আমাদের কাছে যিনি সুচিত্রা সেন, ওঁদের দু’জনের কাছে উনি ‘মাসি’। ওঁরা মিসেস সেনের অতি প্রিয় ছোট বোন রুণা ধরের দুই কন্যা। তবে শুধু মাসি বললে হয়তো ভুল বলা হবে। কখনও উনি তাঁদের সবচেয়ে কাছের মানুষ। কখনও তাঁদের মাতৃসমা। কখনও পার্ক স্ট্রিটে ঘুরতে যাওয়া বন্ধু। এই প্রথম তাঁরা মুখ খুললেন সংবাদমাধ্যমের সামনে।
সে দিন যখন তাঁদের বাড়িতে বসে কথা বলছিলেন তৃণা মজুমদার ও লগ্না ধর, বোঝাই যাচ্ছিল আজও মাসিকে কতটা মিস করেন তাঁরা। কথায় কথায় ওঁরা এমন কিছু বললেন, যা সুচিত্রা সেন সম্পর্কে আমরা আগে কোনও দিন শুনিনি।
আমায় ওই দু’টো গান শোনাও ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো’ আর ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’
তৃণা: এই বার এপ্রিল মাস পড়ার বেশ কিছু দিন আগে থেকেই গত বছরের ৬ এপ্রিলের কথা খুব মনে পড়ছে জানেন। ভেতরটা ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। গত বছরের এই দিনটায় আমরা মাসির বাড়িতে ছিলাম। মুনমুনদি সব খাবারদাবারের ব্যবস্থা করেছিল। ডলু (রাইমা) সবাইকে সার্ভ করছিল। সে দিন কেকও কাটল মাসি। দারুণ মুডেও ছিল। সে দিন অবশ্য আমাদের অন্য মাসিরাও এসেছিলেন। আমরা সবাই মিলে মাসির ঘরে বসেছিলাম। কেউ খাটে, কেউ মাটিতে। মাসি প্রায়ই আমার কাছে গান শোনার আবদার করত। সে দিনও আমাকে বলল, “বুবু, আমায় ওই দু’টো গান শোনা।” আমি বললাম কোন গান দু’টো মাসি? মাসি বলল, “ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’, আর ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’। সে দিন অনেক রাত পর্যন্ত গানের পর্ব চলল। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল মাসির ফেভারিট। ইন ফ্যাক্ট আমাদের বাড়িতে মামা, মাসিরা অসম্ভব আর্টিস্টিক ও ক্রিয়েটিভ। আমার মা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্রী ছিলেন সঙ্গীত ভবনে। আমাদের মামা, মানে অরুণ কুমার দাশগুপ্ত শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসুর ছাত্র ছিলেন।
লগ্না: তবে মাসি যে শুধুই রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনত, এমনটা নয় কিন্তু। আমার মনে আছে নাজিয়া হাসানের একটা গান ছিল, “বুম বুম... দিল বোলে বুম বুম।’ ওই গানটা যে মাসি কী ভালবাসত! আমাকে ছোটবেলায় খালি বলত, ‘বনি মা, তোর ওই বুম বুম গানটা গা।’ জগজিৎ সিংহের গানও খুব পছন্দ করত মাসি। আমি যখন আগের বছর বাবাকে (বারীন ধর) নিয়ে গুলজারের কাছে গিয়েছিলাম, তখন গুলজার সাবও মাসির গান শোনার গল্প বলছিলেন। তার পর হাসতে হাসতে এটাও বললেন, “সুচিত্রা সেন-কো সব আতা থা সির্ফ হিন্দি ছোড় কে।” (হাসি)
তৃণা ও লগ্না। ছবি: কৌশিক সরকার।
মাসির বাড়িতে কোনও দিন কোনও ফিল্ম ম্যাগাজিন দেখিনি
তৃণা: তবে আপনাদের কাছে ন্যাচারালি উনি সুচিত্রা সেন। কিন্তু আমাদের কাছে মাসি ছিল মাসি। একেবারে বাঙালি পরিবারে মাসিরা যেমন হয়, তেমন। আজও আমাদের মাসির মতো কেউ হবে না। দ্য এপিটোম অব ওম্যানহুড, এলিগ্যান্স অ্যান্ড বিউটি। এবং অসম্ভব ডিগনিটির সঙ্গে নিজেকে ক্যারি করা একজন মহিলা। আপনি বিশ্বাস করবেন না, আমরা ছোটবেলায় মাসির বাড়িতে মাসির কোনও পাসপোর্ট সাইজ ছবিও দেখিনি। ফিল্ম ম্যাগাজিন কি ফিল্ম নিয়ে আলোচনা তো অনেক দূরের ব্যাপার। এই সব ব্যাপারে মাসি অসম্ভব কনজার্ভেটিভ ছিল। আমরা জানতাম ফিল্মটা মাসির কাজের জায়গা। কিন্তু বাড়িতে সেটার প্রবেশ নিষেধ। আজ মাসির চলে যাওয়ার পর কত মানুষকে দেখি মাসি সম্বন্ধে কত কথা বলছে। শুনলে হাসি পায় জানেন... এদের মাসির বাড়ির গেট ক্রস করার ক্ষমতা ছিল না। আজ দেখি এরাই ‘বাইট’ দিচ্ছে।
লগ্না: আমরা দেখি আর হাসি। কী আর বলব বলুন!
চলেও গেল নাক উঁচু করে
তৃণা: ইনফ্যাক্ট, মাসি যখন বেঁচে ছিল, আমরা বলতাম জানো মাসি, এই ম্যাগাজিনে তোমার নামে এটা লিখেছে। বা ওই কাগজে তোমার ব্যাপারে এটা বলা হয়েছে। মাসি শুনে হাসত। বলত, “ছাড় ও সব। তোরা রাগ করিস না। কেউ তো করে খাচ্ছে।” মাসি ও সব নিয়ে ভাবতই না। শেষের দিকে শুনতাম কেউ কেউ বলছে, মাসি নাকি দেখতে খারাপ হয়ে গিয়েছিল বলে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। এর থেকে বড় ভুল কিছু হতে পারে না জানেন! যে দিন মাসি মারা গেল, মুনদি আমাকে বলল তুই একটু থাক হসপিটালে। আমি চেঞ্জ করে আসছি। সে দিন ওই ঘরে বসে মাসির মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু ভাবছিলাম এত সুন্দরী কেউ শেষ দিন অবধি থাকতে পারে! হাসিটাও একই রকম ছিল। দাঁতের সেটিংটাও পারফেক্ট ছিল। আর মাসির নাকটা বরাবরই খুব টিকোলো ছিল। সব সময় একটা হিরের নাকছাবি পরত মাসি। যখন চিতাতে রাখা হল মাসিকে, সব ঢাকা পড়ে গেল, শুধু নাকটাই দেখা যাচ্ছিল। সারা জীবন মাসি নাক উঁচু করে বাঁচল। চলেও গেল নাক উঁচু করে।
লগ্না: মাসির কোনও চেঞ্জ হয়নি মুখে। শুধু চুলটা পেকেছিল। মাসি এক সময় মেহেন্দি করত। কিন্তু কোনও দিন কালার করেনি চুলে। মাসি ও সবে বিশ্বাস করত না। আমরা কোনও দিন দেখিওনি মাসি পার্লারে যাচ্ছে কি সাজছে। কি বিউটিশিয়ানের সঙ্গে কথা বলছে। মাসির ও সবের দরকারই হত না। তবে হ্যাঁ, মাসি সব সময় চুলটা খুব স্টাইলিশলি কাটত। মাসি ওয়াজ সামথিং এলস্...
বালিগঞ্জ ধাবা থেকে চিকেন ভর্তা আর রুটি আনতে বলল মাসি
তৃণা: আর আমরা সাধারণ থেকে সাধারণ জিনিস করতাম মাসির সঙ্গে। কত বার খেতে গিয়েছি মাসির সঙ্গে...
লগ্না: সত্যিই তাই। কখনও ওয়ালডর্ফ-য়ে চাইনিজ, কখনও আউট্রাম ঘাটে। মনে আছে, আমরা দু’জনেই তখন ট্যুইশন করতাম। মাইনে পেতাম ১২৫ টাকা। একদিন ট্যুইশন থেকে মাসির বাড়ি গিয়েছি। মাসি বলল বাইরে থেকে খাবার কিনে আন। আজ খাওয়াদাওয়া হোক। আমরা হাঁটতে হাঁটতে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে যে ধাবা আছে, সেখান থেকে চিকেন ভর্তা আর রুটি কিনে আনলাম। সবাই মিলে খাওয়া হল। এ রকম যে কত বার হয়েছে! মাসি খাদ্যরসিক ছিল। কিন্তু নিজে খুবই অল্প খেত। মাসি অসম্ভব ভাল রাঁধত। কত দিন মাসি আমাদের জন্য ডিমের ডালনা রেঁধেছে। গরাস করে খাইয়ে দিয়েছে...
তৃণা: মাসির আর একটা ভালবাসার জিনিস ছিল। ফিশ ফ্রাই। মাসি খুব খুব ভালবাসত ফিশ ফ্রাই খেতে। আমরা প্রায়ই গিয়ে পিটার ক্যাট কী মোকাম্বো থেকে মাসির জন্য নিয়ে আসতাম। আর প্রিয় ছিল ফিশ ফ্রাইয়ের সঙ্গে ওই টার্টার সস।
মাসির ঠাকুরঘর ছিল বেলুড় মঠের ছোট সংস্করণ
তৃণা: ইলিশ মাছ ভাজা খেতেও খুব ভালবাসত। ইলিশের বিভিন্ন ডিশ সেই রকম ভাল রাঁধত। ইনফ্যাক্ট, ছোট বেলা থেকেই দেখেছি কোনও ছোট জিনিস করলেও সেটা নিখুঁত ভাবে, নিপুণ ভাবে করার চেষ্টা করত মাসি। একটা অদ্ভুত সৌন্দর্যবোধ ছিল। মাসির ঠাকুরঘর দেখলে পাগল হয়ে যাবেন আপনারা। মনে হবে বেলুড় মঠের ছোট সংস্করণ। কী সুন্দর পরিপাটি করে সাজাত মাসি। ছোটবেলায় দেখেছি প্রত্যেক দিন সন্ধেবেলা মাসি অনেকক্ষণ মেডিটেট করত দরজা বন্ধ করে। আমরা জানতাম ওই সময় মাসিকে ডিসটার্ব করতে নেই। কিন্তু কোনও কিছুতেই বাড়াবাড়ি ছিল না মাসির। খুব ভাল বাসত ফুল। কেউ ফুল পাঠালেই সেটা দিয়ে ঠাকুরঘরটা অসম্ভব যত্ন করে সাজাত।
লগ্না: মাসির ঘরটাও ছিল অসম্ভব ছিমছাম। একটাও নিজের ছবি ছিল না ঘরে। একটা বড় ড্রেসিং টেবিল ছিল, সেটায় ডলু (রাইমা), বুড়ি (রিয়া), মুনদি আর ভরতদার ছবি থাকত শুধু।
প্রেম করার সময় মাসিকেই প্রথম বলেছিলাম
তৃণা: মাসি মানুষটাই এমন ছিল। কোনও বাহ্যিক জিনিস পছন্দ করত না। শেষের দিকে তো অসম্ভব স্পিরিচ্যুয়াল হয়ে গিয়েছিল। পেটি সুপারফিসিয়াল ধ্যানধারণা থেকে অনেক অনেক উপরে চলে গিয়েছিল। অনেক উপরের আত্মা।
লগ্না: কিন্তু এত সবের মাঝেও আমাদের বন্ধুও ছিল মাসি।
তৃণা: সাঙ্ঘাতিক ভাল বন্ধু ছিল। আমি ছিলাম মাসির নেওটা আর লগ্না মানে বনি ছিল মুনমুনদির নেওটা। মনে আছে যখন স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে যাব, তখন একদিন মাসি আমার সঙ্গে আলাদা অনেকক্ষণ গল্প করল। মেয়েদের কী কী সমস্যা হয় মেডিক্যালি, রাস্তাঘাটে কী ভাবে নানা সিচ্যুয়েশন ট্যাকল করতে হয় সব বোঝাল। আজকে আমি যখন একজন ১৬ বছরের মেয়ের মা, তখন বুঝতে পারি কতটা দরকার ছিল ওই কনভারসেশনটা। মাসি তো আমাকে না বললেই পারত কিন্তু নিজে থেকেই বলল। আমি তো আমার মেয়ের থেকে বেশি ক্লোজ ছিলাম মাসির। যখন প্রেম করছি, তখন প্রথম মাসিকেই বলেছিলাম। (হাসি) কী ইয়ার্কি, ফাজলামো চলত মাসির সঙ্গে আমাদের! বাপ রে বাপ!
মাসির চোখ দেখেই বুঝতাম এটা মাসির পছন্দ নয়
লগ্না: তবে শুধুই যে ইয়ার্কি মারতাম, তা নয়। মাসির অসম্ভব একটা ব্যক্তিত্ব ছিল। মানে কোনও জিনিস যদি মাসির পছন্দ না হয়, তা হলে মাসির চোখ দেখেই আমরা বুঝে যেতাম। আর মাসি সেটা ঠিক বুঝিয়েও দিত। এটা সবচেয়ে ভাল বুঝত বোধহয় বাবা। বাবার সঙ্গে মাসির একটা অদ্ভুত সুন্দর আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। দারুণ জেল করত ওদের দু’জনের।
তৃণা: আমার বিয়ের ব্যাপারেও বাবাকে রাজি করিয়েছিল মাসি। আমার বরের সঙ্গে মাসির আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম আমাদের বিয়ের আগেই। বিয়ের পর পর যেমন সব বাঙালি বাড়িতে হয়, মাসি আমাকে আর আমার বরকে খেতে ডেকেছিল। নিজে হাতে সোনার আংটি তুলে দিল আমার বরকে। বাঙালি বাড়িতে যা যা রীতি-রেওয়াজ থাকে সেগুলো মাসি অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। এবং অসম্ভব একটা ডিউটি বোধ ছিল। সবার খোঁজ-খবর নিত মাসি, সবার ওপর নজর থাকত।
এখন তোমার বর হয়েছে, পর হয়েছি আমি
লগ্না: তবে আমার বরের সঙ্গে যে মাসির দেখা হল না, এটা আমার জীবনের হিউজ রিগ্রেট। মাসির সঙ্গে আমার শেষ কথা হয় বিয়ের দিন, মানে ১ ডিসেম্বর ২০১৩। তার পর আমরা আন্দামান চলে যাই। ফিরে এসে, যাচ্ছি যাব করেও আর যাওয়া হয়নি। তবে মাসি খুব মজা করত, একটা ফ্রেজ খুব প্রিয় ছিল মাসির। অনেককেই মাসি বলত কথাটা। ফ্রেজটা ছিল, ‘যখন তোমার কেউ ছিল না, তখন ছিলাম আমি... আজকে তোমার বর হয়েছে, পর হয়েছি আমি’। (হাসি) পয়লা ডিসেম্বরও যখন ফোন করেছি, হাসতে হাসতে মাসি আমাকেও ওই কথাটাই বলল। এ-ও বলল, “ঘুরে এসে জামাইকে নিয়ে এসো আমার কাছে।”
তৃণা: মানে, মাসিশাশুড়ি যেমন হয়, মাসি ঠিক তেমনই ছিল। কখনও বাড়ির সদস্যদের কাছে মাসি ‘সুচিত্রা সেন’ হয়নি। শেষ দিকে অসম্ভব বই পড়ত। টিভি প্রায় দেখতই না। মানে আমরা তো কোনও দিন মাসির বাড়ি গিয়ে মাসির সিনেমা দেখিনি। ও সবের ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিল মাসি। এক বছর পর যখন মাসির জন্মদিনটা আসছে, তখন খালি মনে হচ্ছে, ধুর্, আমাদের মাসি তো আর নেই। আমাদের গার্জেন যেন চলে গেল। আগের জন্মদিনেও যে মাসি কী দারুণ মুডে ছিল, এ বার সেই মানুষটাই নেই। আর আজকে যখন মাসির বাড়িতে যাই, মাসির ফ্ল্যাটের দিকে তাকালে মনে হয়, ওই ঘরটা থেকে এক্ষুনি মাসির সেই বিখ্যাত গলাটা শুনতে পাব। যেন শুনতে আর দেখতে পাই আমাদের দেখে সেই বিখ্যাত ঘাড়টা কাত করে মাসি বলবে, “কে, বুবু এসেছে? কে, বনিমা এসেছে...”
যেখানেই থাকো, ভাল থেকো মাসি।