নজর রাখুন লগ্নি কোথায়

শুধু ন্যাভের নাড়ি টিপে ফান্ড বাছবেন না। সঙ্গে পরখ করুন তার ধরন। খোঁজ নিন, কোথায় ঢালা হচ্ছে তার তহবিলের টাকা। ফান্ডগুলির চরিত্র একে অন্যের থেকে আলাদা কি না, গোড়াতেই তা যাচাই করা ভাললগ্নির আগে শুধু ফান্ডের নাম, রিটার্ন, ন্যাভ জানাই যথেষ্ট নয়। সেই ফান্ড শেষমেশ কোথায় টাকা ঢালছে, তা জানাও ভীষণ জরুরি। এই কথা শুধু ইকুইটি ফান্ড নয়, মাথায় রাখা উচিত সব ধরনের ফান্ডের ক্ষেত্রেই।

Advertisement

নীলাঞ্জন দে

শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:২৯
Share:

শেষে এই! এত ভেবেচিন্তে, এত হিসেব কষে মিউচুয়াল ফান্ডে টাকা রেখেছিলেন অশোকবাবু। নিজের সাধ্যমতো। অল্প অল্প করে। এক ঝুড়িতে সব ডিম না-রেখে লগ্নি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিভিন্ন ফান্ডে। লক্ষ্য ছিল দু’টি—

Advertisement

১) ভবিষ্যতের সম্ভাব্য নানা মোটা বা মাঝারি খরচের জন্য তহবিল তৈরি।

২) টাকা বিভিন্ন ফান্ডে ছড়িয়ে দিয়ে লগ্নির ঝুঁকি কমানো।

Advertisement

কিন্তু তা হল কই? মাঝে হঠাৎই গোঁত্তা খেয়ে পড়ল শেয়ার বাজার। গেল-গেল রব উঠল কয়েকটি শিল্পে। আর চোখের সামনে চুপসে গেল তাঁর তহবিল। যেন এক সঙ্গে খারাপ রিটার্ন দিতে শুরু করল সমস্ত ফান্ড।

সমস্যা কোথায়?

কারণ খুঁজতে বন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় বসলেন অশোকবাবু। বললেন, ফান্ডে টাকা ঢালার আগে তিনি বারবার দেখেছিলেন তাদের নাম, রিটার্নের ইতিহাস, ন্যাভের ওঠা-পড়া, ফান্ড ম্যানেজারের সুনাম ইত্যাদি। তা হলে এমন হল কেন?

বন্ধুর জবাব ছিল, মেয়ের বিয়ের আগে তুই পাত্রের রোজগার, পরিবার সব দেখেছিস। কিন্তু চরিত্র জানিসনি। সেটাই সমস্যা। অশোকবাবু বিভিন্ন ফান্ডে টাকা ঢেলেছেন। কিন্তু দেখেননি সেগুলি একই ধরনের বা একই চরিত্রের কি না। এমন তো হতেই পারে যে, আপনি বিভিন্ন সময়ে পাঁচটি আলাদা ইকুইটি ফান্ডে লগ্নি করলেন এই আশায় যে, তারা ভাল রিটার্ন দেবে। সঙ্গে পেলেন কিছুটা নিশ্চিন্তি। কারণ, বাজারের খারাপ সময়ে এক-দু’টি ফান্ড যদি ডোবায়ও, তবে রিটার্নের তরী পার করে দেবে বাকিগুলি। ভরাডুবি হবে না।

আসলে এ সব ক্ষেত্রে লগ্নিকারী ভাবেন, তিনি টাকা ঢেলেছেন পাঁচটি আলাদা ফান্ডে। কিন্তু বাস্তবে হয়তো ওই ফান্ডগুলি লগ্নি করছে মূলত একই সংস্থায় কিংবা একই শিল্পের বিভিন্ন সংস্থায়। সে ক্ষেত্রে বিপদ। কোনও কারণে শেয়ার বাজারে সেই শিল্পের হাল খারাপ হলে, মার খাবে ৫ ফান্ডই।

তা হলে?

লগ্নির আগে শুধু ফান্ডের নাম, রিটার্ন, ন্যাভ জানাই যথেষ্ট নয়। সেই ফান্ড শেষমেশ কোথায় টাকা ঢালছে, তা জানাও ভীষণ জরুরি। এই কথা শুধু ইকুইটি ফান্ড নয়, মাথায় রাখা উচিত সব ধরনের ফান্ডের ক্ষেত্রেই। মনে রাখবেন, লগ্নি ছড়িয়ে দেওয়ার মানে শুধু বেশি সংখ্যক ফান্ডে টাকা ঢালা নয়। বরং বেশি ধরনের ফান্ডে বিনিয়োগ। দরকার লগ্নির ঝুড়িতে এমন সমস্ত ফান্ডকে এক সঙ্গে রাখা, যারা চরিত্রের দিক থেকে একে অন্যের চেয়ে আলাদা। পৃথক তাদের বেছে নেওয়া শিল্প ক্ষেত্র ও সংস্থা। তাই ফান্ডে সাবধানী ইনিংস খেলে বড় রিটার্নের মুখ দেখতে পুনরাবৃত্তি আটকানো খুব জরুরি। আসুন বিষয়টি একটু বিশদে বোঝার চেষ্টা করি।

ফান্ডের ফান্ডা

ফান্ড মূলত দু’ধরনের—

ইকুইটি ফান্ড— এর তহবিলের বেশিরভাগটাই খাটে শেয়ারে। বাজারে সংস্থার শেয়ার মূল্যের (মার্কেট ক্যাপ) নিরিখে সংস্থাগুলিকে আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। লার্জ ক্যাপ, মিড ক্যাপ, স্মল ক্যাপ ইত্যাদি। যে-ফান্ড যে-ধরনের সংস্থার শেয়ারে লগ্নি করে, তাদের নাম ঠিক হয় সে ভাবেই। ইকুইটি ফান্ডের আওতায় রয়েছে ডাইভার্সিফায়েড, ইন্ডেক্স, সেক্টর ফান্ড ইত্যাদিও।

ডেট ফান্ড— এটির বেশির ভাগ লগ্নি যায় বিভিন্ন ধরনের ঋণপত্রে। তা সরকারি বা কোনও কর্পোরেট সংস্থার হতে পারে। এর মধ্যে আছে জি-সেক ফান্ড, লিকুইড ফান্ড প্রভৃতি।

টাকা যাচ্ছে কোথায়?

নিজের প্রয়োজন, ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি মেপে প্রথমেই ঠিক করে নিতে হবে কোন ধরনের ফান্ডে টাকা ঢালতে চান আপনি। তারপরে অবশ্যই খোঁজ নিতে হবে প্রাথমিক ভাবে বাছাই করা ফান্ডগুলির ন্যাভ, অতীত রিটার্ন, সংস্থা ও ফান্ড ম্যানেজারের সুনাম ইত্যাদি। কিন্তু আমার পরামর্শ হল, শুধু এখানে দায়িত্ব শেষ মনে করলে চলবে না। বরং খতিয়ে দেখতে হবে, তাদের তহবিল খাটছে কোথায়। কোন সংস্থার শেয়ার কিংবা কোন ঋণপত্রে?

এর দু’টি সুফল আছে। প্রথমত আদৌ আপনি কোনও ফান্ড কিনবেন কি না, এতে সেই সিদ্ধান্ত আরও ভাল ভাবে নেওয়া সুবিধাজনক হবে। দ্বিতীয়ত, আপনি পরখ করে নিতে পারবেন যে, ওই একই সংস্থা বা শিল্পে আপনার আগে কেনা কোনও ফান্ডের তহবিলের মোটা টাকা খাটছে কি না। এড়াতে পারবেন পুনরাবৃত্তি।

আইডিএফসি প্রিমিয়ার ইকুইটি এবং আইডিএফসি স্টার্লিং ইকুইটি ফান্ড দু’টির কথাই ধরুন। এদের নাম আলাদা। কিন্তু দু’জায়গাতেই লগ্নির গন্তব্য হিসেবে মিড ক্যাপ শেয়ারের পাল্লা ভারী। দু’টি ফান্ডে ইউনিট তবেই কিনুন, যদি মিড ক্যাপে বাড়তি ঝুঁকি নিয়েও বেশি রিটার্ন লক্ষ্য হয়। কিন্তু লগ্নি ছড়িয়ে দেবেন মনে করলে, একসঙ্গে দু’টিতে টাকা না-ঢালা ভাল।

তবে এখানে বলে রাখি, এদের নাম নেওয়া কিন্তু শুধু উদাহরণ দিতে। এটি আমার কোনও পরামর্শ নয়। শেষ সিদ্ধান্ত একান্তই আপনার।

দেখার পদ্ধতি

প্রাথমিক ভাবে যে-ফান্ডগুলি আপনার পছন্দ, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে তার তালিকা নিয়ে বসুন। দেখে নিন, সেগুলি কোন কোন শিল্পে লগ্নি করছে। যাচাই করুন, সব ক’টি ফান্ডই এক ধরনের শিল্পকে বেছে নিচ্ছে কি না। আপনার আগে কেনা যে-সমস্ত ফান্ড রয়েছে, তার সঙ্গেও এর টাকা ঢালার জায়গা আলাদা তো?

তহবিল শুধু ছড়ানো কি না, দেখলে চলবে না। দেখতে হবে কোন শিল্পের অংশীদারি কত। আর ডেট ফান্ডের ক্ষেত্রে দেখুন টাকা খাটছে কোন ধরনের ঋণপত্রে।

বিভিন্ন ফান্ড সংস্থার ওয়েবসাইটেই এই সমস্ত তথ্য পাওয়া যায়। চাইলে এজেন্ট ও বিশেষজ্ঞের কাছে বিস্তারিত তথ্য চাইতে পারেন।

শুধু শিল্প ক্ষেত্র খেয়াল করলেও হবে না। দেখতে হবে ফান্ডের তহবিল খাটছে কোন কোন সংস্থায়। তাদের ইতিহাস একটু ঝালিয়ে নিন। লগ্নির জন্য সংস্থা বাছাই আপনার হাতে নেই। তা ফান্ড ম্যানেজারের সিদ্ধান্ত। কিন্তু কোন ফান্ড বাছবেন, তা তো আপনাকেই ঠিক করতে হবে।

মনে হতে পারে, ভাল সংস্থার সংখ্যা হাতে গোনা। তা হলে সেখানে তো একাধিক বার তহবিল খাটবেই। ঠিক কথা। কিন্তু আপনার লক্ষ্য হওয়া উচিত সেই পুনরাবৃত্তি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা।

যদি ইতিমধ্যেই একই ধরনের ফান্ডে একাধিক বার টাকা ঢেলে থাকেন, তবে সেগুলির রিটার্ন বিচার করুন। প্রয়োজনে এক ফান্ড থেকে টাকা সরিয়ে অন্যটিতে রাখুন।

ফান্ড লগ্নির কৌশল হামেশাই বদলাতে থাকে। ফলে পরেও কিন্তু তহবিলের টাকা কোথায় ঢালা হচ্ছে, তা খেয়াল রাখা জরুরি।

দু’য়ের মধ্যে কোনটি?

এ বার মনে করুন দেখলেন, দু’টি ফান্ডের চরিত্র এক। তারা টাকা ঢালে মোটামুটি একই রকম জায়গায়। তা হলে কী ভাবে বাছবেন একটিকে?

এ ক্ষেত্রে তাদের পরিচালন ব্যবস্থা, অতীত রিটার্ন, ন্যাভ সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখুন।

একই গোত্রের অন্যান্য ফান্ডের বিচারে আপনার বেছে নেওয়াটি কোথায় দাঁড়িয়ে, সেটাও নজর রাখা প্রয়োজন। যেমন, বাজারে বিভিন্ন সংস্থার মিড ক্যাপ ফান্ড আছে। কোনটি কেমন রিটার্ন দিচ্ছে, তা-ও বিচার করতে হবে আপনাকে।

আমার লাভ?

উপরের কথাগুলি মাখায় রাখলে, কয়েকটি সুবিধা হবে। যেমন—

লোকসানের ঝুঁকি কমবে। ফান্ডে যত বৈচিত্র্য থাকবে, ঝুঁকি তত কম।

সুবিধা হবে ফান্ড বাছাইয়ে। কোনও এক ধরনের ফান্ডে বেশি লগ্নি হয়েছে বুঝলে, পরের বার সে পথে পা বাড়াবেন না আপনি।

কমবে খরচও। কারণ, বেশিরভাগ ফান্ড সংস্থাই তহবিল পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট পরিষেবা খরচ নেয়। ফলে আলটপকা একগুচ্ছ একই রকম ফান্ডে টাকা ঢেলে তা বাড়ানোর মানে নেই।

শেষ পাত

ফান্ড দুনিয়ার অন্যতম ঝুঁকির জায়গা সেক্টর ফান্ড। এর টাকা একটি নির্দিষ্ট শিল্পে খাটে। যা এড়ানোর কথা আমরা এতক্ষণ ধরে বলছি। এই ফান্ড কপাল ভাল হলে রিটার্নের ঝুলি ভরে দিতে পারে। তেমনই উল্টোটা হলে ডোবার সম্ভাবনা। ১৯৯৭-২০০০ সাল নাগাদ ডট-কম বুমের সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার বাড়বাড়ন্তে প্রচুর মানুষ আইটি ফান্ডে টাকা রাখেন। পরে ওই সমস্ত সংস্থার শেয়ারে ধস নামায় বিপুল লোকসান হয়েছিল তাঁদের।

একই ভাবে গত কয়েক বছরে অসংখ্য ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফান্ড বাজারে এসেছে। টাকাও ঢেলেছেন অনেকে। কিন্তু এই সময়ে এই ফান্ডগুলির গড় রিটার্ন আদতে মাত্র ৩.৯০%।

তাই কলজের জোর থাকলে তবেই পা বাড়ান সেক্টর ফান্ডের দিকে। নয়তো তাকে এড়িয়ে চলাই ভাল।

লেখক মিউচুয়াল ফান্ড বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন