শক্তির একটা কবিতার লাইন সে-দিন কে যেন মনে করালো, ‘আসলে কেউ বড় হয় না, বড়র মতো দেখায়!’
সত্যিই তো, মনের বয়সটা কি কখনও বুড়িয়ে যায়! সুনীলের আশি বছর বয়সটাকেও সত্যি বলতে আমার এখন তেমন কিছু বেশি বলে মনে হয় না।
আমি ওর থেকে সাত-আট বছরের ছোট। এখনও তো মাঝেমধ্যে ছোটবেলার, কলেজের কোনও বন্ধুর সঙ্গে দেখা বা কথাবার্তা হলে মনে হয়, ওই বয়সটাতেই আছি! কাউকে বলি না, কিন্তু মনে মনে টের পাই আমার মধ্যেও কিছু ছেলেমানুষি ঠিকই রয়ে গেছে।
সুনীলেরও কি তেমন কিছু ছিল? আড্ডা-হইহইতে মেতে থাকা লোকটাই যে সব নয়, তা তো বুঝতাম, ওর ভেতরের সেই বন্ধ দরজাটাও টের পেতাম যেখানে আর কারও প্রবেশাধিকার নেই, তবে জন্মদিনটা এলে শেষ দিকে ও কেমন ব্যস্ত হয়ে পড়ত। হয়তো আমেরিকায় আছি, সুনীল বলল, ৭ তারিখের আগে ফিরে যেতে হবে। অনেকে আসবে।
অথচ এই ষাট-টাট বছর বয়সেও ওর জন্মদিন পালন করা হচ্ছে ব্যাপারটা সুনীলের পছন্দ ছিল না। বলত, কী দরকার... এহ্ সক্কলে বয়স জেনে যাচ্ছে, বেশ তো সাতাশ-আঠাশে আটকে থাকতে পারতাম। পরের দিকে কিন্তু মেনে নিয়েছিল। আমাদের এই ফ্ল্যাট পুরো ভরে যেত। কত ফুল আর উপহার! বেশির ভাগই পাঞ্জাবি। আমি আগে ভাবতাম, জন্মদিনে ওকে কী দেব, তারপর মনে হত আর দিয়ে কী হবে!
তবু হয়তো আগে থেকে কিছু একটা এনে রাখলাম, জন্মদিন ভেবেই, কিন্তু কেউ হয়তো এল, বলল, এইটা পরিয়ে দিন, তখন সেটাই দিতাম।
কিন্তু নীললোহিতের মতো সত্যিই কি সাতাশে আটকে থাকে মানুষ?
সুনীল বলত, আসল কবিতা যা লেখার, কম বয়সেই লেখা হয়ে যায়। কবিতার মধ্যে জ্ঞান দেওয়া ঢুকে পড়া মানেই বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু ওর শেষ দিকের লেখা পড়ে সমরেশ মজুমদার একদিন ঠাট্টা করে বলেছিলেন, বউদি সুনীলদার হলটা কী? সুনীলদাও পাল্টে গেলেন! ওঁর লেখাতেও তো দেখি, ‘সব পাখি ঘরে আসা’-র টান। কে জানে, সবারই কি এমন হয়?
ইদানীং আমাদের বিয়ের আগের, কম বয়েসের সুনীলের কথা, ওর তখনকার ব্যবহার খুবই মনে পড়ে ঠিকই! কিন্তু বোধহয় বয়স হলে সম্পর্কে একটা অন্য রকম পরিণতি আসে।
বিয়ের পরে প্রথম পাঁচ-ছ’বছরের একটা দারুণ আকর্ষণ ছিল। হয়তো দশ-বারো বছর বাদেও একটা চার্ম আটকে রাখে। কিন্তু তখন রাগারাগি, ঈর্ষা, ঝগড়াঝাঁটিও অনেক বেশি। আমি অবশ্য অনেক বেশি বয়স অবধিও ঝগড়া করেছি, সব ছেড়েছুড়ে চলে আসতে চেয়েছি! ও মজা করে বলত, স্বাতী তো আমায় সাতশো বিরাশি বার ডিভোর্স করতে চেয়েছে। কিন্তু বয়স হলে এ সব কমে আসে। আমি ক্রমশ সুনীলকে অনেকটা বুঝতে পেরেছি।
কয়েকজন মেয়ে আমায় নিজেও বলেছে, সুনীল বড্ড দেহবাদী। ওরা ওই দিকটাই দেখেছে। একজন মানুষের অনেকগুলো দিক থাকে, কিন্তু সুনীলের যেটা গভীর দিক, তা ওদের বোঝার অবসর হয়নি।
আমি কারও নাম করছি না। কিন্তু কোনও কোনও মহিলার লেখক-স্বামীরা আমায় বলেছেন, তাঁদের স্ত্রীরা নাকি বাড়িতে গিয়ে বলেছে, সুনীলের সঙ্গে ওদের সাঙ্ঘাতিক প্রেম, এত...এই হয়েছে। কিন্তু সুনীল কখনও গর্ব করে আমায় এসব বলেনি।
আমার কাছে কিন্তু ও ঠিকই করেছে বলে মনে হয়েছে।
দেখুন, ক্রমশ একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি, সারা জীবন ওই ভাবে একনিষ্ঠ থাকা খুব সোজা নয়। মেয়েদের তা-ও অনেক রকম বাধা থাকে! কিন্তু সুনীলের মতো মানুষ, যে মেয়েদের এতটা মনোযোগ পেয়েছে, তার পক্ষে তো সেটা পুরোপুরি সম্ভব নয়! আমি হয়তো কিছু জিনিস আঁচ করে ওকে বলেছি! ও স্বীকার বা অস্বীকার করেনি! কিন্তু এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা পছন্দ করেনি।
এখন ভাবলে আমার কাছে এই দিকটা খুব আধুনিক বলে মনে হয়। এটা শুধু নিজের ব্যক্তিগত স্পেস নিয়ে সচেতনতা নয়, এর মধ্যে আর একজন মহিলার মর্যাদার প্রশ্নও রয়েছে।
আমার ক্ষেত্রে অবশ্য ঠিক এমনটা ঘটেনি, আমার কাউকে ভাল লেগে থাকলে ব্যাড়ব্যাড় করে সব ওকে বলে দিয়েছি। আমার জীবনের কিছু ওর অজানা নয়। এটা খুব বিরাট ব্যাপার আমি বলব না, তবে ওকে না বলে পারিনি। তবে সবাই তো আর সব সময় স্ত্রীর সঙ্গে সব কিছু শেয়ার করতে পারে না, হয়তো অন্য কোনও বন্ধুর সঙ্গে করেছে! কিংবা হয়তো ভেবেছে, আমি অশান্তি করব, তাই বলতে পারেনি।
তবে এ সবই আমি অনেক পরে বুঝেছি! কিন্তু শেষ দিকটায় আমাদের মধ্যে একটা চমৎকার বোঝাপড়া গড়ে উঠেছিল। মাঝেমধ্যে আমরা দু’জনে রাত্তিরে একসঙ্গে ড্রিংক নিয়ে বসতাম। মানে ও তো বসবেই। আর দু’জনে এক সঙ্গে বসলে ওর ভাল লাগবে--- এটা ভেবেই আমি নিয়মিত ওর সঙ্গে ড্রিংক করতাম। এখন ভাবলে হাসি পায়, ক-ত দিন ড্রিংক করি না! দুজনে মিলে বসে হয়তো টিভি দেখছি, দু-একটা কথা বলছি, বেশি কথা বলার দরকার নেই। তাতেই একটা কমিউনিকেশন হচ্ছে। এই জায়গাটায় পৌঁছনো হয়তো বেশি বয়েসেই সম্ভব।
এখন ওর কথা ভাবলে এই দিকগুলোই খুব মনে পড়ে। তবে একটা জিনিস আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। শেষ দিকটায় ও যেন কীরকম নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিল, ও আর সুস্থ হতে চায়নি। প্রস্টেটের একটা ছোট অপারেশন করিয়ে নিলে হয়তো আর কিছু বাড়াবাড়িই হত না। কিন্তু ও চাইল না। ও কিন্তু ভয় পায়নি, স্রেফ চায়নি। ওর আর একটা খুব বাজে দিক ছিল। হয়তো যে ডাক্তার ওকে দেখছেন, তাঁকে ওর খুব ভাল লেগে গিয়েছে। তিনি অসুস্থ হলেন। তখন ও আর অন্য কাউকে দেখাবে না। কিন্তু অসুখটা তো এভাবে ফেলে রাখলে বেড়ে যায়। অনেকেই বলে তাদের মনে হয়েছে, শেষটা ও যেন কিছুটা বুঝতে পেরেছিল, কী হতে চলেছে! কিন্তু আমার কেমন একটা বিশ্বাস ছিল কিছুতেই ও এখন চলে যাবে না। কেউ বললেও মানতে পারিনি!
আরও একটা কথা ভেবে খুব খারাপ লাগে। ও যদি গঠনমূলক সমালোচনার কাউকে পেত। দেখুন, অনেকেই সামনে খুব ভাল ব্যবহার করত, আমাকেও স্বাতীবৌদি, স্বাতীবৌদি করত। কিন্তু পিছনে আর এক রকম ছিল। এগুলো আমি টের পেয়েছি।
ওর থেকে ছোটরা অনেকে যেমন, শ্রীজাত, ওকে খুব ভালবাসত। ও-ও ওদের ছেলের মতো ভালবেসেছিল। ওদের দু’একটা দুষ্টুমিতে আমি হয়তো রাগ করেছি। কিন্তু সুনীল ক্ষমা করে দিয়েছে। তবে ওরা কি ওকে বোঝাতে পারে! সমবয়সিদের মধ্যে শ্যামল (গঙ্গোপাধ্যায়) বরং মাঝেমধ্যে কিছু বলত। খুব মজার মানুষ ছিল তো। বলত, চ’ সুনীল আমরা একটা কোম্পানি খুলি লাভ, লাভ অ্যান্ড লাভ। আবার সোজাসুজি সমালোচনাও করত।
আসলে ওকে নিয়ে তো কত রকম কথা শুনি, পড়ি। ওর লেখার কত সমালোচনা! কেউ সটান বলেছেন, হি ইজ নট মাই কাপ অব টি। কারওর ওর গদ্য সহ্য হত না, তো কেউ বলত ওর কবিতা ভাল নয়! এই যে ওর লেখা অনেকের ভাল লাগে, একটা টান থাকে, সহজে বোঝা যেত, সেটাও কারও কারও চোখে দুর্বলতা। ওটা নাকি কী যেন বলে...খুবই চিপ!
দেখুন, ওর লেখা নিয়ে আমারও মাঝেমধ্যে খুব রাগ হয়। কত লেখা কী ভীষণ তাড়াহুড়ো করে লিখেছে। তখন টাকারও দরকার ছিল। প্রতি বছর পুজোয় লিখতে হত যেমন শীর্ষেন্দু, মতি নন্দীরাও লিখতেন। কিন্তু অনেকে হয়তো বই হয়ে বেরোনোর আগে সংশোধন করতেন। ও সে-সব খুব কমই করেছে। বললে বলত, সব কি আর ভাল হয়, যা হবার হয়ে গেছে! আমার এখনও পড়তে গিয়ে আফশোস হয়, কে কী ভাবল, আবার কে কী বলবে।
দেখুন, সত্যিই ও লেখার সময় কম পেয়েছে। দুপুরেও নিস্তার নেই। নিজের ছাড়া অন্য কত লোকের লেখা নিয়েও বসতে হত। যদি কয়েক বছর লেখা বন্ধ রেখে ফের লিখতে পারত!
কিছু ভাল লেখাও তো এর মধ্যেই হয়েছে। ওর সব বই এখন আমি শোওয়ার ঘরটায় সরিয়ে নিয়ে গেছি। আগে বাইরে থাকত। আমার কাছে মোটামুটি সবই আছে, একসঙ্গে দুটো পাবলিকেশন থেকে বেরনো বইয়ের কপিও। কিন্তু সুনীলের কাছে কেউ চাইলে, ও কাউকে না কাউকে দিয়ে দিত। আমি খুব রাগ করতাম। বলতাম, এগুলো আর তোমার নয়, আমার বই হয়ে গেছে।
এখন সব আবার করে পড়ছি। কখনও ভাল লাগছে, কখনও বা খানিকটা কাঁচা...বাঁ হাতে লেখা মনে হচ্ছে।
ও বলত, পূর্বপশ্চিম-এর মমতা চরিত্রটির মধ্যে না কি আমি আছি! এটা আমার তখন পছন্দ হয়নি, মমতাকে আমার বড্ড আড়ালের মনে হয়েছিল। আমি কি ওরকম? এখন ভাবছি আবার পুরোটা পড়ব।
তবে বিখ্যাত বইয়ের বাইরেও ওর কত কী লেখা উল্টেপাল্টে দেখি! যেমন কাশ্মীরের এক পুরোনো রাজাকে নিয়ে জয়াপীড়। সমস্যাটা যেহেতু পুরোনো, ও ভাষাটাও সেই রকম করার চেষ্টা করেছিল। মুসলমান সুলতানরা এ দেশে আসার আগের ভাষা। আবার ‘আমিই সে’ কিংবা ‘সোনালি দুঃখ’ আমার খুব প্রিয়।
সোনালি দুঃখ-র কথা খুব মনে হয়। ইউরোপের ত্রিস্তান আর ইসল্টের কাহিনি নিয়ে। কারিগর থেকে বেরিয়েছিল। বইটা তেমন প্রচার পায়নি বলে আমার দুঃখ হয়। অনেকটা রাধাকৃষ্ণ-র মতো লেখা! ওটা পড়ে মুজতবা আলী ওকে চিঠি লেখেন, বলেন, সোনালি দুঃখ আমার বেডসাইড টেবিলে রেখেছি। এটা শুনে কত ভাল লাগে, বলুন!
লেখা নিয়ে ও হয়তো কখনও কম্প্রোমাইজও করেছে, তবু আমি একটা কথা বলব, ও কিন্তু মানুষ হিসেবে আরও অনেক বড় মাপের। কখনও কারও বিষয়ে একটা খারাপ কথা বলা, কারওর ক্ষতি করা ওর ধাতে নেই। দেখুন, বুদ্ধদেব বসুর বিষয়ে অনেককে বলতে শুনেছি, উনি অসাধারণ মানুষ ছিলেন। যত বড় লেখক তার থেকেও বড় মানুষ। এটা সুনীলকে নিয়েও আমার মনে হয়।
আর ততই ওর এখনকার না-থাকাটা আমার অসহ্য লাগে। বাড়িতে অনেকের ভিড়, আমার তার মাঝেও একা গিয়ে বারান্দায় বসতে ইচ্ছে করে। হয়তো বৃষ্টি পড়ছে। ও কি একবার আসবে?
মাস তিনেক আগে শিরদাঁড়ায় একটা সিরিয়াস অপারেশন হয়েছে আমার। এখন ধরে-ধরে অল্পস্বল্প হাঁটি। পুরোটা সারতে হয়তো এ বছরটা লেগে যাবে।
তবু মনে হয় সব্বাইকে লুকিয়ে শান্তিনিকেতন চলে যাই। দোতলার যে ঘরটায় আমরা শুতাম, জানলার পাশ দিয়ে একটা পুকুর দেখা যেত। তাতে ভেঙে ভেঙে চাঁদের ছায়া পড়ত। ওর লেখার টেবিল থেকেও তা দেখতে পেত। ও কবিতায় লিখেওছিল, দোলে চন্দ্রমা...চন্দ্রমা...ধুর, আমার তো প্রথম লাইনটা মনে পড়ে না...
আমার বোনেরা, আত্মীয়-বন্ধুরা এখন আমায় আগলে রেখেছে। কিন্তু আমার মনে হয় একা একা গিয়ে ওই ঘরটায় শুয়ে থাকি। দেখুন, আমি আজকাল কোনও স্বপ্নই প্রায় দেখি না। ভাল ভাবে ঘুমই হয় না। তবু ভাবি শান্তিনিকেতনে একলাটি গেলে হয়তো অনুভব করতে পারব, ও এল। আবার মনে হয়, ওর যেরকম ভূত-টুতে ঘোর অবিশ্বাস ছিল, তাতে যদি মৃত্যুর পরে কোনও অস্তিত্ব থেকেও থাকে ও কক্ষনও আমাকেও দেখা দেবে না।
একবার বলেছিলাম ওকে আবার বিয়ে করতাম কি না ঠিক নেই। সে তো বিয়ে ব্যাপারটাই ভবিষ্যতে ঠিক এরকম থাকবে কি না সন্দেহ! কী সব ওপেন ম্যারেজ-ট্যারেজ শুনি--- হয়তো মেলামেশা, সেক্স নিয়ে ধ্যানধারণাও পাল্টে যাবে। আগে মহাভারতের যুগেও তো বিয়ে ঠিক এ রকম ছিল না। পরেও কেমন থাকবে ঠিক নেই।
আজকাল অসুখের জন্য মনটা খুব দমে গিয়েছে। তবু মনে হয় ওর সঙ্গে আমার এখনও অনেক কথা, অনেক কিছু শেয়ার করা বাকি থেকে গিয়েছে।