিমান। আমি প্রায় ছিটকে উঠে বললাম, “বিমান? ঘোষ? মেটালার্জি?”

“হ্যা।ঁ তাই তো!”

ঝট করে ফোনে ধরলেন। ওপারে বিমানদা। এপারে আমি। ফোনটা ধরে কিছু বলব কী, একটা হু হু করা কান্না চেপে বসল গলায়। দু’জনেরই। তারপর কত কথা...!

আমাদের যে সময়ে বড় হওয়া, তখন তো আর অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়-শম্ভু মিত্রকে মঞ্চে পাইনি, উৎপল দত্তকে দেখেছি। তা’ও তাঁর শেষ জীবনে। ওই সময় বরং বাক্রুদ্ধ করে দিত বাংলাদেশের কিছু থিয়েটার। ঢাকা থিয়েটার। হুমায়ুন ফরিদি। ওঁদের দুটো নাটক ‘কেরামত মঙ্গল’, ‘কীতর্নখোলা’।

জামিল আহমেদকে আমরা মাস্টারমশাই মনে করি। তাত্ত্বিক নেতা। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ান। ওঁর ‘কীর্তনখোলা’ নাটকের সেট দেখে আমরা কেমন হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম। নান্দীকার-এর ‘শঙ্খপুরের সুকন্যা’র মঞ্চ ওঁরই ডিজাইন।

ওরেব্রো-তে সেই সাইকেল অভিযান

সব মিলিয়ে আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক পুরোটাই হৃদ্যতার। যদি এই মুহূর্তে কেউ বলেন, বাংলাদেশ, না জার্মানি, নাটক নিয়ে কোথায় যেতে চান বারবার? আমি বাংলাদেশের কথাই বলব। সে বার কিন্তু ধুন্ধুমার হয়ে গেল।

বোধহয় ’৮৭ সাল-টাল হবে। এরশাদ ক্ষমতায়। নান্দীকার থেকে আমরা দুটো নাটক নিয়ে গেছি। ‘শেষ সাক্ষাৎকার’ হবে ‘মহিলা সমিতি’-তে, আর ‘ফুটবল’ ‘শিল্পকলা একাডেমি’-র হলে।

শেষেরটা আবার দেখতে আসবেন রাষ্ট্রপ্রধান নিজে। নাটকটায় অনেকগুলো প্যারোডি গান। তার একটা ‘আমার সোনার বাংলা’ নিয়েও।

গল্পে ফুটবলার গৌতম সরকারের আদলে একটা চরিত্র আছে। যাঁর নাম অঞ্জন সরকার। যুবতী সীতা তাঁর অন্ধ ভক্ত। মাঠে ঢুকে জড়িয়ে-টড়িয়ে ধরেন তিনি অঞ্জনকে। একদিন পার্কে বসে সীতা আপন মনে গান ধরেছেন, ‘আমার সোনার অঞ্জন, আমি তোমায় ভালবাসি...’।

কলকাতায় তো লোকে এ দৃশ্য দেখে গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে?

আমরা যখন রিহার্সাল করছি, হঠাৎ এক কর্তাব্যক্তি শুনতে পেয়ে সোজা এসে বললেন, অসম্ভব, এ দৃশ্য বাদ দিতে হবে। বাংলাদেশ-এর জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে প্যারোডি! তার ওপর খোদ এরশাদ আসছেন দেখতে। কেলেঙ্কারি কাণ্ড।

আমরা তখন সবে উনিশ-কুড়ি। রক্ত গরম। দৃশ্য বাদ যাওয়া মানে, আমাদের তো প্রায় অঙ্গ বাদ দেওয়ার সমান।

রুদ্রবাবু (রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত) পড়লেন মাঝখানে। না পারছেন আমাদের ঠান্ডা করতে, না ওঁদের যুক্তি ফেলতে। হুলুস্থুল কাণ্ড। শেষে সঙ্গত কারণেই বাদ দিতে হল দৃশ্যটা, কিন্তু অনেক বাগবিতণ্ডার পর।

‘কাছের মানুষ’ বলে যে নাটকটা করি, ওটা নিয়ে প্রায়ই অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটে। নাটকটিতে এক পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী ধীরে ধীরে কী করে সুস্থ হয়ে ওঠেন, তারই কাহিনি।

‘কাছের মানুষ’-এর কোনও মার নেই। যেখানেই করি, তুমুল হাততলি। সে মছলন্দপুরই হোক, কী টাকি, বেনারসে করি, কী ওহাইও-তে।

হলিউডের এক বিখ্যাত চিত্র সমালোচক, মিড-ওয়েস্টের বাসিন্দা। থাকেন কানসাস সিটিতে। ‘কাছের মানুষ’ দেখে বলেছিলেন, “যদি নাটকটা ইংরেজিতে করানো যেত, তাবড় সিনেমা-থিয়েটারের সঙ্গে পাল্লা দিত।”

দিল্লির অভিজ্ঞতা বলি। সবে থিয়েটার শেষ হয়েছে। গ্রিন রুমে এক ভদ্রমহিলা এলেন। ছলছলে চোখ। বললেন, “আপনাকে একটা অনুরোধ করব?”

বললাম, “কী?”

উত্তরে বললেন, “আমার স্বামী। কর্নেল ছিলেন। হঠাৎ একটা অ্যাটাকের পর বিছানায়। কয়েকটা এক্সারসাইজ করলেই ঠিক হবেন অনেকটা। কিন্তু উনি জীবন সম্পর্কে কেমন যেন নিস্পৃহ হয়ে গিয়েছেন। ওঁর ধারণা আর সুস্থ হবেন না। আপনি যদি একবার আমাদের বাড়ি গিয়ে ওঁর সঙ্গে কথা বলেন...! আপনি তো সুস্থ হয়েছেন। উনি কেন পারবেন না।”

ভদ্রমহিলার চোখ ততক্ষণে ভেসে যাচ্ছে। ঠোঁটটা তির তির করে কাঁপছে। আমি কী বলব? অসহায়ের মতো চেয়ে আছি।

শেষে বললাম, “দেখুন আমি অভিনেতা মাত্র, ডাক্তার তো নই। তাছাড়া একটা দৃশ্যের পর নাটকে আমাকে সুস্থ হতেই হয়। জীবনের নিয়ম তো অন্য। আপনি বরং পরের বার ওঁকে নিয়ে আসুন। থিয়েটারটা দেখান।”

ছ’মাস বাদে ভদ্রমহিলা কলকাতায় উড়ে এসেছিলেন স্বামীকে নিয়ে। একাডেমিতে নাটকটা দেখলেন ওঁরা। নাটক শেষে ভদ্রলোক হুইল চেয়ারে বসেই আমার সঙ্গে কথা বললেন। উত্তেজিত— “আমি খুব চেষ্টা করছি, বুঝলেন, ঠিক আপনার মতো করেই।”

অনেক কষ্ট করে কান্না চেপে ওঁর হাত ধরলাম। বিশ্বাস করুন, নোবেল প্রাইজ পেলেও বোধহয় এত আনন্দ পেতাম না।

ঠিক একই রকম কাণ্ড ঘটে ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ করতে গিয়ে। যে নাটকের নায়ক সব্যসাচী সেন। পুলিশের তাড়া খেয়ে যিনি আত্মগোপন করেন ১৯৭৬ সালে। তারপর আবার লোকসমক্ষে আসেন ২০০২-এ। ভদ্রলোক বাড়িতে ফেরেন। তখন অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে। আশপাশ, ধ্যানধারণা, মানুষজন, রাস্তাঘাট।

কলকাতায় এক ভদ্রলোক তিরিশ-বত্রিশ বার নাটকটি দেখেছিলেন। প্রতিবারই গ্রিন রুমে এসে আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কিছু বলতেন না। এক সময় চলেও যেতেন। এক দিন আমি থাকতে না পেরে হালকা স্বরে বললাম, “আপনি কেন এমন করেন, বলবেন?”

উত্তর পেলাম, “আমার বাবাও তো ’৬৯-’৭০-এ বাড়ি ছেড়েছিলেন। আর খোঁজ পাইনি। আপনার এই নাটকটা দেখলে বাবার কথা মনে পড়ে।”

দিল্লিতেও একবার এই একই ঘটনা ঘটে। ভদ্রলোক প্রৌঢ়। ওঁর বাবা হারিয়ে যান বেশ কিছু কাল আগে। কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সময়। গ্রিন রুমে এসে হাত ধরে বলেছিলেন, “আপনাকে দেখে কেবলই আমার মনে হচ্ছিল, আমার বাবাও কি এমনই ছিলেন? এ ভাবেই কথা বলতেন? রাগ করতেন? আসলে আমি তো বাবাকে কাছে পাইনি কোনও দিন।”

ভাবুন একবার। দিল্লির মতো শহর। যেখানে মানুষের এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই। সেখানে এক ভদ্রলোক নাটক শেষে পিছনের গেটে অপেক্ষা করছিলেন, শুধু আমায় এই কথাটুকু বলে সামান্য হালকা হবেন বলে!

ক্রিস্টিনার মুখটা মনে পড়ছে। ক্রিস্টিনা নাইগ্রেন। সুইডিশ। সুইডেনে যাওয়ার আগে থেকেই ওঁকে চিনি। মাঝে মধ্যে ভারতেও আসেন। পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতি ওঁকে পাগল করে। ওখানে কিছু কাজও করছেন।

আমরাও পাগল হই, সুইডেনে গেলে। এত সুন্দর জায়গাটা! সুযোগ পেলেই সাইকেলে চেপে শহর ঘুরে থিয়েটার দেখে বেড়াই।

একবার তো ওখানকার গুটেনবার্গ শহরে গিয়ে আবিষ্কার করলাম অদ্ভুত কাণ্ড।

এয়ারপোর্টে নামলাম। তখন গরম কাল। শুনলাম, টানা চার মাস ওখানে নাট্যোৎসব হবে। সারা রাত শহর জাগবে। যদিও লোকসংখ্যা আমার পাড়া বেলগাছিয়ার চেয়েও কম। সে যাই হোক, রাত জাগবে তো! অথচ অফিসকাছারি যে বন্ধ থাকে, তা কিন্তু নয়। সবই হয়। তার মধ্যেই উৎসবটা চলে। প্যারিস থেকে একটা থিয়েটার এসেছিল। ‘সার্কাস’। প্রেক্ষাগৃহে নয়, ওঁরা থিয়েটার করেছিলেন সার্কাসের মতো তাঁবু খাটিয়ে। দর্শক বসে ছিলেন গ্যালারিতে।

সে বার স্টকহোম যাব। আমি আর গৌতম (হালদার)। এয়ারপোর্টে ক্রিস্টিনা আমাদের নিতে এলেন। ওরেব্রো বলে একটা জায়গায় যাব। দু’ঘণ্টার জার্নি। ট্রেনে।

খেজুরে কথা-টথার পর, ক্রিস্টিনা দেখি ব্যাগ থেকে একটা পানমশল্লার প্যাকেট বার করে, ছিঁড়ে নিজে খেলেন, আমাদের দিকে এগিয়েও দিলেন। দেখে তো পুরো থ!

বললাম, “এ কী! আপনি স্টকহোমে এ সব কোত্থেকে পেলেন? জানেন এগুলো খেলে কী হয়? আমরা খাই না।”

ক্রিস্টিনা বললেন, “সব জানি। কিন্তু কী করব? পুরুলিয়া-য় দেখলাম ওরা নাচের আগে খুবসে খায়। তাতে না কি নাচ ভাল হয়। আমি তো যখনই ইন্ডিয়া যাই প্যাকেট-প্যাকেট নিয়ে আসি। খারাপ, জানি। ছেড়েও দেব। কিন্তু এখন কেমন নেশায় পড়ে গেছি।”

কথাটা আমার কাছে যেন একটা রূপক এনে হাজির করল। পানমশল্লার সাফাই গাইছি না। কিন্তু ক্রিস্টিনার উত্তর শুনে মনে হল, কোনও বিশেষ জায়গায় কাজ করতে গেলে সত্যিই তো এ ভাবেই নিজেকে বিলীন করে দিতে হয়। সেই কোন কালে শিখেছি, মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়, জলে যেমন মাছ থাকে, ঠিক তেমন করে। ঘরে বসে একটু ব্রেখট, একটু স্তানিস্লাভস্কি পড়ে কিচ্ছু হয় না। গ্রহণ বা বর্জন ব্যাপারটা ওই ‘পানমশল্লার’ স্তরে করতে হয়।

’৯৮ সাল। সেই প্রথম বার আমার আমেরিকা যাওয়া। ফ্রিন্জ ফেস্টিভ্যাল। ওখানে ছ’দিন টানা থিয়েটার করতে হয়। একই নাটক।

আমরা ‘গোত্রহীন’ নিয়ে গিয়েছি। আর্থার মিলারের নাটক। যিনি কি না আমেরিকারই একজন অতি বিখ্যাত নাট্যকার। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল তাতে। আজকে দাঁড়িয়ে ওই সময়টাকে ধরতে গেলে শিশির ভাদুড়ির কথা মনে পড়ে যায়। ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’-এ নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ি সেজে আমার একটা সংলাপ আছে না— “আমার কত দিনের স্বপ্ন বিদেশের মাটিতে বাংলা থিয়েটার করব। ভ্যান্ডারবিল্ট থিয়েটার-এ ‘সীতা’ তো হল।”

তাঁর স্বপ্নের ‘সীতা’ হয়েছিল সত্যি। কিন্তু জাহাজে করে যে সব মালপত্র গিয়েছিল, সেগুলো ঠিক সময়মতো পৌঁছয়নি। অনেক অভিনেতাকে নিয়ে যেতে পারেননি। লোকজন ধার করতে হয়েছিল। তবু করে তো ছিলেন। সে বার ওই ‘গোত্রহীন’ করাটাও আমার কাছে তেমনই এক স্বপ্নপূরণের স্বাদ ছিল যেন। তা’ও আবার ছ’-সাতশো বাঙালির সামনে। এবং বিদেশের মাটিতে।

এমনিতে ‘গোত্রহীন’ আমার অসম্ভব পছন্দের। ডক এলাকার গল্প। সেখানে একজন নাবিকের বাড়িতে আসে দুই ভাই। আত্মীয়রই বাড়ি। ছোট ভাই এনায়েত আলি নীলু। আমি হতাম। আর আমার দাদা হেদায়েত আলি মনু। গৌতম হত। দুই ভাই-ই এদেশে এসেছে কাজের খোঁজে। দু’জন দুই মেরুর বাসিন্দা। আমরা যখন স্টেজে ঢুকতাম, একটা হইচই পড়ে যেত দর্শকদের মধ্যে।

তো, সে বার ফ্রিনজ্-এও তাই হল। বাঙালিরা তো উচ্ছ্বসিত। এমনিতেই বিদেশে হাততালিটা একটু বেশিই পাওয়া যায়। সাহেবদের দেশে এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। ওঁরা সব কিছুই জোরের সঙ্গে জানান দেন। আমেরিকায় প্রায় ১৪/১৫টা স্টেটে থিয়েটার করেছি। ইংল্যান্ড গেছিস সুইডেন, জার্মানি। এমনকী কানাডার টরেন্টো। সর্বত্র এক ছবি। সেদিন বোধ হয় আরওই। হাততালি যেন থামতেই চায় না।

নাটক শেষে একজন ইতালিয়ান ভদ্রলোকও এলেন। আমেরিকার বিখ্যাত সেই রাস্তা, ব্রডওয়ে, যেখানে সার সার থিয়েটার হল আছে, তারই একটা ‘নীল সাইমন থিয়েটার’, সেখানে ওঁরা এই একই নাটক আর্থার মিলারের ‘ভিউ ফ্রম দ্য ব্রিজ’ করছেন। উনি ওই থিয়েটারের প্রযোজক শুধু নন, এক উকিলের চরিত্রে অভিনয়ও করেন। যাঁকে দিয়েই নাটকের শুরু। ভদ্রলোকের মতে, দুই ভাইয়ের যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, সেটা না কি নান্দীকার-এরটাই তুলনায় অনেক ভাল লেগেছে তাঁর।

সব শুনে আমি তো বলতে গেলে আত্মহারা। খুব ইচ্ছে করছে, নীল সাইমন-এর থিয়েটারটা দেখি। কিন্তু জানি, ব্রডওয়ের টিকিটের অনেক দাম। অন্তত একশো ডলার। অত টাকা পাব কোত্থেকে?

আমাদের সৌভাগ্য, ওঁদের দল থেকে একটা সুবিধে করে দিয়েছিল। আর আমরাও তাতে পুরো টাকা না দিয়েও সবাই একসঙ্গে থিয়েটারটা দেখার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলাম। সেই প্রথম। ব্রডওয়েতে আমার থিয়েটার দেখা।

ওই দেখার অভিজ্ঞতাটাও বেশ অন্যরকম। একই নাটক, যেটা আমরা করছি, সেটাই আবার দেখছি ইংরেজিতে। সাহেবদের দেশে বসে।

দেখলাম। মুগ্ধও হলাম। তবে অহঙ্কার নয়, দেখে আমারও কিন্তু মনে হয়েছিল, সেই ইতালিয়ান ভদ্রলোকের কথাটাই সত্যি। অন্তত ওই যাত্রায় আমাদেরটাই ভাল মনে হয়েছিল আমারও। সেই ভাল লাগাটা যে কত বড় পাওয়া, বলে বোঝাতে পারব না।

সত্যি, থিয়েটার সাগরেরই মতোই। যা নেয়, তা বারবার ফিরিয়েও দেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন