• একটি ফ্ল্যাট কেনার জন্য বিল্ডারের সঙ্গে এগ্রিমেন্ট করেছিলাম। ফ্ল্যাটের দাম ২২ লক্ষ টাকা। ৭ লক্ষ টাকা অগ্রিম বাবদ বিল্ডারকে চেক মারফত দিই। বাকি ১৫ লক্ষ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওই প্রজেক্টের সব কাগজপত্র দেখে ব্যাঙ্ক সন্তুষ্ট না-হওয়ায় (বা প্রজেক্টের সব কাগজ ঠিকঠাক না-থাকায়) ব্যাঙ্ক ঋণ দিতে রাজি হয়নি।
এর পর স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল অফিস থেকে জানতে পারি, আদালতের নির্দেশে (জমি সংক্রান্ত সমস্যার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকায়) ওই প্রজেক্টের কাজ আগে থেকেই আটকে দেওয়া হয়েছে। যদিও আমাকে সে-সব না-জানিয়েই বিল্ডার এগ্রিমেন্ট সই করান। এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ফ্ল্যাটের দখল দেওয়ার কথা ছিল। বহু বার টাকা ফেরত চাওয়ায় প্রোমোটার একটি ১ লক্ষ টাকার ও তিনটি ২ লক্ষ টাকার চেক দেন। তার মধ্যে ওই ১ লক্ষ টাকার চেকটি ক্লিয়ার হয়েছে, কিন্তু বাকি তিনটি বাউন্স করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে এর পর পুলিশে ডায়েরি-সহ বিভিন্ন আইনি ব্যবস্থাও নিয়েছি। কিন্তু কোনও উপকার হয়নি। টাকাও ফেরত মেলেনি। এই অবস্থায় আমার কী করণীয়? কোন পথে এগোলে সুবিধা হবে যদি জানান।
বিক্রম সেনগুপ্ত, কলকাতা
এই সমস্যায় ভুগছেন বহু মানুষই। আপনি তা-ও বিভিন্ন আইনি পদক্ষেপ করেছেন। অনেকে সেটুকুও করেন না। আপনার চিঠি নিয়ে আলোচনা করলে তাঁরা সবাই উপকৃত হবেন। সে ভাবেই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।
প্রথমে বলব, আপনি বিল্ডারের সঙ্গে যে-এগ্রিমেন্ট করেছিলেন, সেটি ‘রেজিস্টার্ড’ ছিল, না কি ‘আনরেজিস্টার্ড’? বেশির ভাগ সময়ে আমরা ১০ টাকার স্ট্যাম্প পেপারের উপর এগ্রিমেন্ট করে বিল্ডারকে বহু লক্ষ টাকা অগ্রিম দিয়ে থাকি। অনেকে আবার আইনজীবীর পরামর্শও নিতে চান না। নিজেরাই ১০ টাকার স্ট্যাম্প পেপারে টাকা দিয়ে শুধু মাত্র ‘রিসিভ’ করিয়ে নেন। আইনি ঝামেলা এড়াতে চান আর কী! তবে জানিয়ে রাখি, এই ধরনের ‘আনরেজিস্টার্ড’ কাগজের ক্ষেত্রে আইনি সাহায্য পাওয়াও কঠিন। তাই আজকাল বলা হচ্ছে, ‘এগ্রিমেন্ট’টাও রেজিস্ট্রি করে রাখতে।
দ্বিতীয়ত, ব্যাঙ্ক কাগজপত্র দেখে সন্তুষ্ট না-হওয়ায় আপনার ঋণ বাতিল করল। কিন্তু আপনি কি ওই প্রজেক্টের যাবতীয় কাগজপত্র দেখে নেননি? যে প্রজেক্টে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনতে যাচ্ছেন, তার যাবতীয় কাগজপত্র খতিয়ে দেখা আপনারও কর্তব্য ছিল। কিন্তু আফসোস, কাগজপত্র সব খতিয়ে না-দেখেই অগ্রিম বাবদ ৭ লক্ষ টাকা বিল্ডারকে দিয়ে ফেলেছেন।
তা ছাড়া, য- বিল্ডারের থেকে ফ্ল্যাট বা বাড়ি কিনবেন, তার সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নেওয়া উচিত। যেমন আগে ক’টি প্রজেক্ট করেছেন? সেগুলি সম্পর্কে মানুষের মতামত কেমন? বিল্ডারের নামে কোনও মামলা আছে কি না? যে প্রজেক্টে ওই বিল্ডার কাজ করেছেন, সেগুলির বর্তমান অবস্থা কেমন? এই সব বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তবেই বিল্ডারকে অগ্রিম দিন। মনে রাখবেন, বিল্ডাররা সব সময়েই একটা তাড়াহুড়োর ভাব দেখান, যেন আপনি না-কিনলে এখনই ওই বাড়ি বা ফ্ল্যাটটি অন্য কেউ কিনে নেবেন। মনে রাখুন, পছন্দসই ফ্ল্যাট বা বাড়ি খুঁজলে আরও পাওয়া যাবে, কিন্তু টাকা একবার বেরিয়ে গেলে তা উদ্ধার করা খুবই কঠিন।
তৃতীয়ত, আশ্চর্য ব্যাপার, আদালতের নির্দেশে ওই প্রজেক্টের কাজ আটকে গিয়েছে, আর আপনি জানতেন না! না-জেনেই ওই প্রজেক্টে ৭ লক্ষ টাকা অগ্রিম দিয়ে ফ্ল্যাট বায়না করে দিলেন! অনেক সময়েই আমরা দেখি যে, শরিকি ঝামেলায় অথবা প্রতিবেশীরাও আদালত থেকে ‘ইনজাংশন’ নিয়ে আসেন এবং প্রজেক্টের কাজ আটকে দেওয়া হয়। এ জন্য আমি সবাইকেই পরামর্শ দেব কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখুন। কর্পোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটি বা পঞ্চায়েত অফিসে ওই প্রজেক্ট সম্পর্কে খোঁজ নিন। পাশাপাশি, আদালতেও ওই প্রজেক্ট সম্পর্কে ‘সার্চ’ করে জেনেন নিন, যেখানে আপনি বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনতে যাচ্ছেন, তা নিয়ে আদালতে কোনও মামলা ঝুলে নেই তো?
চতুর্থত, এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী যে-সময়ে ফ্ল্যাট ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল, সেই সময়ও পার হয়ে গিয়েছে। দেখুন, আজ যদি আপনার এগ্রিমেন্ট রেজিস্টার্ড হত, তা হলে আপনি চট করে আইনি সুবিধা নিতে পারতেন। বিল্ডারদের বেআইনি কাজকর্মে রাশ টানতে নতুন একটি আইনও এসেছে— দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল বিল্ডিং (রেগুলেশন অব প্রোমোশন অব কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ট্রান্সফার বাই প্রোমোটারস) অ্যাক্ট, ১৯৯৩। প্রয়োজনে বিল্ডারদের বিরুদ্ধে আইনের এই সুযোগ নেওয়া যায়।
পঞ্চমত, বিল্ডারের দেওয়া যে -চেকগুলি বাউন্স করেছে, সেগুলির জন্য ‘নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট’-এ আপনি আদালতেও মামলা করতে পারেন।
এ বার বলি, প্রজেক্ট সম্পর্কে আদালতে যে-স্থগিতাদেশ রয়েছে, আপনাকে তা না-জানিয়েই বিল্ডার আপনার সঙ্গে এগ্রিমেন্ট করে টাকা নিয়েছে ও বার বার আপনাকে ঘোরাচ্ছে। এটি প্রতারণার নামান্তর। তাই আপনি বিল্ডারের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করতে পারেন। এ ছাড়া পুলিশি সাহায্য তো আপনি প্রার্থনা করেছেনই। তাঁরাও আপনাকে সাহায্য করছেন বলেই মনে হয়।
• সত্তর ছুঁইছুঁই বড়দা অবিবাহিত, চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত এবং একটি ছোট বাড়িতে থাকেন। বাড়িতে দ্বিতীয় মানুষ বলতে আছে একজন মধ্যবয়স্কা পরিচারিকা।
ওই বাড়ির মালিকানা দাদা আর মায়ের। এক রেজিস্ট্রিকৃত দলিলের মাধ্যমে তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। মা মারা গিয়েছেন। দাদা বাদে মায়ের উত্তরাধিকারী হলেন আমরা আরও তিন ভাই। বাড়িতে ওই পরিচারিকা দীর্ঘ দিন থাকার আর দাদাকে দেখাশোনা করার সুবাদে তার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করার সুযোগ পেয়েছেন। এমনকী তিনি রেশন কার্ডের ঠিকানাও তাঁর কলকাতা-লাগোয়া জেলাশহরের বাসস্থান থেকে দাদার বাসস্থানে বদল করে নিয়েছেন। তিনি বিবাহিতা, হিন্দু। আর তাঁর স্বামী ও প্রাপ্তবয়স্কা কন্যাও বর্তমান।
আমার প্রশ্ন:
১) দাদা কি একক ভাবে ওই বাড়ির ঠিকানা বাইরের কাউকে ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারেন?
২) ওই ঠিকানায় রেশন কার্ড থাকায় পরবর্তী কালে (দাদার অবর্তমানে) ওই পরিচারিকা দাদা-মায়ের যৌথ সম্পত্তিতে কোনও রকম অধিকারের দাবি তুলতে পারেন কি?
৩) যৌথ সম্পত্তির ঠিকানায় পরিচারিকার রেশন কার্ডের আইনি বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ কি মায়ের (দাদা ব্যতীত) অন্য উত্তরাধিকারীদের আছে?
৪) ওই পরিচারিকার রেশন কার্ডের বিস্তারিত তথ্যাবলি কি সংশ্লিষ্ট এলাকার রেশনিং অফিসারকে সাধারণ চিঠি লিখলেই পাওয়া যাবে, না কি তথ্য জানার অধিকার আইনের সহায়তা নিতে হবে?
অনুপম শেঠ, কলকাতা
আপনার প্রশ্ন বিস্ময়কর কিছু নয়। দীর্ঘ দিনের পরিচারিকা বা দারোয়ানকে নিয়ে এই ধরনের সমস্যা দেখা যায়। আপনার উত্তরে বলব—
১) পরিচারিকা মহিলাটি আপনার বাড়িতে দীর্ঘ দিন ধরে এবং স্থায়ী ভাবে বসবাসের সুবাদে রেশন কার্ডে ওই ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। তবে অবশ্যই আপনার দাদা বিষয়টি জানেন এবং তাঁর অনুমতিতেই এই ঠিকানা বদল ঘটেছে।
একক ভাবে আপনার দাদা ওই পরিচারিকার রেশন কার্ডের ঠিকানা বদলের অনুমতি দিতে পারেন কি পারেন না, এত দিন বাদে সে প্রশ্ন তোলা অমূলক। কিন্তু আপনারা সত্যি সত্যিই ওই বাড়িতে উত্তরাধিকারী হলে আপত্তি নিশ্চয়ই করতে পারতেন। এখনও পারেন। কাজেই এখনই ওঁর রেশন কার্ডের ঠিকানা বদলের দাবি জানিয়ে আপনার এলাকার রেশনিং অফিসারকে চিঠি দিয়ে রাখুন। আশা করি, ওই পরিচারিকা আপনাদের ওই বাড়ির ঠিকানায় ভোটার কার্ড বা আধার কার্ড বানিয়ে ফেলেননি। তা বলে আপনাদের ভবিষ্যতে আরও বড় সমস্যায় পড়তে হতে পারে।
২) রেশন কার্ডে বাড়ির ঠিকানা থাকার সুবাদে উনি কোনও মালিকানা স্বত্ব দাবি করতে পারবেন না। কিন্তু দীর্ঘ দিন বসবাসকারী হিসেবে বা দীর্ঘ দিনের দখলদার হিসেবে তিনি একটা অধিকার দাবি করতেই পারেন। সবচেয়ে বড় কথা, আপনার দাদার অবর্তমানে তিনি বাড়ি ছাড়তে অস্বীকার করতে পারেন বা আপনাদের বিপদে ফেলতে পারেন।
৩) যৌথ সম্পত্তি সংক্রান্ত যে-কোনও বিষয়েই আপনারা তিন ভাই (বর্তমান উত্তরাধিকারী দাদা ছাড়াও) নিশ্চয়ই সমান ভাবে অধিকারপ্রাপ্ত। ওই বাড়িতে আপনাদের অধিকার থাকার দরুন এবং সম্পত্তি অবিভক্ত বলে আপনারা যে-কোনও ব্যাপারেই চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। তবে আগে আপনারা উত্তরাধিকার বলে ওই বাড়ির অংশ নিজেদের অধিকারে আনুন এবং তার পরে পরিচারিকাকে উচ্ছেদের ব্যাপারে পদক্ষেপ করুন।
৪) রেশন কার্ডের বিস্তারিত প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে তথ্য জানার অধিকার আইনের সাহায্য নিতে পারেন। তবে সত্যি বলতে কী, আসল সমস্যা হতে পারে ওই পরিচারিকাকে উচ্ছেদের সময়। তিনি যদি উঠতে না চান, আপনারা তো আর জোর করে তুলে দিতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে তখন আপনাদের আইনের আশ্রয় নিতেই হবে।
পরামর্শদাতা: আইনজীবী জয়ন্ত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়