কুবের উবাচ

সাধারণত কোনও প্রোফাইল বিশ্লেষণের সময়ে দু’টি জিনিস চোখে পড়ে। কিছু চিঠিতে নিজের লক্ষ্য অনুসারে পরিকল্পনা করেন অনেকে। অথচ লগ্নির জন্য ঠিক মতো প্রকল্প বেছে না-নেওয়ায় পুরো বিষয়টাই এলোমেলো হয়ে যায়।

Advertisement

শৈবাল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৫ ০১:০৬
Share:

সুজয় (৪৬) • স্বাতী (৩৭) • সম্পূর্ণা (১৪)

Advertisement

বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত • বাড়ি কলকাতায় • চান, মেয়ের শিক্ষা ও বিয়ের জন্য সঞ্চয় করতে
• অবসরের পর বিদেশ যেতে আগ্রহী • লক্ষ্য সচ্ছল অবসর

Advertisement

সাধারণত কোনও প্রোফাইল বিশ্লেষণের সময়ে দু’টি জিনিস চোখে পড়ে। কিছু চিঠিতে নিজের লক্ষ্য অনুসারে পরিকল্পনা করেন অনেকে। অথচ লগ্নির জন্য ঠিক মতো প্রকল্প বেছে না-নেওয়ায় পুরো বিষয়টাই এলোমেলো হয়ে যায়। আবার অনেক প্রোফাইলে পরিকল্পনা তো দূর অস্ত্‌, লক্ষ্যই স্থির করা নেই। ফলে নানা খাতে টাকা ঢেলেও শেষ পর্যন্ত সেই লগ্নি ফল দেয় না। যে কারণে নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করা এবং সেই অনুসারে পরিকল্পনা করে সঠিক খাতে লগ্নি— তহবিল গড়ে তুলতে এই দুইয়ের সমন্বয় খুব জরুরি বলে বারবার বলি আমি। ঠিক সেটাই আজ দেখলাম সুজয়ের প্রোফাইলে।

সাজানো গোছানো লগ্নি

সুজয়ের মতো বেতন বা তার বেশি মাইনে পেতে আমরা অনেককেই দেখেছি। কিন্তু তাঁর মতো সঞ্চয় করতে খুব কম লোকই পারেন। এ সবই সম্ভব হয়েছে কারণ, তিনি সংসার খরচকে মাত্রাছাড়া হতে দেননি। পাশাপাশি সুজয় যে-ভাবে বুদ্ধি করে বিভিন্ন খাতে লগ্নি ছড়িয়ে দিয়েছেন, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। এখানে সংক্ষেপে তাই আলোচনা করলাম—

চাকরির প্রথম জীবনে ১০.৪০ লক্ষ টাকার এনডাওমেন্ট পলিসি কিনেছিলেন। যার সবক’টিই ২০২৪ সালের মধ্যে শেষ হচ্ছে। কিন্তু তার পরবর্তী জীবনের কথা মাথায় রেখে তিনি আরও ৯৫ লক্ষ টাকার আলাদা টার্ম পলিসি করেছেন।

অফিস থেকে স্বাস্থ্যবিমা পেলেও, নিজের ও পরিবারের জন্য আলাদা বিমার ব্যবস্থা করেছেন।

সুরক্ষিত প্রকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছেন পিপিএফ, স্থায়ী আমানত, ভলেন্টারি পিএফ-কে।

অন্য দিকে, ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন মিউচুয়াল ফান্ডে এসআইপি করে তহবিল গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছেন। তেমনই টাকা রেখেছেন ব্লু-চিপ শেয়ারেও।

বিপদের কথা ভেবে ভুলে যাননি সেভিংস অ্যাকাউন্ট-কেও।

খরচের মধ্যেই তিনি পুজোয় সামাজিকতা রক্ষা এবং প্রতি বছর বেড়াতে যাওয়ার মতো টাকাও রাখেন।

এর পরেও তাঁর কিছু প্রশ্ন রয়েছে। তারই উত্তর দেব আজ।

লক্ষ্য ১: সম্পূর্ণার উচ্চশিক্ষা

সন্তানকে ভাল শিক্ষা দেওয়ার স্বপ্ন সব বাবা-মায়েরই থাকে। সুজয় শুধুমাত্র সে জন্যই মাসে ৭,০০০ টাকার এসআইপি করেছেন। যা খুবই প্রশংসার। এর জন্য আগামী দিনে তিনি ১০ লক্ষ টাকা খরচ হবে বলে ধরেছেন। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি এবং উচ্চশিক্ষার খরচের কথা মাথায় রেখে বলব আরও কিছু সঞ্চয় তাঁকে এই খাতে বাড়াতে হবে। আমি ধরে নিচ্ছি, এখন এ জন্য ১২ লক্ষ টাকা লাগে। সেই অনুসারে ৭% মূল্যবৃদ্ধি ধরে ২০২০ সালে লাগবে প্রায় ১৮ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ তাঁর এসআইপি-র তহবিলে হবে না।

এর জন্য এখনই তাঁকে আরও ৩,০০০ টাকা করে ইকুইটি ফান্ডে এসআইপি করার পরামর্শ দেব। যে এনডাওমেন্ট পলিসিগুলি ২০২০-র মধ্যে শেষ হচ্ছে, সেই টাকাও উচ্চশিক্ষার জন্য ধরে রাখতে হবে। দেখে নিন ১ নম্বর সারণি।


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

লক্ষ্য ২: সম্পূর্ণার বিয়ে

সুজয় ঠিকই ধরেছেন যে, তাঁর বাকি এনডাওমেন্ট পলিসি-র টাকায় সম্পূর্ণার বিয়ের খরচ উঠে আসবে। অর্থাৎ সে দিক থেকে তিনি অনেকটাই নিশ্চিন্ত। আমি ধরে নিচ্ছি, এখন বিয়ের জন্য ৮ লক্ষ টাকা লাগে। তিনি যদি ২৭ বছর বয়সেও সম্পূর্ণা বিয়ে করে, তা হলে মূল্যবৃদ্ধি ৭% ধরলে ওই সময় গিয়ে তা দাঁড়াবে প্রায় ১৮ লক্ষে। দেখে নিন ২ নম্বর সারণি।

তাঁর সব পলিসির মেয়াদই ২০২৭ সালের আগে শেষ হচ্ছে। আমার মতে, তিনি সেই টাকা সম্পূর্ণার বিয়ে পর্যন্ত স্থায়ী আমানতে রেখে দিন। প্রয়োজনের সময় সেখান থেকে তুলে ব্যবহার করতে পারবেন। উপরের দুই তালিকা দেখে বোঝা যাচ্ছে পড়াশোনা এবং বিয়ের পরেও সুজয়ের তহবিলে মোট প্রায় ৭ লক্ষ টাকা বাড়তি থাকবে, যা তিনি অবসরের সময় ব্যবহার করতে পারবেন।

লক্ষ্য ৩: অবসরের সঞ্চয়

লোক-লৌকিকতা সেরে এখন সংসার চালাতে সুজয়ের মাসে ২৫ হাজার টাকা লাগে। অর্থাৎ বছরে ৩ লক্ষ টাকা। এই জীবনযাত্রা বজায় রাখলে ২০২৭ সালে অবসরের সময় সেই খরচই বেড়ে দাঁড়াবে ৬.৭৫ লক্ষে। ৮% রিটার্নের কোনও সুরক্ষিত প্রকল্পে টাকা রেখে বছরে ওই অর্থ পেতে হলে তাঁর তহবিল হতে হবে ৮৪,৩৭,৫০০ টাকার। দেখে নেব ওই সময়ে গিয়ে সুজয়ের এই পরিমাণ অর্থ জমে কি না। দেখে নিন ৩ নম্বর সারণি।

দেখা যাচ্ছে, সঠিক পরিকল্পনা এবং সেই অনুসারে সঞ্চয় চালিয়ে গেলে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি তহবিল জমবে সুজয়ের।

তিনি চাইছেন, অবসরের পরও পিপিএফ চালিয়ে যেতে। আমার মতে, তার দরকার নেই। কারণ, চাকরি করার সময় তাঁর হাতে নিয়মিত টাকা এলেও, অবসরের পর তা থাকবে না। ফলে একটি প্রকল্প চালাতে গিয়ে অন্যান্যগুলির টাকা ভাঙতে হতে পারে। পাশাপাশি, ৬০ বছরের পর বাড়তি কর ছাড়ের সুযোগ এমনিতেই থাকে। ফলে শুধু করের জন্য এই লগ্নি চালিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। এর সঙ্গেই মনে রাখতে হবে, অবসরের পর কিন্তু চিকিৎসা-সহ বিভিন্ন কারণে নগদ টাকার প্রয়োজন অনেক বেশি।

সুজয় ঝুঁকি নিতে পিছপা নন, তা তাঁর ১৭ হাজার টাকার এসআইপি দেখেই বোঝা যায়। ফলে অবসরের পরও তিনি কম ঝুঁকির ঋণপত্র নির্ভর ফান্ডে লগ্নি চালাতে পারেন। এতে প্রয়োজনে টাকা তোলা সহজ। সম্ভব মূল্যবৃদ্ধিকে কাবু করাও।

অন্যান্য

পুজো এবং প্রতি বছর বেড়াতে যাওয়ার জন্য সুজয় মাসে ৬,০০০ টাকা সরিয়ে রাখেন। যা আরও এক বার তাঁর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটাই কথা বলার, বাড়িতে টাকা না-রেখে সেই অর্থই রেকারিং ডিপোজিটে রাখুন। এখান থেকে সুদও পাবেন। কম মেয়াদে টাকা মার যাওয়ারও ভয় নেই। অল্প ঝুঁকি নিতে চাইলে বেছে নিন লিকুইড ফান্ডও।

অনেকেই অফিস থেকে স্বাস্থ্যবিমার টাকা পেলে আলাদা করে বিমা করতে চান না। সুজয় কিন্তু নিজের ও স্ত্রীর জন্য ৫.৫০ লক্ষের এবং মেয়ের জন্য ১.৫০ লক্ষের বিমা করিয়ে রেখেছেন। এটা চালিয়ে যান। বেতন বাড়লে তিন জনেরই বিমার অঙ্ক বাড়াতে থাকুন।

অবসরের পরে বিদেশ যাওয়ার টাকা সঞ্চয়ের মধ্যে থেকেই পাবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আলাদা তহবিল গড়তে চাইলে বলব ডলার ভিত্তিক ফান্ডে এসআইপি-র কথা। এর ফলে টাকা-ডলারের বিনিময় মূল্য কমা-বাড়ার প্রভাব কিছুটা হলেও কাটাতে পারবেন। আগামী দিনে বেতন বাড়লে সেই টাকা এই খাতে রাখুন।

সব দিক বিচার করে বলতে পারি, সুজয়ের প্রোফাইল থেকে অনেক কিছু শেখার রয়েছে। ঠিক মতো পরিকল্পনা এবং সেই অনুসারে সঞ্চয়ের সুন্দর উদাহরণ এই প্রোফাইল।

(অনুরোধ মেনে নাম পরিবর্তিত)

ভ্রম সংশোধন

গত বিষয় আশয়ের সংখ্যায় বৃদ্ধাবাস জাগৃতি ধামের জন্য সিকিউরিটি ডিপোজিট (ফেরতযোগ্য) ২০ লক্ষ টাকার বদলে ২ লক্ষ টাকা লেখা হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন